আলোচিতজাতীয়

২১ অগাস্ট: কর্মীদের মানবঢালে যেভাবে প্রাণে বাঁচেন শেখ হাসিনা

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে যাওয়ার কথা ছিল না নজিব আহমেদের। তারপরও তিনি কেন গিয়েছিলেন? এখন তিনি ভাবেন, ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট ওই জনসভায় যদি না যেতেন, শেখ হাসিনার যদি কিছু হয়ে যেত, হয়ত আত্মগ্লানি নিয়েই বাকি জীবন তাকে কাটাতে হত।

সেদিন গিয়ে হামলায় পড়ে দেহে এখনও স্প্লিন্টার নিয়ে চলতে হলেও নজিব আহমেদের তৃপ্তি এখানেই, বঙ্গবন্ধুকন্যাকে প্রাণে বাঁচাতে পেরেছিলেন তারা।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে সেই হামলা যে শেখ হাসিনাকে হত্যা, আর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে চালানো হয়, তা পরে আদালতের রায়ে উঠে আসে।

নজিব আহমেদ তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। আর আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা।

১৮ বছর আগে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সেদিন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়েছিলেন সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি মিছিলে অংশ নেবেন বলে। রাস্তার ওপর খোলা ট্রাকে তৈরি করা হয়েছিল অস্থায়ী মঞ্চ। সেখানেই হয় হামলা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেটা ছিল ভয়ঙ্কর এক দিন। গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ওই ঘটনা স্তব্ধ করে দিয়েছিল জাতিকে।

নজিব আহমেদের মত বিশ্বস্ত কর্মীরাই সেদিন মানবঢাল রচনা করে তাদের নেত্রীর জীবন বাঁচিয়েছিল, শেখ হাসিনা নিজেও বহুবার সে কথা বলেছেন।

সেদিনের গ্রেনেডের স্প্লিন্টার আজও নিজের শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন শেখ জামাল ক্লাবের পরিচালক ক্রীড়া সংগঠক নজিব আহমেদ। তার স্মৃতিতে আজও জ্বলজ্বলে দেড় যুগ আগের সেই বিকাল।

“কী যে দুর্বিষহ অবস্থা, তবে আমাদের কাছে একটাই শান্তি- সেদিন আমরা রক্ত দিয়েছি, অনেকে জীবন দিয়েছেন। কিন্তু শেখ হাসিনাকে আল্লাহর রহমতে তারা রক্ষা করতে পেরেছেন।”

নজিব আহমেদের বাবা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ফুপাত ভাই। নজিব সে সময় ছিলেন শেখ হাসিনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মীদের একজন।

তিনি বলেন, “আমি আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব নিজের বুকের রক্ত দিয়ে, জীবন বাজি রেখে… সেদিন জীবনের পরোয়া করিনি।”

৬৪ বছর বয়সী নজিব এখন দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছেন। ২১ অগাস্টের সেই ভয়াবহতা, মানববর্ম তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করা, আজকের উপলব্ধি আর আগামীর প্রত্যাশা নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে।

নজিব আহমেদের জবানিতে সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ

মুহূর্তেই আতঙ্ক

আমি সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে যাই। ওইদিন প্রচণ্ড রোদ ছিল, আমারও খারাপ লাগছিল। এক পর্যায়ে ট্রাকে উঠে পড়ি।

আপা বক্তৃতা শুরু করেন, বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে শুরু হয় হামলা। হঠাৎ দেখলাম, সিটি হোটেলের ওই দিক থেকে কালো কী যেন উড়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে সেটা বিস্ফোরিত হল। যে যে দিকে পারল, আতঙ্কে ছুটতে লাগল আত্মরক্ষার্থে। তাৎক্ষণিকভাবে আপার কাছেই ছুটে যাই।

তাৎক্ষণিক পর্যবেক্ষণ

জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আসার পর থেকে উনার নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে আমিও একজন। নিজেকে সবার সিনিয়র হিসেবে দাবি করি।

আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম সেখানে গিয়ে, সাধারণত বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আমরা যে কোনো প্রোগ্রাম করলে সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশ বিভিন্ন ছাদে ওঠে। কিন্তু ওইদিন আমাদের কোনো নেতাকর্মীকে পুলিশ ছাদে উঠতে দেয়নি এবং কোনো পুলিশ সদস্যও ওইদিন ছাদের উপর কোনো ডিউটি করেনি। এটাকে আমরা অত খুব সিরিয়াসলি কিছু দেখিনি [তখন]। কিন্তু আমাদের নজরে এসেছে।

যেভাবে মানববর্ম

তখন কয়েক সেকেন্ডে দুই তিনটা বিস্ফোরণ হয়ে গেল, আমি যখন ওখানে আপার কাছাকাছি পৌঁছলাম তখন ডান দিকে হানিফ [মেয়র মোহাম্মদ হানিফ] ভাই, বামে ছিলেন মামুন [অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার আব্দুল্লাহ আল মামুন] ভাই, পিছনের দিকে ছিলেন মায়া [মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া] ভাই।

তো তিনটা সাইড উনার [আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা] কাভার ছিল, কিন্তু উনার ফ্রন্ট সাইডে একটু টেবিলের মত রয়েছে। অথচ টেবিলটা হাফ-হাফের জায়গায়; টেবিলটা উনার অর্ধেক কাভার করছে, অর্ধেকে উনি উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।

আমি গিয়ে সামনে দিকটা কাভার করি।

আমরা স্যান্ড ব্যাগের মতো, বালির বস্তা দিয়ে যেভাবে করে, ঠিক সেভাবে আমরা মানববর্ম দিয়ে উনাকে রক্ষার চেষ্টা করলাম।

