ঘুষের ৪ লাখ টাকা পেয়ে পূবাইল থানার ওসি বলেন, ‘দ্রুত চলে এসো’
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : টঙ্গীর কেরানীরটেক বস্তির মাদক ব্যবসায়ী রুনা বেগমকে একটি মামলায় ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে ৪ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পূবাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। মাদকের একটি মামলায় সম্প্রতি সোর্সের মাধ্যমে ওই টাকা গ্রহণ করেন পূবাইল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম। বস্তির একটি কক্ষে ব্যাগভর্তি টাকা বের করার দৃশ্যসংবলিত গোপন ভিডিও ফাঁস হয় সম্প্রতি। ভিডিওতে পুলিশের সোর্স হৃদয়ের মোবাইল ফোনে তার কণ্ঠে শোনা যায় ‘স্যার পুরাটাই পাইছি’। এ কথা শোনার পর ওসি বলেন ‘চলে এসো, চলে এসো’।
টাকা পাওয়ার পরও মাদক কারবারি রুনা ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে পূবাইলে দুটি ও টঙ্গী পূর্ব থানায় একটিসহ আরও তিনটি মামলা দেন পুলিশ। ওই মামলা হওয়ার পর গোপন ক্যামেরায় করা ভিডিওটি ফাঁস করে দেন রুনার স্বজনরা। ওই ভিডিও ফাঁস হওয়ার পর এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
তবে পূবাইল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ওই কণ্ঠ তার নয়। আর সোর্স হৃদয়কেও তিনি চেনেন না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ১ অক্টোবর কেরানীরটেক বস্তিতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য রুনাকে খুঁজতে আসেন। তাকে খুঁজে পেয়ে পূবাইল থানার এসআই হুমায়ূন বলেন, ‘তোমাকে বড় স্যার (ওসি) যেতে বলেছেন, জরুরি কথা আছে। তোমার স্বামী সুমনকেও যেতে বলেছেন।’ তখন রুনা বলেন, ‘আমরা থানায় যাব কেন।’ আর তার স্বামী দোকানে বসা বলে তখন পুলিশকে জানান ওই নারী। এরপর পুলিশ রুনার স্বামীকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি বাধা দেন। তখন পুলিশ বলে, ‘তোমাদের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা রয়েছে।’ এক পর্যায়ে এসআই হুমায়ূনকে চ্যালেঞ্জ করেন রুনা। তখন ওই এসআই বলেন, ‘তোমাদের গ্রেপ্তার করতে আসিনি। তোমাদের সঙ্গে স্যার কথা বলবে’- এ কথা বলার পরও রুনা রাজি হননি। এরপর কয়েকজন নারী পুলিশসহ ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য রুনার স্বামী সুমনকে তুলে নিয়ে যান। এ সময় খবর পেয়ে টঙ্গী পূর্ব থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের সঙ্গে মাদক কারবারিদের হাতাহাতিতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন।
ওই সূত্র আরও জানায়, পূবাইল থানার এসআই হুমায়ূন কবির রুনা ও তার স্বামীকে পূবাইল থানায় নিয়ে যায়। পরের দিন রুনার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে কেরানীরটেক বস্তিতে কথা বলতে যান সোর্স হৃদয় ও আরেক মাদক কারবারি রুনার স্বামী আলাউদ্দিন। সেখানে একটি কক্ষে সোর্স হৃদয় ও আলাউদ্দিন জানায়, ৫ লাখ টাকা দিলে রফাদফা করা হবে। ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিলে তারা আসামি সুমন ও তার স্ত্রী রুনাকে অন্য মামলায় চালান দেবে না বলেও আশ্বস্ত করেন। এক পর্যায়ে ব্যাগ থেকে ৪ লাখ টাকা বের করে সোর্স হৃদয়ের হাতে দেন রুনার স্বজনরা। ওই টাকা পেয়ে সোর্স হৃদয় পূবাইল থানার ওসি শফিকুল ইসলামকে ফোন দেন। ওই সময় সোর্স হৃদয়ের মোবাইল ফোন লাউড স্পিকার দেওয়ায় গোপন ভিডিওতে ওসির কণ্ঠ শোনা যায়। সোর্স হৃদয় টাকা গ্রহণের পর ওসি ‘চলে এসো, চলে এসো’ বলে দ্রুত ফোন কেটে দেন। যাওয়ার আগে হৃদয় বলে যান, ‘আমি আপনার ছোট ভাই। আপনার বোন ও বোনের স্বামীর কিছু হবে না। তাকে অন্য মামলায় চালান দেবে না।’
