আলোচিত

বিএমইটি’র সার্ভার জালিয়াত চক্রের কবলে, বিদেশগামী কর্মীরা পাচ্ছে ভুয়া স্মার্ট কার্ড

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সার্ভার ব্যবহার করে বিদেশ গমন ছাড়পত্রের ভুয়া স্মার্ট কার্ড ইস্যু করছে একটি চক্র। এসব কার্ডের মাধ্যমে চাহিদার অতিরিক্ত কর্মী বিদেশে পাঠাচ্ছে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি। আবার জালিয়াতির মাধ্যমে এক এজেন্সির নামে কার্ড তৈরি করে কর্মী পাঠিয়েছে অন্য এজেন্সি। এভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর একটি ঘটনা চিহ্নিত হওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিএমইটির কার্ড শাখার কর্মীদের যোগসাজশ ছাড়া সার্ভারে এ ধরনের জালিয়াতি সম্ভব নয় বলে মনে করেন জনশক্তি খাত-সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, বিদেশগামী কর্মীদের জন্য ২০১০ সালে স্মার্ট কার্ড চালু করে বিএমইটি। এই কার্ডে পাসপোর্ট-ভিসায় থাকা তথ্য, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিবেদনের পাশাপাশি বিদেশগামী চাকরিপ্রার্থীদের আঙুলের ছাপ (বায়োমেট্রিক ইমপ্রেশন) রাখা হয়। বিমানবন্দরে অভিবাসন শাখায় স্থাপিত যন্ত্রে আঙুলের ছাপ দিলে কর্মীর সব তথ্য দেখতে পাওয়া যায়। এর ভিত্তিতে ওই কর্মীকে অভিবাসন ডেস্ক পার হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে বেশ কয়েকবার স্মার্ট কার্ড জালিয়াতির ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে। ভুয়া কার্ড বানিয়ে আরব আমিরাতে লোক পাঠানোর একটি ঘটনায় গত বছরের জুলাই মাসে প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত কমিটি। ওই প্রতিবেদনে বিএমইটির ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছয় রিক্রুটিং এজেন্সি জালিয়াতিতে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের কর্মচারী সাইদুল ইসলামকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আর দুই কর্মকর্তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে।

এত কিছুর পরও জালিয়াতি বন্ধ হয়নি। বিএমইটির সার্ভারে জালিয়াতি করে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর একটি ঘটনা সম্প্রতি সামনে এসেছে।

জানা গেছে, মালয়েশিয়ান কোম্পানি এক্সিয়ানার্জি (এম) এসডিএন বিএইচডির কাছ থেকে ১৫০ কর্মী পাঠানোর কাজ পায় রিক্রুটিং এজেন্সি আল মামুন ওভারসিজ (রিক্রুটিং লাইসেন্স নম্বর ৬২৯)। তবে এজেন্সিটি মালয়েশিয়ান সরকারের তালিকাভুক্ত নয়। এ কারণে আল হেরা ওভারসিজের নামে এসব কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র ইস্যু করা হয়। আল মামুন ওভারসিজ নির্বাচিত কর্মীদের পাসপোর্ট না দিয়েই আল হেরা ওভারসিজকে বিএমইটি ছাড়পত্রের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া শুরুর অনুরোধ করে। আল হেরা ওভারসিজ সেই প্রক্রিয়া শুরু করলেও ভিন্ন পথে হাঁটে আল মামুন ওভারসিজ। তারা বিএমইটির অসাধু কর্তাদের যোগসাজশে জুনের শেষদিকে ঈদের ছুটির সময় অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠান আল-খামিজ ইন্টারন্যাশনালের (আরএল ৬৮০) নামে বহির্গমন ছাড়পত্র সংগ্রহ করে ১২০ কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দেয়। অথচ আল-খামিজ ইন্টারন্যাশনালের কেউ এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না।

পরে বিষয়টি জানতে পেরে আল-খামিজ ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. ফরিদ আহমদ গত ৯ জুলাই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আল মামুন ওভারসিজের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (কর্মসংস্থান) এ এইচ এম আনোয়ার পাশাকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রণালয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বিএমইটির পরিচালক মিজানুর রহমান এবং উপপরিচালক জহুরা বেগম।

