আলোচিতসারাদেশস্বাস্থ্য

এডিস মশা দিনে-রাতে কামড়ায়, স্বচ্ছ-ঘোলা সব পানিতে জন্মায়

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার চরিত্রে পরিবর্তন এসেছে। সে এখন দিনে রাতে সব সময়ই কামড়ায়। এর পিছনে রয়েছে আলোক দূষণ। আর শুধু জমানো স্বচ্ছ পানি নয়। স্বচ্ছ-ঘোলা যেকোনো ধরনের জমানো পানিতেই এডিস মশা জন্ম নেয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার তার সর্বশেষ গবেষণা উদ্ধৃত করে সংবাদ মাধ্যমকে এই তথ্য জনিয়েছেন। তার কথা,”এ বছরে ডেঙ্গুর ঝুঁকির কথা আমরা আগেই জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ। কিন্তু দুই সিটি কর্পোরেশন শুধু বর্ষা মৌসুমে তৎপর হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের অনেকটা বাইরে চলে যাচ্ছে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আলাদা ব্যবস্থাপনা দরকার।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হিসাব বলছে ডেঙ্গু এখন দেশের সব জেলায় (৬৪ জেলা) ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকায় এর প্রাদুর্ভাব বেশি হলেও সব জেলায়ই মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। জুলাই মাসে ১০ দিনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৮৬৫ জন। আর মারা গেছেন ২৯ জন। আগের মাসের পুরো ৩০ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৯৫৬ জন। মারা গেছেন ৩৪ জন। আক্রান্তের হিসাবে পুরো জুন মাসের আক্রান্তের সমান আক্রান্ত হয়েছেন জুলাই মাসের ১০ দিনে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে জুলাই শেষে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন,”আমাদের চিকিৎসকেরা এরই মধ্যে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় পারদর্শী হয়ে উঠেছেন । কারণ বাংলাদেশে অনেক আগে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে। তবে পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে ব্যাস্থাপনার সংকট হতে পারে।”

চলতি বছরের শুরু থেকেই চিকিৎসকরা ডেঙ্গু রোগী পেয়েছেন। প্রত্যেক মাসেই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। জানুয়ারিতে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন ৫৬৬ জন। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই সংখ্যা দুইশ জনের নিচেই থাকে। কিন্তু মে থেকে আবার বেড়ে এক হাজার ৩৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু পরের দুই মাসে রোগীর রীতিমত উল্লম্ফন ঘটেছে। চলতি বছরে এপর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৩ হাজার ৮৪৩ জন। আর মারা গেছেন ৭৬ জন। এই সময়ে ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ৬৬৪ জন।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”আমরা গবেষণায় দেখেছি এডিস মশা এখন দিনে-রাতে সব সময় কামড়ানোর কারণ বিশ্বব্যাপী এখন আলোক দূষণ ঘটেছে। এখন রাতেও উজ্জ্বল আলো থাকে। ফলে এখন তার কাছে দিন-রাতের কোনো পার্থক্য নেই। আগে আমরা দেখতাম পরিষ্কার জমানো পানিতে এডিস মশা হয়। কিন্তু এখন দেখছি যেকোনো জমানো পানি, ময়লা বা পরিস্কার সবখানেই এডিস মশা হয়। এমনকি লোনা পানিতেও সে জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। এই মশা পরিবেশের সাথে খুবই আ্যডাপটিভ। সে সব অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে পারে। ফলে এখন ডেঙ্গু সব মৌসুমের রোগে পরিণত হয়েছে, শুধু বর্ষাকালের নয়।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে বর্ষা শুরুর আগেই দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিতেই এডিস মশার উচ্চ ঘনত্ব পাওয়া যায়। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়েছিলো। এবারের পরিস্থিতি তারচেয়েও খারাপ। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকায় এডিস মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। আর এবার এটা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

ডা. লেনিন চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”সাধারণ এডিস মশা ছাড়াও বুনো ধরনের এডিস মশা আছে। তাদের বলা হয় এডিস অ্যালগোপিকটাস। ২০১৯ সালে এর উপস্থিতি আমরা প্রথম লক্ষ্য করি। এরা বনে গাছের কোটরে জমে থাকা পানি, ঝোপঝাড়ে জমে থাকা পনিতে জন্ম নেয়। এরাই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ”

তিনি বলেন, “ডেঙ্গুর লক্ষণেও পরিবর্তন এসেছে। আগে তীব্র জ্বর হতো, চোখ লাল হয়ে যেত, গায়ে র‌্যাশ উঠত। এখন সামান্য জ্বর বা জ্বর নেই, ডায়রিয়া, পাতলা পায়খানা এবং পেট খারাপেও ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছি। এই লক্ষণই অনেক বেশি। ফলে অনেকে বুঝতেই পারছেন না যে তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত।”

ঢাকার দুই সিাটি এখন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা অভিযান চালিয়ে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করছেন। তবে মশা মারতে প্রচলিত ফগিং পদ্ধতিই ভরসা। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) দুই সিটি কর্পোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে খরচ করেছে ১৪৭ কোটি টাকা৷ কিন্তু তার কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না।

অধ্যাপক কবিরুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করতে হবে। মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো বন্ধ করতে হবে। তাকে বায়েলজিক্যালি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর এটা যেহেতু ঘরে, গ্যারেজে সবখানে জন্মায় তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। মানুষ জানে কোথায় এডিস মশা হয়। কিন্তু তারপরও সে সতর্ক হয় না। এটা এখন খুব জরুরি।”

ড. লেনিন চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে জানান, শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এর কারণ হলো তাদের প্রতি নজর দেয়া হচ্ছে না। তাদের চামড়াও পাতলা। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। আর তারা নিজেরাও জানে না। তাদের ব্যাপারে অভিভাবক, স্কুলের শিক্ষক সবার সতর্ক থাকতে হবে। “আর ডেঙ্গুর নতুন উপসর্গ সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে। যাতে তারা দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন,” বলেন এই চিকিৎসক।

কবিরুল বাশার বলেন,”যে ট্রেন্ড তাতে সামনের মাসে ডেঙ্গু রোগী আরো বাড়বে। তাই সচেতন করা ছাড়াও সিটি কর্পোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারকে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে।”

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button