চাঁদে যাওয়ার লক্ষ্যে উৎক্ষেপণের অপেক্ষায় ভারতের চন্দ্রযান-৩

গাজীপুর কণ্ঠ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারতকে চাঁদে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে উৎক্ষেপণের অপেক্ষায় চন্দ্রযান-৩।
ভারতের তৃতীয় চন্দ্রাভিযানের এই মহাকাশযান তৈরি হয়েছে অরবিটার, ল্যান্ডার ও রোভার- এই তিনটি অংশ নিয়ে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সব ঠিক থাকলে শুক্রবার দুপুর ২টা ৩৫ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপণ হবে চন্দ্রযান ৩। পুরো ভারত এখন সেই মুহূর্তের অপেক্ষায়।
আর এই অভিযান সফল হলে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ভারত চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে একটি রোবটযান নামাতে সক্ষম হবে। চাঁদের ওই অংশ এখনও খুব কমই জানে মানুষ।
বিবিসি লিখেছে, চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার আগামী ২৩ বা ২৪ অগাস্ট চাঁদে অবতরণ করবে বলে আশা করছেন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর বিজ্ঞানীরা।
এর আগে কেবল যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মহাকাশযান নিরাপদে চাঁদের মাটিতে নামতে পেরেছে।
চাঁদে পৌঁছানোর চেষ্টায় এর আগে দুটো অভিযান চালিয়েছে ভারত।
২০০৮ সালে প্রথম অভিযানে চন্দ্রযান-১ পৌঁছেছিল চাঁদের কক্ষপথে। চাঁদের ভূপৃষ্ঠের গঠন ও পানির উপস্থিতি নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা চালানো হয় সে সময়।
চন্দ্রযান-১ অভিযানের প্রকল্প পরিচালক মিলস্বামী আন্নাদুরাই বিবিসিকে বলেন, দিনের বেলায় চাঁদে যে একটি বায়ুমণ্ডল সক্রিয় থাকে, ওই গবেষণাতেই তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
দ্বিতীয় অভিযানে চন্দ্রযান-২ এও এবারের মত অরবিটার, ল্যান্ডার ও রোভার ছিল। ২০১৯ সালের সেই অভিযান আংশিকভাবে সফল হয়েছিল।
চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার আজও চাঁদের চারপাশ প্রদক্ষিণ করছে এবং তথ্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু এর ল্যান্ডার অবতরণের সময় শেষ মুহূর্তের জটিলতায় চাঁদের মাটিতে বিধ্বস্ত হয়।
ইসরোর প্রধান শ্রীধরা পানিকার সোমানাথ বিবিসিকে বলেন, আগের অভিযানের তথ্য তারা খুব সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করে এবারের অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, যাতে চন্দ্রযান-৩ কোনো জটিলতায় না পড়ে।
৩৯০০ কেজি ওজনের চন্দ্রযান-৩ বানাতে খরচ হয়েছে ৬.১ বিলিয়ন রুপি (সাড়ে ৭ কোটি ডলার)। আগেরবারের মত এবারের অভিযানেও ইসরোর লক্ষ্য, চাঁদের মাটিতে ল্যান্ডারের সফল অবতরণ নিশ্চিত করা।
ইসরোর প্রতিষ্ঠাতার নামে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডারের নাম রাখা হয়েছে বিক্রম, যার ওজন প্রায় দেড় হাজার কেজি। ওই বিক্রমই তার পেটের মধ্যে বহন করবে ২৬ কেজি ওজনের রোভার বা রোবটযান প্রজ্ঞানকে।
পৃথিবী থেকে চন্দ্রযান-৩ কে মহাকাশে পৌঁছে দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে এলভিএম-৩ রকেট। ভারতীয়রা এ রকেটের নাম দিয়েছে ‘বাহুবলী’।
