
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : স্বাস্থ্যসেবায় গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে গেলেও এখানে সবার জন্য সেবা নিশ্চিত করা যায়নি। এর পেছনে বড় বাধা চিকিৎসাব্যয়। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা যায়, বছরে প্রায় তিন কোটি মানুষ প্রয়োজন হলেও চিকিৎসা নিতে পারছে না। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, গ্রাম ও শহরাঞ্চলের সরকারি হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে এখনও ৬০ শতাংশ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা যায়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ধারণাপত্র অনুযায়ী, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির ওপর স্বাস্থ্যব্যয়ের চাপ কমাতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে উল্টো। ব্যক্তির স্বাস্থ্যব্যয় দিন দিন বাড়ছে আর সরকারের ব্যয় কমছে। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ, পথ্য সরবরাহ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। বেসরকারি হাসপাতালে উচ্চ চিকিৎসাব্যয়ের কারণে সেবা নিতে পারছে না সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালে জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের বিনামূল্যে চিকিৎসাপ্রাপ্তিতে নানামুখী সংকট রয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, গ্রামাঞ্চলে থাকা কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব-সেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতাল এবং নগরাঞ্চলে থাকা নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নগর প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ডেলিভারি সার্ভিসেস প্রজেক্ট এবং মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সরকারিভাবে মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। বাকি প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষকে এখনও সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এ কারণে মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ স্বাস্থ্য সুরক্ষার বাইরে রয়েছে।
বাংলাদেশে এ অবস্থার মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য।’ দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সরকারি কার্যক্রমের সমালোচনা করে বলেছেন, দরিদ্র থেকে বিত্তবান সব শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য ন্যূনতম মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অন্যথায় ব্যক্তির ব্যয় প্রতিবছর বাড়বে।
চিকিৎসাব্যয়ের উল্টো যাত্রা
ডব্লিউএইচও বলছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির ওপর স্বাস্থ্যব্যয়ের চাপ কমাতে হবে। এ চাপ কমাতে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ২০১২-২০৩২ সাল মেয়াদি একটি কৌশলপত্র তৈরি করে। ওই কৌশলপত্র অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির ব্যয় কমে ২০৩২ সালে হবে ৩২ শতাংশ। যখন ওই কৌশলপত্র করা হয়, তখন ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬৪ শতাংশ। কিন্তু সে ব্যয় আর না কমে বরং বেড়েছে। ২০১৫ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৬৪ থেকে বেড়ে ৬৭ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায়। পরবর্তী দুই বছর ২০২১ ও ২০২২ সালের হিসাব এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা বলছে, ব্যক্তির সিংহভাগ অর্থ ব্যয় হয় ওষুধের পেছনে। মোট টাকার ৬৪ শতাংশ ব্যয় হয় ওষুধ কিনতে। দ্বিতীয় বড় খাত হাসপাতাল। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে ব্যয় হয় ১২ শতাংশ। হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে সেবা নিতে ১১ শতাংশ ব্যয় হয়। অন্যদিকে ৮ শতাংশ ব্যয় হয় শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনে। বাকি ৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত পেশাজীবীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পেছনে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. এনামুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ব্যক্তির স্বাস্থ্যব্যয় প্রত্যাশা অনুযায়ী কমানো যায়নি। তবে বৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী ধারা আটকে রাখা সম্ভব হয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও পরবর্তী পাঁচ বছর দেড় শতাংশ বেড়েছে। তবে গত দুই বছরের হিসাব এখনও করা হয়নি। এটি সম্পন্ন হলে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে।
তিন কোটি মানুষ চিকিৎসাই নেয় না
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন। তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছেন এবং প্রতিবছর অসুস্থতার কারণে ৬৪ লাখ দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা যায়, চিকিৎসাব্যয় মেটাতে গিয়ে বছরে ৮৬ লাখের বেশি মানুষের আর্থিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে দেশের ১৬ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছে না। এ হিসাবে প্রায় তিন কোটি মানুষ প্রয়োজন হলেও চিকিৎসা নিচ্ছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, টাকার অঙ্কে বড় হলেও প্রতিবছর বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে। তবে করোনা মহামারির কারণে বাজেটে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো হলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ের নয়। ব্যক্তির ব্যয় কমাতে হলে স্বাস্থ্য, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে। অন্যথায় প্রত্যাশিত ফল মিলবে না বলে মনে করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, দেশের সব মানুষকে বিনামূল্যের স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা সম্ভব নয়। বিত্তবানরা অর্থ ব্যয় করে যেকোনো জায়গায় চিকিৎসা নিতে পারেন। কিন্তু যাদের টাকা নেই, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ টাকার অভাবে যেন চিকিৎসাবঞ্চিত না হয়, সেদিকে সরকার নজর দিচ্ছে।
এদিকে দিবসটি উপলক্ষে কেন্দ্রীয়ভাবে পরবর্তী সময়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। তবে বিভাগ ও জেলা সদর হাসপাতাল এবং বিভিন্ন সংগঠন আলোচনা সভা, সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করবে।
সূত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