অর্থনীতিআলোচিতসারাদেশ

চাকরি ছাড়লেই মামলা দেয় মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপ!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ময়মনসিংহের বাসিন্দা আনিসুজ্জামান। মাত্র সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপে। ২০১৮ সালে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন বিক্রয়কর্মী হিসেবে। তবে গত বছরের নভেম্বর থেকে তার বেতন বন্ধ করে দিলে কোনো উপায় না পেয়ে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন আনিসুজ্জামান।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চাকরিটি ছেড়ে দেন। এর পরই যেন বিপদ ভর করে তার ওপর। প্রতিষ্ঠানটি তার কাছে ১৮ লাখ টাকা পায়, এমন দাবিতে মামলা করা হয় আনিসুজ্জামান এবং তার নমিনির বিরুদ্ধে।

শুধু আনিসুজ্জামানই নন, মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপে চাকরি করে এখন মামলার ঘানি টানছেন এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা কয়েকশ। তাদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন বলেছেন, তাদের জীবনের লোমহর্ষক এক অভিজ্ঞতার কথা।

মাত্র ১২-২২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করা এসব কর্মী মামলা খেয়েছেন ৫ লাখ থেকে ৪ কোটি টাকার। এখন জীবনের সব সঞ্চয়ের বিনিময়েও মুক্তি মিলছে না কোম্পানির জাঁতাকল থেকে। উল্টো মামলার কারণে নতুন কোনো চাকরিতেও ঢুকতে পারছেন না। তিন বেলা খাবার জোগানোটাই এখন কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকের জন্য।

তাদের একজন ইব্রাহিম খলিল। প্রতিষ্ঠানের একটি শোরুমের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন। সব নিয়ম মেনে ইস্তফা দেওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের মামলা ঠুকে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদের মতো ইব্রাহিমকেও আটকানো হয়েছে চাকরিতে যোগদানের শর্ত অনুসারে জমা দেওয়া ব্যাংক চেকের মাধ্যমে। ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে তার বাবাকেও। আনা হয়েছে ১৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ।

ইব্রাহিম খলিল বলেন, আমার বাবা বয়স্ক মানুষ; কিন্তু তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। আমি স্বল্প বেতনে চাকরি করতাম। যে টাকার মামলা দিয়েছে, চাকরিজীবনে তার অর্ধেক টাকাও বেতন হিসেবে পাইনি মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপ থেকে; কিন্তু এখন উল্টো টাকা আত্মসাতের মামলা খেয়েছি। সংসার চালানোই এখন কষ্টকর। সেখানে নতুন করে টাকা পরিশোধ কীভাবে করবো!

তার অভিযোগ, চাকরি ছাড়ার সব শর্ত পূরণ করেছি। সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। এরপরও আমাদের মতো নিম্নস্তরের কর্মচারীদের সঙ্গে এমন জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমিও আইনের আশ্রয় নিয়েছি। কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং এমডিসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। আশা করছি, আইনের মাধ্যমেই সুবিচার পাবো।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপ যে কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে, তাদের প্রায় সবাই নিম্নস্তরের কর্মচারী ছিলেন। ১০ থেকে ২২ হাজার টাকার মধ্যে বেতন পেতেন তারা সবাই।

নিয়োগের সময় শর্ত অনুসারে, নিয়োগপ্রাপ্ত ও একজন নমিনির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চেকের একটি করে পাতা জামানত হিসেবে প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়ার বিধান রয়েছে। চাকরি ছাড়ার পর সেই চেকের সূত্র ধরেই প্রত্যেকের ঠিকানায় নোটিশ পাঠানো হয় টাকা দেওয়ার জন্য। আর কয়েক দফা নোটিশ দেওয়ার পরে করা হয় মামলা।

২০০২ সালে ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসা শুরুর মাধ্যমে যাত্রা শুরু মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপের। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক খান রাজ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলরুবা তনু। টেলিভিশন, ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনারসহ নানা ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ডিলারের মাধ্যমে সারা দেশে পাইকারি এবং খুচরা উপায়ে সেই পণ্য বিক্রি করা হয়। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি নাম লিখিয়েছে ই-কমার্স ব্যবসাতেও। তাদের ই-কমার্স সাইটের নাম ই-রাজ।