শুক্রবার উৎক্ষেপণের পর এই মহাকাশযান চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করতে সময় লাগবে ১৫ থেকে ২০ দিন। বিজ্ঞানীরা এরপর ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মহাকাশযানকে নিয়ে যাবেন, যেখান থেকে বিক্রমের অবতরণপর্ব শুরু হবে।
বিক্রম ঠিকঠাক চাঁদে নামতে পারলে এর পেট থেকে বেরিয়ে আসবে ছয় চাকার প্রজ্ঞান। চাঁদের পৃষ্ঠে ঘুরে ঘুরে সে পৃথিবীতে পাঠাবে তথ্য আর ছবি।
সোমানাথ বলেন, পাঁচ ধরনের যন্ত্র বহন করছে চন্দ্রযানের রোভার। চন্দ্রপৃষ্ঠের গাঠনিক বৈশিষ্ট্য, পৃষ্ঠের কাছাকাছি বায়ুমণ্ডল এবং ভূগর্ভে নিচে কী ঘটছে তা জানার চেষ্টা করবেন বিজ্ঞানীরা।
ইসরো প্রধান আশা করছেন, এই অভিযানে নতুন কিছু খুঁজে পাবেন তারা।
চাঁদের যে অংশে চন্দ্রযান পৌঁছাতে চায়, সেই দক্ষিণ মেরু নিয়ে মানুষের গবেষণা খুব বেশি এগোয়নি। ছায়ায় ঢাকা ওই অঞ্চল চাঁদের দক্ষিণ মেরুর চেয়ে অনেকটা বড়। ধারণা করা হয়, সবসময় অন্ধকারে থাকা ওই অঞ্চলে পানির অস্তত্ব থাকতেও পারে।
সোমনাথ বলেন, “আমরা যদি নতুন কিছুর সন্ধান পেতে চাই, তাহলে আমাদের চাঁদের এমন জায়গায় যেতে হবে, যে এলাকা নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। চাঁদের দক্ষিণ মেরু আমাদের সেই সুযোগ দিতে পারে। তবে ওই অংশে অবতরণের ঝুঁকিও অনেক বেশি।”
তিনি জানান, চন্দ্রযান-২ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় সমস্ত তথ্য তারা সংগ্রহ করেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন, যাতে আগেরবারের মত জটিলতা এড়ানো যায়।
চন্দ্রপৃষ্ঠের যে জায়গায় চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার নামাতে চাইছে ইসরো, সেই জায়গার অনেক ছবি চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার গত কয়েক বছরে পাঠিয়েছে। ফলে সেখানে ঠিক কতগুলো বোল্ডার এবং গর্ত আছে, সে বিষয়ে বেশ ভালো ধারণা পেয়েছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা।
মিলস্বামী আন্নাদুরাই জানান, চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডারের অবতরণের সময়টা হতে হবে একেবারে নির্দিষ্ট, চাঁদের কোনো এক দিনের ঠিক সূচনায়। কারণ ল্যন্ডর আর রোভারের ব্যাটারি চার্জ হতে সূর্যালোক দরকার হবে। চাঁদের এক দিন পৃথিবীর ১৪ দিনের সমান।
“আমরা যদি মহাকাশের আরো গভীরে যাওয়ার জন্য চাঁদকে একটা স্টেশন বা আউটপোস্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, আরো বহু অভিযান আমাদের চালাতে হবে। চাঁদে যে ধরনের উপাদান পওয়া যাবে, তা দিয়ে কী করে সেখানে মানুষ থাকার উপযুক্ত একটি আবাসস্থল গড়ে তোলা যায় তা আমাদের জানতে হবে। সেখানে যারা থাকবেন, তাদের জন্য পৃথিবী থেকে নিয়মিত রসদ যোগানোর উপায় কী হবে, সেটাও জানতে হবে।”
এই বিজ্ঞানীর ভাষায়, “৩ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার দূরের ওই উপগ্রহ হয়ত কোনো এক দিন পৃথিবীর একটি দূরবর্তী মহাদেশে পরিণত হবে। আসলে, সেটাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।”