এক পর্যায়ে হাসিনা আপা বললেন- ‘তুমি হচ্ছো আমার ব্যারোমিটার। তুমি কোনো কথা বলো না। তোমার গলার আওয়াজ শুনলে হামলাকারীরা ধরে নেবে, তুমি এখানে আছ, মানে আমিই এখানে আছি ।’

ফের আক্রমণ, দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ

উনি [শেখ হাসিনা] আমাকে প্রথম যে কথাটি বললেন, ‘কথাবার্তা বাদ দিয়ে বলো- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রসুলাল্লাহ। লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতুম মিনাজ যোয়ালিমিন। দোয়া ইউনূস পড়ো। আল্লাহ যদি আমাদের রক্ষা করে, রক্ষা হবে।’ উনি বারবারই বললেন, ‘আল্লাহকে ডাকো, আল্লাহকে ডাকো’। তখন উনি [দোয়া] পড়ছেন, শুনে শুনে আমিও পড়ছি।

এখানে অবস্থান করাটা নিরাপদ না। আমাদের এখন স্থান ত্যাগ করতে হবে। এ পর্যায়ে উনাকে কাভার করে আমরা গাড়ি থেকে নামিয়ে আনি, আনার চেষ্টা করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত খুনিরা আবার আমাদের উপর অ্যাটাক করে। সেই আক্রমণে গ্রেনেডটা সঠিক কোথায় পড়েছিল আমি বলতে পারব না; কারণ আমাদের নজর ছিল উনাকে [শেখ হাসিনা] নিরাপদে নামিয়ে আনার জন্যে গাড়ির দরজার দিকে। আমরা যেভাবে মানব সেল করেছিলাম, ঠিক সেভাবে উনাকে কাভার করে গাড়িতে তুললাম।

তখন দেখছিলাম, শত শত নেতা রক্তের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে, কাতরাচ্ছে, গড়াগড়ি করছে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য একটাই। আমরা যে কোনো মূল্যে উনাকে [শেখ হাসিনাকে] নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাব। আমরা নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি, আল্লাহর রহমতে।

সঙ্গী স্প্লিন্টার, তবুও আত্মতৃপ্তি

মাঝে মাঝে এ স্প্লিন্টারগুলো ঘুরে ফেরে বেড়ায় শরীরে। বুকের ডান পাশে ছিল, এখন আরও উপরে কাঁধের কাছে। কারণ এটা হেঁটে বেড়ায়। অমাবস্যা, পূর্ণিমা, শীতের দিনে, এসির মধ্যে গেলে এগুলো পেইন হয়। এ পেইনটা যাদের শরীরে স্প্লিন্টার রয়েছে, তারা বছরের পর বছর… এ বেদনা, ব্যথা কেউ কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না। যার গায়ে স্প্লিন্টার আছে, সেই শুধু এর ব্যাখ্যা দিতে পারবে। সেই বলতে পারবে এ কষ্ট কত।

বিভিন্ন কারণে আমার এমআরআই করার দরকার হয়, কিন্তু আমি তা করতে পারি না। কারণ আমার শরীরে স্প্লিন্টার আছে। এ যে দুর্বিষহ অবস্থা, তবে আমাদের কাছে একটাই শান্তি, যেদিন আমরা রক্ত দিয়েছি অনেকেই জীবন দিয়েছে, কিন্তু শেখ হাসিনাকে আল্লাহর রহমতে তারা রক্ষা করতে পেরেছেন।

যে ভয়াবহ আক্রমণ হয়েছিল, আল্লাহই রক্ষা করেছেন। মানুষের কোনো ক্ষমতা নেই।

আমার যাওয়ার কথা ছিল না। আমি কেন গিয়েছিলাম? আমি এখন ভাবি, আমি যদি না যেতাম, আর যদি শেখ হাসিনার কিছু হয়ে যেত, সারাজীবন আরেকটা আত্মগ্লানিতে জীবন কাটিয়ে দিতে হত। কিন্তু এখন আমি আত্মতৃপ্ত।

যদি কোনো দিন প্রয়োজন আসে, এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সর্বদাই সর্বখানে তৈরি আছি। যে কোনো যুদ্ধে জীবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার মত এখনও শক্তি সাহস আছে।

এটুকুই চাওয়া

আমি এখন ক্যান্সারের রোগী, চিকিৎসার মধ্যে রয়েছি। আমরা যেমন রাজনৈতিকভাবে কমিটেড ছিলাম, আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব আমরা পালন করেছি, কোনোদিন উনাকে রেখে পালিয়ে যাইনি; কোনোদিনও উনাকে ছেড়ে যাইনি। এটাই আমার জীবনের একটা বড় সাফল্য। আমি আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব … নিজের বুকের রক্ত দিয়ে, জীবন বাজি রেখে… জীবনের পরোয়া করিনি।

রায় হয়েছে, সাজাও কার্যকর হোক

আমরা চাই, যে ২৪ জন নিরাপরাধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জীবন দিয়েছেন, খুনীরা নির্বিচারে হত্যা করেছে, দুইশ থেকে আড়াইশ মানুষকে যারা আহত করেছে, জীবনের তরে পঙ্গু করে দিয়েছে, তাদের যে বিচার হয়েছে, সে বিচারের রায় কার্যকর করা হোক।

তারেক রহমানসহ যারা এর কুশীলব ছিল, যারা পলাতক রয়েছে, তাদের ফিরিয়ে এনে আইনের আওতায় এনে সাজা কার্যকর করা হোক।

পলাতক খুনিরা যারা পালিয়ে আছে, তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে এবং আদালতের দেওয়া সাজা বাস্তবায়িত হলে আমাদের মত যারা আহত বা যারা নিহত হয়েছে তাদের পরিবার ও বিদেহি আত্মা শান্তি পাবে।

 

সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button