গাজীপুরসিটি কর্পোরেশন

অন্যের ‘জামিনদার’ হয়ে ঋণখেলাপি জাহাঙ্গীর, তাই মনোনয়ন বাতিল

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে ‘খেলাপি ঋণের’ কারণ দেখিয়ে মেয়র পদে জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে, সেটি তার নামে ছিল না।

গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার ‘নিউটাউন নিটওয়্যার’ নামে একটি কোম্পানি অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকা ওয়াসা শাখা থেকে ঋণটি নিয়েছিল। এই কোম্পানিতে জাহাঙ্গীরের মালিকানা নেই। তবে তিনি মেয়র পদ থাকার সময় সেই ঋণের জামিনদার হয়েছিলেন।

আগামী ২৫ মের ভোটে দাঁড়াতে নিজের দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি জাহাঙ্গীর। ২০১৮ সালে নৌকা নিয়ে জয় পাওয়া এই রাজনীতিক তাই ‘স্বতন্ত্র’ হিসেবে জমা দিয়েছেন মনোনয়নপত্র।

কিন্তু রোববার (৩০ এপ্রিল) মনোনয়ন যাচাই বাছাইয়ে বাতিল হয়ে গেছে তার প্রার্থিতা।

মনোনয়ন যাচাই বাছাই শেষে রির্টানিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, “উনি (জাহাঙ্গীর) একজন ঋণখেলাপি হিসেবে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। উনি একজন জামিনদাতা হিসেবে ঋণখেলাপি।”

গতবারের বিজয়ী মেয়রের অভিযোগ, তার মনোনয়নপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত ‘পক্ষপাতমূলক’। তিনি দাবি করেছেন, নিউটাউন নিটওয়্যার খেলাপি নয়। ঋণের বকেয়া টাকা জমা দেওয়া হয়েছে আগেই। তিনি কাজগপত্র জমাও দিয়েছেন। যাচাই বাছাইয়ের সময় উপস্থিত ব্যাংক কর্মকর্তারাও বিষয়টি জানিয়েছেন। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবিতে জাহাঙ্গীরকে খেলাপি হিসেবে দেখানো আছে।

জাহাঙ্গীর বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর সময় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করতে ‘মানবিক কারণে’ তার নিজের সম্পদ বন্ধক রেখে ওই কোম্পানিটিকে ঋণ পাইয়ে দেন। সেই ঋণের জামিনদারও ছিলেন তিনি।

রিটার্নিং কর্মকর্তা বলছেন, সিআইবি থেকে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ তার নেই।

আর জাহাঙ্গীর বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চ আদালতে যাবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি যেতে পারেন।

সেই ঋণের বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে

রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকেই সেই ঋণ নিয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। করোনাভাইরাস মহামারীর আগে ২০১৯ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মধ্যে কোনাবাড়িতে কোরিয়ান মালিকানাধীন নিউটাউন নিটওয়্যার কম্পোজিট কারখানায় বেতন ভাতা পরিশোধ নিয়ে ঝামেলা হচ্ছিল। সে সময় কারখানার শ্রুমিকরা বিক্ষোভ করতে থাকে। ২০২০ সালে তখন কর্তৃপক্ষ অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। সেই ঋণের জিম্মাদার হন জাহাঙ্গীর, যিনি সে সময় মেয়রের চেয়ারে ছিলেন।

তবে কত টাকা ঋণ ছিল, এর কত কিস্তি বকেয়া, এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি।

জাহাঙ্গীর বলেন, “ওই কোম্পানির মধ্যে আমার কোনো শেয়ার নেই, কোনো লভ্যাংশও নেই না। তবুও হাজার হাজার শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, তথা তাদের বাঁচানোর জন্য মানবিক কারণে আমার নিজের সম্পদ তাদের দিয়েছি। ওই সম্পত্তি ব্যাংকে মর্টগেজ দিয়ে সেই কোরিয়ান মালিক লোন নিয়ে কারখানাটি চলমান রেখেছেন। সেই ঋণে আমাকে জামিনদার করা হয়। করোনা মহামারীর কারণে ইতোপূর্বে কোরিয়ান মালিক ব্যাংকে যথাসময়ে ওই পেমেন্ট দিতে পারেনি।”

তবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগেই বকেয়া টাকা জমা পড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, কাজেই তাকে খেলাপি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।

জাহাঙ্গীর বলেন, “আমি প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর গত ১১ ও ১৮ এপ্রিল কোরিয়ানরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের যে পাওনা ছিল, তা পরিশোধ করেছে। কোরিয়ান কোম্পনি অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা টাকা পরিশোধ করেছে। সেই সমস্ত কাগজপত্র আইনজীবী এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয়েছে।”

