আলোচিতরাজনীতি

বিএনপির তালিকায় ‘অতি উৎসাহী’ ৪০৮৭ পুলিশ কর্মকর্তার নাম

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গুম-খুন এবং নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ পুলিশের অতি উৎসাহী কর্মকর্তাদের একটি তালিকা প্রায় চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। এই তালিকায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজারেরও বেশি পুলিশ কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। পুলিশ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত অন্য বাহিনীর কিছু সদস্যের নামও অবশ্য আছে তালিকায়। যেসব পুলিশ কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে, বিএনপি নেতারা বলছে, তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে তারা ভোটে অনিয়ম করে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতারা।

দেশব্যাপী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ‘শান্তিপূর্ণ’ কর্মসূচিতে বাধা প্রদানকারী ব্যক্তিবর্গের তথ্য সংগ্রহ করতে গত ২৩ মে ১৪ সদস্যের একটি ‘তথ্য সংগ্রহ কমিটি’ গঠন করে বিএনপি। এই কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা গায়েবি ও মিথ্যা মামলা, গুম-খুন, সহিংস আক্রমণ, ক্রসফায়ার দেওয়া, অগ্নিসংযোগসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বাধা প্রদানকারী ব্যক্তিবর্গের তথ্যাদি সংগ্রহ করছেন।

শুক্রবার শেষ তথ্য পাওয়া পর্যন্ত ৪ হাজার ৮৭ জনের নামের তালিকা করা হয়েছে। দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিনিধি বা সংস্থা এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্রের দূতাবাস ও হাইকমিশনে এ তালিকা পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে। এ ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তা অনিয়ম ও কারচুপিতে সহায়তা করেছেন, তাদেরও একটি পৃথক তালিকা তৈরি করেছে বিএনপি।

জানা যায়, বিশেষ করে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ওইসব ‘কর্মকাণ্ডে’ জড়িত, তাদের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে গত মে মাসের শেষদিকে দলের ৮২ সাংগঠনিক জেলার সব জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের কাছে চিঠি দেয় বিএনপি। এরই মধ্যে প্রায় সব জেলার নেতারা তাদের রিপোর্ট কেন্দ্রে জমা দিয়েছেন। সেই রিপোর্ট থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় সেল প্রায় ৪ হাজার ৮৭ কর্মকর্তার নামের একটি তালিকা প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করেছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়াও বিভিন্ন সময় গুম-খুন, নিপীড়ন, গায়েবি মামলার সঙ্গে জড়িত পুলিশের ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপিসহ সামরিক, আধাসামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা এবং র‌্যাবের বেশকিছু কর্মকর্তার নামও এসেছে। তার মধ্যে বেশিরভাগ কর্মকর্তা ঢাকা, খুলনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগের। স্থানীয় নেতাদের পাঠানো রিপোর্ট অনুযায়ী এ তালিকা করা হয়েছে।

বিএনপির তথ্য সংগ্রহ কমিটি দাবি করছে, যেসব কর্মকর্তা গুম-খুন, নিপীড়ন, গায়েবি মামলার সঙ্গে জড়িত ও কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে, তাদের নাম তালিকায় উঠে এসেছে। তালিকায় আছেন ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সুপার (এসপি)। তালিকায় এখন পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, রুজুকারী ও তদারকি কর্মকর্তা ৩ হাজার ৮৫০ জন। অবৈধভাবে নির্দেশদাতা পুলিশ সুপার রয়েছেন ১০৮ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ২৯ জন এবং ক্রসফায়ারে সরাসরি অংশগ্রহণকারী এসপি ৯ জন। তারা সবাই বর্তমানে ডিআইজি পদে কর্মরত আছেন। মিথ্যা ও গায়েবি মামলার নির্দেশদাতা মোট ২৭ এসপির মধ্যে ১৪ জন ডিআইজি এবং অতিরিক্ত ডিআইজি ১৩ জন।

বিএনপির তালিকায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালে ছাত্রদল নেতা নূরুজ্জামান জনি হত্যার ঘটনায় ওই সময়ের মহানগর পুলিশের একজন উপকমিশনারসহ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত পুলিশ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। নীলফামারী জেলায় কথিত ক্রসফায়ারের নামে যুবদল নেতাদের হত্যার ঘটনায় জড়িতদের নাম রয়েছে, তেমনি গত বছর মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ভোলায় ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীর ঘটনাও রয়েছে। সেখানে বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করার ছবি এবং ভিডিওকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী মানুষের মৌলিক মানবাধিকার হরণকারীদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া কর্তৃত্ববাদী এবং স্বৈরাচারী সরকারকে সহায়তাদানকারী পুলিশ সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশে জনগণের ট্যাক্সে বেতনধারী কর্মচারীরা সেই জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বিষয়ে দায়ীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করার সময় আসছে। সুতরাং যেসব কর্মকর্তা গুম-খুনসহ বিভিন্ন অন্যায়-অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাদের শাস্তি হওয়া দরকার।

