শক্তিশালী পুতিনের চেয়ে দুর্বল পুতিন বেশি বিপজ্জনক

গাজীপুর কণ্ঠ, আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গত সপ্তাহের শেষে ওয়াগনার বাহিনীর স্বল্পস্থায়ী বিদ্রোহের পর রাশিয়া আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাজনৈতিকভাবে ধারণার চেয়েও বেশি দুর্বল ছিলেন। আর পুতিনের এই দুর্বলতাই বেশি বিপজ্জনক।
বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে ইইউর এক শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করে সিনিয়র কর্মকর্তারা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, রাশিয়ার সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খলা—যেখানে বিদ্রোহ করা ওয়াগনার বাহিনী মস্কোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছিল এটি সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ার একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। কর্মকর্তারা বলেন, এ ঘটনায় ইইউভুক্ত দেশের সরকারগুলোর কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে পুতিনের যে দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে তা ইউরোপের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, ‘একজন দুর্বল পুতিন আরও বড় বিপজ্জনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুতিন তার শক্তিশালী একচেটিয়া ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। ওয়াগনার যোদ্ধাদের বিদ্রোহের ফলে পুতিনের সামনে তার ক্ষমতার হুমকিগুলো উন্মোচিত হয়েছে। পুতিন এখন দেশের মধ্যে থাকা তার ক্ষমতার হুমকিগুলোকে পরিষ্কার করবেন এবং আরও দৃঢ়তার ক্ষমতা আকড়ে ধরবেন।’
বোরেল বলেন, ‘ইইউ সদস্য দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থারা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছে, কারণ এখন আমাদের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে রাশিয়াকে ঝুঁকি হিসেবে দেখতে হবে।’
ন্যাটো জোটের সেক্রেটারি জেনারেল জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ‘ওয়াগনারের বিদ্রোহ রাশিয়ায় ফাটল এবং বিভাজন প্রকাশ করেছে। তবে এ ঘটনার ইতি টানার সময় এখনো আসেনি।
স্টলটেনবার্গ বলেন, ‘আমরা গত সপ্তাহের শেষে যে বিদ্রোহ দেখেছি তা প্রমাণ করে, রাশিয়ান ব্যবস্থার মধ্যে ফাটল এবং বিভাজন রয়েছে। একই সাথে এটা উল্লেখ করা জরুরি যে, এগুলো রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়।’
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ বলেছেন, রাশিয়ার সরকার পরিবর্তনের কোনো লক্ষ্য আমাদের নেই।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বৃহস্পতিবারের এই ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভাষণ দিয়েছেন। দুর্বল পুতিনকে আরও অপ্রত্যাশিত এবং বিপজ্জনক বলে যেসব ইইউ নেতা দাবি করেছেন তাদের বক্তব্যের সমালোচনা করেন ভলোদিমির জেলেনস্কি।
জেলেনস্কি তার বক্তব্যে বলেন, আমরা তাদের (রাশিয়ার) দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছি, যা আমাদের জন্য খুব প্রয়োজন।’
জেলেনস্কি বলেন, ‘রাশিয়া যত দুর্বল হবে, এর কর্তারা যত বেশি বিদ্রোহ করবেন এবং বিদ্রোহকে ভয় পাবেন ততই তারা আমাদের ওপর হামলা করতে ভয় পাবে। রাশিয়ার দুর্বলতা অন্যদের জন্য নিরাপদ করে তুলবে এবং রাশিয়ার পরাজয়ের মধ্য দিয়েই এই যুদ্ধের সমাধান করবে।’
পুতিনের সিস্টেমে গভীর ফাটল প্রকাশ
ইইউ নেতারা সম্মত হয়েছেন যে, ওয়াগনারের ঘটনা পুতিনের কর্তৃত্বের ওপর আঘাত করেছে।
রাশিয়ার সীমান্তবর্তী ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ লিথুয়ানিয়ান প্রেসিডেন্ট গিটানাস নৌসেদা জোর দিয়ে বলেছেন, ওয়াগনার বিদ্রোহের ফলে উদ্ভূত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যেই পুতিনের বিরুদ্ধে আরও শক্ত অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল।
তিনি বলেন, ‘একজন শক্তিশালী পুতিন দুর্বল পুতিনের চেয়ে কম বিপজ্জনক’ আমি এই কথার সাথে একমত নই। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে কারণ এখন আমরা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে রয়েছি’।
ওয়াগনারের বিদ্রোহ পুতিনের সিস্টেমের গভীর ফাটল প্রকাশ করে বলে মন্তব্য করে ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন বলেন, ‘গত সপ্তাহান্তের এই বিদ্রোহের আফটারশকও থাকবে যা আমরা সামনে দেখতে পাব।’
বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্র এবং ইইউ কর্মকর্তারা বলেছেন, ওয়াগনার বিদ্রোহের পরে রাশিয়ায় যে বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে তাতে ইইউভুক্ত রাষ্ট্রগুলো শুধু ইউক্রেনের প্রতি তাদের সমর্থন দ্বিগুণ করা এবং প্রতিশ্রুত গোলাবারুদের সাপ্লাই দিলেই হবে না বরং ওয়াগনার বাহিনী রাশিয়া ছেড়ে প্রতিবেশী বেলারুশে স্থানান্তর হওয়ার অনুমতি দেওয়ার পরে লড়াই এবং সহিংসতা যেন ইইউতে ছড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে।
এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী কাজা ক্যালাস বলেছেন, দ্বিধা করার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের অবশ্যই রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
অনেক ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ রয়েছে যারা একই সাথে ন্যাটোর সদস্য। আগামী ১১-১২ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে তারা ইউক্রেনকে আরও বেশি নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিতে চাইবে। দুই দিনের এই শীর্ষ সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই ইউক্রেনকে ন্যাটোর আরও বেশি সমর্থনের সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যেহেতু ওয়াগনার বিদ্রোহের পর পুতিন তার নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাই ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের ডেপুটি কমান্ডার এবং অন্যান্য সিনিয়র রাশিয়ান সামরিক ব্যক্তিত্বের অন্তর্ধানে নিশ্চুপ ক্রেমলিন।
রাশিয়ার নিখোঁজ জেনারেল
জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিন সম্পর্কে জল্পনা বেড়েই চলেছে। ওয়াগনার বাহিনীর বিদ্রোহ থেকে সরে যাওয়ার পর লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছেন তিনি। এরই মধ্যে ওয়াগনার বাহিনীর বিদ্রোহে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে তার ওপর।
জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও দাবি করেছে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম সূত্র। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বৃহস্পতিবার রাশিয়ান বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্সকে বলেছেন, জেনারেল কোথায় রয়েছেন সেটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব বিষয়।
বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক দ্য ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) বলেছে, নিখোঁজ জেনারেল সম্পর্কে প্রশ্নে পেসকভের প্রতিক্রিয়া অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ছিল।
আইএসডব্লিউ মনে করছে, যেহেতু রাশিয়ান কর্মকর্তারা সাধারণত চলমান তদন্তের বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন তাই সম্ভবত জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিন তদন্তের সম্মুখীন হয়েছেন।
আইএসডব্লিউ আরও উল্লেখ করেছে, জেনারেল সুরোভিকিনের সাথে কী ঘটতে পারে তার কোনো স্পষ্ট ধারণা দেননি রুশ কর্মকর্তারা। যেমন রুশ কর্মকর্তারা একবার বলছেন, ওয়াগনারের সাথে যোগসূত্রে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আবার বলছেন, তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
থিঙ্ক ট্যাঙ্কটি বলেছে, ওয়াগনারের সশস্ত্র বিদ্রোহের পর প্রিগোজিনের সাথে সম্পর্কযুক্ত সুরোভিকিন বা অন্য কোনো সামরিক কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করাই রাশিয়ান কর্মকর্তাদের জন্য যুক্তিসঙ্গত হবে।
পুতিন এখনো জেনারেল সুরোভিকিনকে বিশ্বাস করছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে পেসকভ বলেছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং রাশিয়ার শীর্ষ জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভের সাথে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।
যদিও জেনারেল সুরোভিকিনকে প্রিগোজিনের মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় তবে শনিবার মস্কোর দিকে ওয়াগনার বাহিনীর মার্চের সময় তিনি মস্কোতে থাকা শক্তিগুলোর পক্ষে ছিলেন।
প্রিগোজিন বলেছেন, মস্কোতে তার পদক্ষেপ ছিল সিনিয়র সামরিক নেতাদের উৎখাত করা। সরকার পরিবর্তন করার কোনো উদ্দেশ্য তার ছিল না। তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগু এবং জেনারেল গেরাসিমভকে অযোগ্যতার জন্য অভিযুক্ত করে আসছেন এবং ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ান বাহিনীর ব্যর্থতার জন্য তাদের দায়ী করে আসছেন।