যাচাই বাছাইয়ের সময় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ব্যাংক কর্মকর্তারাও ঋণ পরিশোধেদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা জানান, ওই কোরিয়ান মালিকের পক্ষে ঋণটি নিয়েছিলেন আব্দুর রহিম।

‘অবিচার করা হয়েছে, উচ্চ আদালতে যাব’

রিটার্নিং কর্মকর্তার উদ্দেশে জাহাঙ্গীর বলেন, “আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে, পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। ব্যাংকের পাওনার কিস্তি জমা দেয়ার কথা কর্তৃপক্ষ লিখিত ও মৌখিক জবানবন্দিতে দিয়েছে। তারপরও আপনারা যে কাজটি করলেন তাতে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। আপনারা নিরপেক্ষতার মধ্যে ছিলেন না।”

এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথাও জানান তিনি। বলেন, “কোনো অদৃশ্যের চাপে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা থেকে সরে গেছেন কিনা জানি না। তবে আমি ন্যায় বিচার পেতে আপিল করব। প্রয়োজনে আমি হাইকোর্টে, সুপ্রিমকোর্ট যাব। আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যেতে চাই।”

‘কিছুই করার নেই, তিনি আপিল করতে পারবেন’

জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র বাতিলের বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তার ফোকাল পয়েন্ট (সহায়ক) কর্মকর্তা মঞ্জুর হোসেন খান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি শাখা ২৯ এপ্রিল এ জাহাঙ্গীর আলমের ঋণ খেলাপি সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছে।

আর রিটার্নিং কর্মকতা মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, “মনোনয়ন সঠিকভাবে যাচাইবাছাই করেছি। জাহাঙ্গীর আলমের অন্যসব কাগজপত্র সঠিক আছে। তবে এর স্বপক্ষে জাহাঙ্গীর আলম ব্যাংকে টাকা জমা করার কিছু কাগজপত্র আমাদের কাছে দিয়েছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে তা যথার্থ ছিল না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি তথ্যে ঋণের ত্রুটি থাকায় তার মনোনয়নপত্রটি বাতিল করা হয়েছে।

“তবে প্রার্থীর আপিল করার সুযোগ রয়েছে। তাই তিনি আপিল করতে পারবেন।”

তিনটি নির্বাচনেই আলোচনার কেন্দ্রে জাহাঙ্গীর

গাজীপুর সিটির তিনটি নির্বাচনেই স্পটলাইট জাহাঙ্গীরের দিকে। ২০১৩ সালে দলের সমর্থন না পেয়েও প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি।

তার নাম আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে, যখন তিনি সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আজমত উল্লার বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন।

দলের নির্দেশেও ভোট থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি না হওয়ার পর সেবার নিখোঁজ হয়েছিলেন তিনি। ভোটের ঠিক আগে আগে গাজীপুরে ফিরে কাঁদতে কাঁদতে আজমতকে সমর্থন জানান তিনি। তবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যালটে তার নাম থেকে যায়।

গাজীপুরে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও সেই নির্বাচনে আজমত হারেন ১ লাখ ৬ হাজার ৫৭৭ ভোটে। জাহাঙ্গীর তখন বলেছিলেন, প্রার্থী নির্বাচনে ভুল করেছে তার দল।

পাঁচ বছর পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাহাঙ্গীরকে দলীয় প্রতীক নৌকা দেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে ২ লাখ দুই হাজার ৩৯৯ ভোটে হারিয়ে দেন তিনি।

সেই নির্বাচনের পর থেকে রাজধানী লাগোয়া এই জনপদে জাহাঙ্গীরের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছিল। তবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগের একটি অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে মেয়রের দলীয় সদস্যপদ কেড়ে নেয় আওয়ামী লীগ। তারপর বরখাস্ত হন মেয়র পদ থেকেও।

ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে গত ১ জানুয়ারি তাকে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ।

এই চিঠি পাওয়ার পর চার মাস যেতে না যেতেই জাহাঙ্গীর ফের দলের সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে প্রার্থী হলেন। ২০১৩ সালের নির্বাচন পূর্ব পরিস্থিতি ফিরে আসার পর তিনি বলেছেন, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রার্থী হননি। তাকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ ‘অন্যায়’ ছিল। তার প্রতিবাদে তার এই অবস্থান।

গত বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় দেড় বছর আগে সমায়িক বরখাস্তের চিঠি পাওয়া মেয়র বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, ষড়যন্ত্র না হলে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হবে না।

 

সূত্র: বিডিনিউজ

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button