এ গ্রুপের প্রতারণার শিকার আরেকজন সোনা মিয়া। মাত্র ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরিতে ঢুকেছিলেন মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপে। সর্বশেষ কোম্পানির একটি শোরুমের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাতের।

তিনি বলেন, ‘চার বছর চাকরি করে সর্বসাকল্যে ৫ লাখ টাকাও বেতন পাইনি; কিন্তু এখন মামলা দিয়েছে ৪৫ লাখ টাকার। চাকরিতে ঢোকার সময় আমার এবং নমিনি হিসেবে শ্বশুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চেক জমা দিয়েছিলাম। শ্বশুরের বিরুদ্ধেও ২১ লাখ টাকার মামলা দিয়েছে। আমিও আইনের আশ্রয় নিয়েছি। কোম্পানির চেয়ারম্যান, এমডিসহ প্রতারণার সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি।’

শিক্ষাজীবন শেষে ২০১৫ সালে মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন রায়হান রাবু। প্রথম দিকে স্বল্প বেতন পেলেও একসময় তার বেতন দাঁড়ায় ২২ হাজারে। এর পরই কোম্পানি বেতন দিতে নানা টালবাহানা শুরু করে। ২০২১ সালে চাকরি ছাড়ার আগে প্রায় দেড় বছর বেতনই পাননি রায়হান। অবশেষে বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়লে কোম্পানির পক্ষ থেকে তার নামে করা হয় ৪ কোটি টাকা পাওনার মামলা।

রায়হান রাবু বলেন, ‘চাকরিতে যোগদানের সময় আমার এবং নমিনি হিসেবে স্ত্রীর অ্যাকাউন্টের চেক বই দেই। এখন সেগুলো আমার জীবনে দুঃস্বপ্ন হয়ে এসেছে। দুজনের নামে ৪ কোটি টাকার মামলা। এত টাকার মামলা নিয়ে অন্য কোনো কাজও ঠিকমতো করতে পারছি না। মাঝেমধ্যে হাজিরা দিতে যেতে হয়। জামিন নিতে হয়। এসব থেকে মুক্তি চাই। এভাবে চলা যায় না। কোম্পানি থেকে চাকরি ছেড়ে দেওয়া শত শত কর্মচারীর বিরুদ্ধে এমন মামলা করা হয়েছে।’

মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপের প্রতারণার শিকার এমন অনেকেই রয়েছেন। আরেকজন ভুক্তভোগী প্রবীর বসাক বলেন, মামলা খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। অথচ অল্প বেতনে চাকরি করতাম। সারা দেশে শত শত অসহায় কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপ। আমরা সরকারের কাছে সুবিচার প্রার্থনা করছি।

এ প্রসঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, শ্রমিকদের সঙ্গে এ ধরনের অবিচার রোধে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। শ্রমিকদেরও সংগঠিত হতে হবে। যদিও মালিকপক্ষ চায় না, শ্রমিকরা সংগঠিত হোক। এর পরও প্রতিটি কোম্পানিতে ইউনিয়ন তৈরি করতে হবে। সংঘবদ্ধভাবে দাবি-দাওয়া জানালে দ্রুত পূরণ করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।

তিনি বলেন, লেবার কোর্টের আশ্রয় নেওয়া উচিত কর্মীদের। প্রয়োজনে রাষ্ট্রের নজরে আনতে আন্দোলনেও যেতে হবে। সবাই সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী হলে মালিকপক্ষ এ ধরনের অবিচার থেকে সরে আসবে বলেও মত দেন তিনি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক খান রাজের মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

তবে গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মুশফিকুর রহমান বলেন, এমন কোনো ঘটনা নেই, যারা দুর্নীতিবাজ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সব কোম্পানিই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। আমরাও তাই করছি। আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। এসব কর্মচারী অনেক টাকার মালপত্র শোরুম থেকে নিয়ে গেছে। টাকা দেয়নি।

তিনি বলেন, আমরা কোনো কর্মচারী যখন চামকরিতে যোগদান করে, তখন ব্যাংকের চেক নিই না। চেক নেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। তবে ডিলারদের থেকে আমরা আর্থিক নিরাপত্তার জন্য ব্যাংক চেক নিই। গ্যারান্টার নিই।

 

সূত্র: কালবেলা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button