রুনার ছোট বোন কারিমা আক্তার বলেন, আমার বোন ও বোনের জামাইকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন এসআই হুমায়ূন কবির। পরে আমার বোন প্রথমে ১ লাখ টাকা দেবেন বলে জানান। এরপর ৪ লাখ টাকাই দেওয়া হয়। অথচ আমার বোন ও ভগ্নিপতির বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করেন।
তিনি বলেন, যেহেতু মামলা দিল তাইলে টাকা নিল কেন? এ জন্যই তারা সবকিছু ভিডিও করে রেখেছেন। সেই ভিডিও আমরা প্রশাসনকে দেখাইছি। তবুও প্রশাসন ওসি শফিকুল ইসলাম ও হুমায়ূন কবিরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি আরও বলেন, পুলিশ তুলে নিয়ে গেল দোকান থেকে আর থানায় গিয়ে শুনি তার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে ১০০টি ইয়াবা পেয়েছে। পুলিশই ইয়াবা দিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এসআই হুমায়ূন কবির টঙ্গী পূর্ব থানায় থাকাকালে বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পূবাইল থানায় বদলি হওয়ার পর ওই থানায় মাদকসহ আসামি গ্রেফতার হলে টঙ্গীর মাদক ব্যবসায়ীদের নাম ঠুকে দেন। এরপর চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নেন। এরপর সেই টাকার ভাগও ওসি শফিকুল ইসলামকে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ঘটনার পরদিন গ্রেপ্তার রুনার পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা (৪ লাখ) নিচ্ছে পুলিশের কথিত সোর্স হৃদয়। এক পর্যায়ে পুলিশের এক সদস্যের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে শোনা যায়। রুনার পরিবারের দাবি, মোবাইল ফোনে অন্যপ্রান্ত থেকে কথা বলা ব্যক্তি পূবাইল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম। স্থানীয়রা বলছেন, পুলিশের সোর্স পরিচয় দিয়ে প্রায়ই টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলেই পুলিশের মাধ্যমে নানা অজুহাতে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি করা হয়।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, অভিযানের সময় ঘটনাস্থলে পুলিশের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কথিত সোর্স হৃদয়। পরদিন টাকা লেনদেনের ঘটনায়ও মূল ভূমিকায় ছিলেন হৃদয়। এমনকি ১৬ আগস্ট রুনার বিরুদ্ধে করা পূবাইল থানায় মাদক মামলার এজাহারে এক নম্বর সাক্ষীর নামও হৃদয়। পূবাইল থানা পুলিশের এক সদস্য নিশ্চিত করেছেন, এক নম্বর সাক্ষী হৃদয়ই ওই সোর্স হৃদয়। তবে এজাহারে দেওয়া সাক্ষী হৃদয়ের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মামলার সাক্ষী হননি বলে জানান। এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন। আর পূবাইল থানার ওসির দাবি, তিনি হৃদয়কে চেনেন না।
জানা গেছে, টঙ্গীর মাদক কারবারিদের ঘাঁটি খ্যাত ব্যাংকের মাঠ বস্তির শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মোমেলা বেগমের মেয়ের স্বামী সোর্স হৃদয়। একাধিকবার ভুয়া পুলিশ ও সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার হন তিনি। এ ছাড়াও তার ব্যবহৃত গাড়ি দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাদক নিয়ে আসে মাদক কারবারিরা। সোর্স পরিচয়ে বিভিন্ন মানুষকে হয়রানি করে টাকা আদায় করা হয়। সম্প্রতি টেকনাফে চার মাদক ব্যবসায়ীকে আটকে রেখে টাকা আদায়ের ঘটনায় হৃদয়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই হৃদয় বর্তমানে পূবাইল থানার ওসির শফিকুল ইসলামের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বলে এলাকাবাসী সূত্র জানায়।