বিএনপির তথ্য সংগ্রহ কমিটির একাধিক সদস্য সংবাদ মাধ্যমকে জানান, গুম, খুন, হামলা, মামলার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণ ইতোমধ্যে বিএনপির হাতে এসেছে। তাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে এবং সেই অভিযোগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাইয়ের পর এ তালিকা করা হয়েছে।

তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এসব কর্মকর্তা তাদের কৃতকর্মের মাধ্যমে সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, দেশের প্রচলিত আইনসহ পৃথিবীর সব আইনেই তারা দোষী। যেসব পুলিশ কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে, তারা সবাই কমবেশি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা দিনের ভোট আগের দিন রাতেই কেটেছেন। কেউ হয়তো নির্দেশ দিয়েছেন কেউবা সরাসরি উপস্থিত থেকে ভোট ডাকাতি করেছেন। তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের অধিকার হরণ ও খর্ব করেছেন।

তথ্য সংগ্রহ কমিটির সদস্য এবং সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা সালাউদ্দিন খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ২২ মে পর্যন্ত বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার সংখ্যা ১ লাখ ১১ হাজার ৫৬৭টি। এই সময়ের মধ্যে উল্লিখিত মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ৮২৬ এবং এখনো কারাগারে আটক আছেন ২০ হাজার নেতাকর্মী। এই সময়ের মধ্যে হত্যার সংখ্যা ১ হাজার ৫৩৭ জন। তার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা বিএনপি নেতাকর্মীর হত্যার সংখ্যা ৭৯৯ জন। একই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দলের মোট গুমের সংখ্যা ১ হাজার ২০৪ জনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজত থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় ৭৮১ জন এবং বিএনপির গুম ছিল ৪২৩ জন। বর্তমানে বিএনপি নেতাকর্মীদের মোট গুম সংখ্যা ৭২ জন। এ ছাড়া ২০২২ সালের ২২ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২২ মে পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা গুরুতর জখম ও আহত হয়েছেন ১ হাজার ৭৯০ জন।

গত ২৪ মে বাংলাদেশের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করাসহ কয়েকটি ইস্যুতে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থায় জালিয়াতি ও অনিয়মের সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে সেই ব্যক্তিকে ভিসা দেবে না ওয়াশিংটন। এই নীতির আওতায় থাকবেন বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য। আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও এর আওতাভুক্ত হবেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রকাশে বাধা দিলেও ভিসা পাবে না জড়িত ব্যক্তি।

সূত্র জানায়, মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী নির্বাচন ও চূড়ান্ত আন্দোলনের রূপরেখা মাথায় রেখেই পুলিশের এসব কর্মকর্তাকে চাপে রাখতে চাইছে বিএনপির হাইকমান্ড। এরই অংশ হিসেবে এই তালিকা করা হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মে নির্দেশদাতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৪৫০ জন ওসি, ৭৩০ এসআই এবং ২২ জন এসপি, ঢাকা মহানগরে ৭৪ জন ওসি, ১৬২ জন এসআই এবং পুলিশ কমিশনার ৩ ও ডিসি ১০ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭৭ জন ওসি, ১৭৩ জন এসআই ১২ জন এসপি, খুলনা বিভাগে ১৫৫ জন ওসি, ২১৭ জন এসআই এবং ১০ জন এসপি, রংপুর বিভাগে ১১৩ জন ওসি, ২০৫ জন এসআই এবং ১০ জন এসপি, বরিশাল বিভাগে ১১৪ জন ওসি, ২১৩ জন এসআই এবং ৫ জন এসপি, চট্টগ্রাম জেলায় ওসি ১৪১ জন, এসআই ২১৬ জন এবং ৭ জন এসপি, চট্টগ্রাম মহানগরে ৪০ জন ওসি, ৯৬ জন এসআই এবং কমিশনার ২ ও ডিসি ৪ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৬৭ জন ওসি, ২১৩ জন এসআই এবং ৯ জন এসপি, রাজশাহী মহানগরে ৩৫ জন ওসি, ৪২ জন এসআই, কমিশনার ২ ও ডিসি ৩ জন, সিলেট বিভাগে ৬০ জন ওসি, ৯৮ জন এসআই এবং ৭ জন এসপি, ফরিদপুর সাংগঠনিক বিভাগে ওসি ৪ জন, এসআই ৭ জন এবং এসপি ২ জন ছিলেন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও তথ্য সংগ্রহ কমিটির প্রধান রুহুল কবির রিজভী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিএনপির শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম বাধাগ্রস্ত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যারা গুম-খুন বা বড় ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।

 

সূত্র: কালবেলা 

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button