তদন্ত কমিটির প্রধান এএইচএম আনোয়ার পাশা বলেন, ‘বহির্গমন ছাড়পত্রের স্মার্ট কার্ড জালিয়াতির বিষয়ে তদন্ত কাজ চলছে। শিগগির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’

এদিকে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগকারী আল খামিজ ওভারসিজের মালিক ফরিদ আহমেদ গত ২৮ জুলাই মারা যান। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘বহির্গমন নীতিমালা লঙ্ঘন করে অত্যন্ত সুকৌশলে আল মামুন ওভারসিজের মালিক চরম প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। এ ধরনের সার্ভার জালিয়াতি কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না।’

এদিকে মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ আল হেরা ওভারসিজের নামে কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র ইস্যু করায় এ প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে ১ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার টাকা কেটে নিয়েছে দেশটির বৈদেশিক কর্মীদের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (এফডব্লিউসিএমএস)।

আল হেরা ওভারসিজের মালিক রাশেদ খান জানান, ‘চাহিদাপত্র দেওয়ার পরও জালিয়াতি করে অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১২০ কর্মী পাঠানোর কারণে বড় রকমের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ি। বিষয়টি জানার পর আল মামুন ওভারসিজের মালিক মোশারফ হোসেনের সঙ্গে কথা বলি। এর দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে বিএমইটির সার্ভার থেকে ১২০ জনের বহির্গমনের তথ্য মুছে ফেলা হয়। বিষয়টি নিয়ে ঘরোয়া সালিশে মোশারফ হোসেন তার অপরাধ স্বীকার করে আমাকে কিস্তিতে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আল হেরা ওভারসিজকে কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্র দিলেও তাদের নির্ধারিত প্রক্রিয়াকরণ ফি দিতে চাননি আল মামুন ওভারসিজের মালিক মোশাররফ হোসেন। এ জন্য তিনি কৌশলে কিউ কে কুইক এক্সপ্রেস লিমিটেড (আর এল ৪৪১) নামে আরেকটি কোম্পানির মালিক রবিউল ইসলাম রবিনকে ১২০ কর্মীর পাসপোর্ট বুঝিয়ে দেন। সেইসঙ্গে তাকে ৫৪ লাখ টাকা দেন। পরে এই রবিউল ইসলাম রবিনই বিএমইটির সার্ভার জালিয়াতি করে ১২০ কর্মীকে আল খামিজ ওভারসিজের নামে বহির্গমন স্মার্ট কার্ড সংগ্রহ করে মালয়েশিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। রবিনকে ধরতে পারলেই সার্ভার জালিয়াতির রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কিউ কে কুইক এক্সপ্রেসের মালিক রবিউল ইসলাম রবিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। জালিয়াতিকাণ্ডের পর তিনি দুবাইয়ে পাড়ি জমিয়েছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

অন্যদিকে আল মামুন ওভারসিজের মালিক মোশাররফ হোসেনের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই মুহূর্তে বিদেশে অবস্থান করছেন বলে জানান। তিনি দেশে না ফেরা পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

জানা গেছে, বিএমইটির সার্ভার জালিয়াতি করে বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু করে কর্মীদের বিদেশে পাঠানোর পর সেই তথ্য মুছে ফেলা (ডিলিট) হয়। এ ঘটনায় একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। জনশক্তি খাত-সংশ্লিষ্টদের মতে, জালিয়াতির সঙ্গে বিএমইটির কার্ড সেকশন জড়িত না থাকলে এভাবে সার্ভারের তথ্য মুছে ফেলা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রার সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘বিএমইটির সার্ভার জালিয়াতির ঘটনা বড় ধরনের রাষ্ট্রীয় অপরাধ। এ বিযয়ে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি দিতে হবে।

এ বিষয়ে বিএমইটির মহাপরিচালক শহীদুল আলম বলেন, ‘সার্ভার জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন দিলে তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হবে।’

 

সূত্র: কালবেলা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button