বাস্তব পদক্ষেপ নেই, নামেই জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, বুড়িগঙ্গাসহ অংসখ্য নদী বাংলাদেশের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে। তবে দখল আর দূষণে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংকুচিত হয়েছে বহু নদী। কোনোটি আবার মরেও গেছে। কোথাও কোথাও মানচিত্রে নদী থাকলেও, এখন সেখানে শহর বা গ্রাম গড়ে উঠেছে। মরণ দশা থেকে নদীকে বাঁচাতে চার বছর আগে সরকার গঠন করে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। কিন্তু চার বছর পরে এসে নদীরক্ষায় এই কমিশন ও সরকারের কাজের বিষয়ে অনুসন্ধানে হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ’র (বিআইডিব্লিটিএ) কর্মকর্তারা বলছেন, উল্লেখযোগ্য কোনও সুপারিশ এখনও করেনি জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন, যা নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। কমিশন যেসব প্রতিবেদন দিয়েছে তা মূলত বিভিন্ন নদী পরিদর্শনের। সুনির্দিষ্টভাবে কোনও নদী দখল-দূষণ রোধে কী কী করণীয়, সেই চিত্র সেখানে ফুটে ওঠেনি।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, মূলত কমিশন বিভিন্ন নদী পরিদর্শন করছে। পরিদর্শনের পর কমিশন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে কখনও কখনও প্রতিবেদন জমা দিয়ে থাকে।
বিআইডব্লিউটিএ’র একজন কর্মকর্তাও বলেন, কমিশন অনেকটা সভা-সেমিনার নিয়েই ব্যস্ত থাকে। বিআইডব্লিউটিএ’র কাছে কমিশন এখনও কোনও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেনি।
সারাদেশের নৌপথ রক্ষার দায় বিআইডব্লিউটিএ’র। সাধারণত নদীরক্ষায় যতটুকু কাজ হয় তা বিআইডব্লিউটিএ’র করে থাকে। এর বাইরে অন্যরা সামান্য কিছু কাজ করে।
কমিশন কী কাজ করছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘নদীরক্ষা কমিশন অনেক কাজ করছে। কিন্তু সেইভাবে কিছুই দৃশ্যমান না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছি। এখন মানুষ জানে নদী দখল-দূষণ নিয়ে অভিযোগ করার একটা জায়গা আছে।’ কোন কোন নদীর বিষয়ে কমিশন কী কী সুপারিশ করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন সুপারিশগুলো প্রস্তত করছি।’
নদীগুলো রক্ষায় ২০১৪ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু চার বছর পর কমিশনের হালচালের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেছে, কাজ করছেন মাত্র ১০ জন মানুষ। কমিশনের কাজের পরিধি, অর্জন আর জনবল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কমিশন সূত্র জানায়, সারাদেশের বিভাগ বা জেলায় কোথাও নদীরক্ষা কমিশনের কোনও শাখা নেই। রাজধানী ঢাকায় বসেই কি নদীরক্ষা সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করে কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তাদেরও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে। তাদের ১০টি কাজ থাকলে আমাদের কাজটি ১০ নম্বরে রাখেন। অর্থাৎ তারা অন্য নয়টি কাজ শেষ করে সময় পেলে আমাদের কাজটি করেন।’
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন আইনে কমিশনকে কেবল সুপারিশ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ নদীরক্ষায় সরকার কী করবে সে বিষয়ে শুধু কমিশন সুপারিশ করবে। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা বা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার কমিশনকে দেওয়া হয়নি।
নদী বিশেষজ্ঞ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ‘কমিশন কখনও কাজ করতে পারবে না। কারণ, যে আইনের মাধ্যমে তারা কাজগুলো করে তাতে তারা কোনও সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। তারা শুধু পরামর্শ দিতে পারে। আইনের মাধ্যমে তাদের পঙ্গু করে রাখা হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কজের মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলার নদী পরিদর্শনের বাইরে কিছু সভাসমাবেশ করেছে কমিশন। নদীরক্ষায় অর্থবহ কোনও ভূমিকা চার বছরেও রাখতে পারেনি তারা। আইনি দুর্বলতার কথা তুলে ধরে কেউ কেউ বলছেন— কমিশনের কাজ করার ক্ষমতা সীমিত। এই সীমিত ক্ষমতা দিয়ে নদ-নদী রক্ষা সম্ভব নয়।
নদী কমিশনের সাধারণ সম্পাদক ড. আব্দুল মতিন বলেন, ‘নদী কমিশন গত চার বছরে কিছুই করতে পারেনি। প্রস্তুতই তো হয়নি। নিজস্ব অফিস নেই, জনবল নেই, বাজেট কম, কাজ কীভাবে হবে।’ তিনি বলেন, ‘নদী কমিশন যদি অ্যাক্টিভ হয় তাহলে অনেক কাজ হয়। কমিশন নানা পন্থায় এখন তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। কিন্তু যতই তথ্য সংগ্রহ করুক না কেন, কমিশনের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা নেই। অন্য ক্ষেত্রে কমিশনগুলো সব সময় শক্তিশালী করে গঠন করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নদী কমিশনের কাজ— নদীর পরিস্থিতি দেখবে, এরপর তা ডিসিকে বলবে, প্রশাসন অ্যাকশন নেবে। কমিশন কোনও অ্যাকশন নিতে পারবে না। নদী কমিশনকে সরকার ইচ্ছা করেই দুর্বল করে রাখছে।’
সূত্র:বাংলা ট্রিবিউন