”জনপ্রিয়তার কারণে’ই আওয়ামী লীগের” আমাকে প্রয়োজন: জাহাঙ্গীর আলম
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেড় বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া গাজীপুরের নেতা জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, তার ‘জনপ্রিয়তার কারণে’ই আওয়ামী লীগেরই তাকে দরকার।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজে প্রার্থী হতে না পারার পর মাকে নিয়ে নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়ানো সাবেক মেয়র এটাও বলেছেন যে, তিনি তার মাকে ‘ফেলে দিতে পারবেন না’।
১৩ মাসের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের পর চলতি বছরের জানুয়ারিতেই দলে ফিরেছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০১৮ সালে নৌকা নিয়ে জেতা জাহাঙ্গীর।
সাড়ে চার মাস বাদে ফের এল বহিষ্কারাদেশ, গাজীপুরে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে প্রচারে নামার পর। তার আগের দিনই আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ দলের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে পাঠান হয়।
সোমবার (১৫ মে) সন্ধ্যায় দলের সিদ্ধান্ত আসার আগে সংবাদ মাধ্যমকে সঙ্গে কথা হয় জাহাঙ্গীরের। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে ততক্ষণে তার বহিষ্কৃত হওয়ার খবর চলে এসেছিল।
জাহাঙ্গীর সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তিনি দলের ব্যবস্থা নিয়ে ভীত নন। আওয়ামী লীগেরও ‘আমাকে প্রয়োজন আছে’।
কেন প্রয়োজন- সেই ব্যাখ্যায় বলেন, “আপনি এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঘুরে দেখেন আমার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে; কতভাগ মানুষ আমাকে পছন্দ করে; শতকরা ৭০ ভাগ ভোটার আমাকে পছন্দ করে। আপনি গিয়ে দেখেন, ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে দেখেন।
“আমি আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক হিসেবে আছি, আমি মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করি। আমি আওয়ামী লীগকে বাদ দিতে পারব না। আমার সমর্থনের কারণে, আমার ব্যক্তি ইমেজের কারণে আওয়ামী লীগেরও আমাকে প্রয়োজন আছে।”
আপনাকে তো আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নে তিনি দেন ভাবলেশহীন জবাব; বলেন, “নেত্রী যেটা ভালো মনে করবেন, সেটাই করবেন।”
বহিষ্কারাদেশ আসার পর জাহাঙ্গীরের ফেইসবুক পাতায় এক পোস্টে লেখা হয়েছে, “আজীবন-চির জীবন, স্থায়ী-অস্থায়ী এসব কিছু না। সামনে জাতীয় নির্বাচন, ভোটের রাজনীতিতে জাহাঙ্গীর আলম চিরস্থায়ী, যার প্রমাণ দেশবাসী ২৫ মে পাবে ইনশাআল্লাহ। শেখ হাসিনার চারাগাছ ঝড় বৃষ্টিতে ভাঙবে না, ষড়যন্ত্রে কাজ হবে না।”
জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যে আবার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে, সেটি আগেই জানিয়েছিলেন দলটির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম।
গত ৪ মে গাজীপুর গিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের এক বৈঠকে তিনি বলেন, “জাহাঙ্গীর আলম দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার পরও শেখ হাসিনা তাকে একবার সাধারণ ক্ষমা করেছেন। ক্ষমা চেয়ে আবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, বাকি জীবনে আওয়ামী লীগের শৃঙ্খলা পরিপন্থি কোনো কাজ করবেন না। সেটির ব্যত্যয় ঘটিয়ে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। ফের দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, এ অপরাধ জাহাঙ্গীর আলমকে শাস্তি পেতেই হবে।”
রোববার আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় জাহাঙ্গীরকে ‘কঠোর শাস্তির’ আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়। তারা চায়, এমন ব্যবস্থা নেওয়া হোক, যেন আর ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ না হয়। এর ২৪ ঘণ্টা পরই এল স্থায়ী বহিষ্কারের আদেশ।
‘মাকে বাদ দিতে পারি না’
আগামী ২৫ মের ভোটে মা জায়েদা খাতুনকে জেতাতে মরিয়া জাহাঙ্গীর। দল থেকে ছিটকে পড়ার ঝুঁকির মধ্যেই সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, “আমার মা সম্মানের জায়গায়, ৭০ বছরের একজন মহিলা, সারা দিন ভোট করছেন। ছেলে হিসেবে আমি তার পাশে আছি। আমি তো আমার মাকে বাদ দিতে পারি না।”
জাহাঙ্গীর এই কথাগুলো বলেছিলেন বহিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার আগে। আওয়ামী লীগের বিজ্ঞপ্তি আসার পর তার ফোনে কল করলে অন্য একজন তা ধরে বলেন, “ভাই এখন প্রচারে রয়েছেন।”
এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকা প্রতীকের আজমতের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা জাহাঙ্গীরের মায়ের প্রতীক ঘড়ি।
জাহাঙ্গীর আলোচনায় বারবার
এবার মিলিয়ে গাজীপুর সিটির যে তিনটি নির্বাচন, তার প্রতিটিতেই জাহাঙ্গীর আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠেছেন।
১০ বছর প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মেয়র পদে সমর্থন দিয়েছিল আজমত উল্লা খানকে। সে সময়ের তরুণ নেতা, ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি জাহাঙ্গীর তখন দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মনোনয়নপত্র জমা দেন।
দলের নির্দেশে ভোট থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি না হওয়ার পর নিখোঁজ হন তিনি। ভোটের আগে আগে গাজীপুরে ফিরে কাঁদতে কাঁদতে আজমতকে সমর্থন জানান তিনি। তবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যালটে তার নাম থেকে যায়।
গাজীপুরে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও সেই নির্বাচনে আজমত হারেন এক লাখ ৬ হাজার ৫৭৭ ভোটে।
সেই নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের সমর্থক নেতা-কর্মীদের আজমত উল্লাহর পক্ষে নামতে দেখা যায়নি। এটা তখন নৌকার পরাজয়ে ভূমিকা রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর ভোটের পরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাছাইয়ে ‘ভুল’ করেছে।
২০১৮ সালে জাহাঙ্গীর নৌকা পেয়ে বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে হারিয়ে দেন ২ লাখ দুই হাজার ৩৯৯ ভোটে।
মেয়র হওয়ার পর থেকে রাজধানী লাগোয়া এই জনপদে জাহাঙ্গীরের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছিল।
তবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগের একটি অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে মেয়রের দলীয় সদস্যপদ কেড়ে নেয় আওয়ামী লীগ। তারপর বরখাস্ত হন মেয়র পদ থেকেও।
ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থি কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে গত ১ জানুয়ারি তাকে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ।
সেই ‘ক্ষমা’র শর্ত ভঙ্গ করে চার মাস যেতে না যেতেই দলের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বসেন জাহাঙ্গীর। মনোনয়নপত্র দাখিলের পর তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তাকে গুম করাও হতে পারে।
মনোনয়নপত্র জমা দিলেও তা টেকা নিয়ে সংশয় ছিল জাহাঙ্গীরের। যে কারণে মা জায়েদা খাতুনের নামে জমা দেন আরও একটি মনোনয়নপত্র। একটি পোশাক কারখানার শত কোটি টাকার খেলাপি ঋণের জামিনদার হওয়ায় প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর এখন মায়ের নির্বাচনে আঁটঘাঁট বেঁধে নেমেছেন তিনি।
সারা জীবন ঘর সামলানো জায়েদা রাজনীতি নিয়ে কখনও মাথা ঘামাননি। তবে এখন দিনভর ছেলেকে নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনী এলাকা।
সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর