খেজুরের ইতিহাস ছয় হাজার বছরের

আহমেদ দীন রুমি : তখনো কিছুই সৃষ্টি হয়নি। কেবল বিশৃঙ্খল পানি। প্রধান দেবতা এলেদুমারে বসবাস করেন আকাশে। তার কাছ থেকেই পৃথিবী তৈরির অনুমতি নেন ওবাতালা। সমস্ত দেবতাদের থেকে স্বর্ণ সংগ্রহ করে তৈরি করেন লম্বা রশি। তারপর বেয়ে অবতরণ করলেন নিচে। বপন করলেন সঙ্গে নিয়ে আসা একটা খেজুরের বীজ। বিস্ময়কর দ্রুততার সঙ্গে অঙ্কুরিত হলো বীজটি। রূপান্তরিত হলো পরিণত গাছে। থোকায় থোকায় ধরতে লাগল খেজুর। তার বীজ আবার মাটিতে পড়ে জন্ম দিল নতুন গাছের। পৃথিবী হয়ে উঠল আবাদযোগ্য। নেহাত গল্প মনে হতে পারে একে। তবে নাইজেরিয়ার ইয়োরুবা জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে সৃষ্টিতত্ত্ব হিসেবে। খেজুর সেখানে শুধু স্বর্গীয় খাদ্য না, পৃথিবীতে জন্মানো প্রথম গাছও। খেজুর নিয়ে বিস্ময়বোধে ইয়োরুবা নতুন না। পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির বিশ্বাসীরা মুগ্ধতা দেখিয়েছে খেজুরের প্রতি। খেজুর গাছে খুঁজে পেয়েছে গভীর কোনো অর্থবাচকতা। সভ্যতার সঙ্গে খেজুরের জড়িয়ে থাকার এ আখ্যান ছয় হাজার বছরের। আখ্যানের একদিকে যেমন অদ্ভুত সৌন্দর্যে ঘেরা, অন্যদিকে তেমনভাবেই পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য নিয়ে।
মানুষ আর খেজুর প্রথম কবে মুখোমুখি হয়, তা অজানা। তবে বিদ্যমান দলিলে খেজুর চাষের প্রথম নজির খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর আগের। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের তীরে তখন সমৃদ্ধ সভ্যতা। উর ছিল তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রভূমি। সুমেরিয় নামে পরিচিত সে সভ্যতায় খেজুরই ছিল অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। খেজুরের প্রভাব জড়িয়ে ছিল পার্থিব ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলে। চন্দ্রদেবতার মন্দির নির্মিত হয়েছিল খেজুরের ডালে। খেজুর পরিগণিত হয়েছে উর্বরতার প্রতীকে। খেজুরের ব্যবহার কতটা বহুমাত্রিক তার প্রমাণ সুমেরীয় শব্দভাণ্ডার। খেজুরের বিভিন্ন ধরন ও বিভিন্ন অংশ নিয়ে সেখানে অন্তত ১৫০ শব্দ পাওয়া যায়। সুমেরীয় পুরাণে খেজুরকে বলা হয় পৃথিবীতে বপন করা প্রথম গাছ। দেবতা এনকির মাধ্যমে খেজুর গাছের জন্ম। তাকে সহযোগিতা করেছেন দেবী ইনানা ও একটা কাক। খেজুরের এ প্রভাব পরবর্তী আক্কাদীয় সভ্যতায় গিয়ে বেড়েছে বৈ কমেনি। আক্কাদীয় সিলিন্ডারে উর্বরতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে খেজুর গাছ দৃশ্যমান। সিলিন্ডারে জনৈক উপাসককে নতজানু অবস্থায় দেবতার সামনে দেখা যায়। যেন ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করছেন। পেছনেই স্পষ্ট খেজুর গাছ। খেজুর যেন ঈশ্বরের পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য দেয়া উপহার। ফলে তাদের ধর্মীয় উৎসবে থাকত খেজুরের সরব উপস্থিতি। থাকত সম্পত্তি ও সন্তান অপশক্তির হাত থেকে রক্ষার আচারে। খেজুর গাছের প্রতিটা অংশই ব্যবহার উপযোগী। ফলে খেজুর গাছ কাটা ছিল সে সময় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ব্যাবিলনীয় সম্রাট হাম্মুরাবির আইনসংহিতার ঘোষণাটি এক্ষেত্রে বিবেচ্য। বলা হয়েছে ‘যদি কোনো জমির মালিক অন্য কারো জমির গাছ কেটে ফেলে, তাহলে জরিমানা গুনতে হবে’। পুরো মেসোপটেমিয়া সভ্যতায়ই খেজুর গাছকে স্থান দেয়া হতো জীবনবৃক্ষ হিসেবে। ধর্মবিশ্বাসে জীবনবৃক্ষ বলতে পবিত্র বিশেষ গাছকে বোঝায়। জীবনবৃক্ষের মাধ্যমেই সংযুক্ত হয় স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল। প্রতীকায়িত করে জ্ঞান, অমরত্ব ও উর্বরতাকে। মাটির নিচে থাকা খেজুর গাছের অংশ যেন পাতালের সঙ্গে ও ডালপালাহীন কাণ্ড যেন স্বর্গের সঙ্গে যুক্ত। ফলে খেজুর গাছ মানবজগৎ ও দেবতাদের জগতের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ বিশ্বাস খেজুর গাছকে পৃথক মর্যাদা দিয়েছিল অন্য যেকোনো গাছের চেয়ে। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের তীরের উর্বর ভূমিতে বিপুল উদ্যমে চাষ হতো খেজুরের। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে মেসোপটেমিয়া সফর করেন হেরোডোটাস। পশ্চিম আনাতোলিয়ায় জন্ম নেয়া গ্রিক পণ্ডিত ও ইতিহাসের জনক তিনি। মেসোপটেমিয়ার মানুষের জীবনযাত্রার পাশাপাশি সেখানকার সারি সারি খেজুর বাগান তাকে মুগ্ধ করেছিল, সে মুগ্ধতা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন ‘দ্য হিস্টোরিজ’ গ্রন্থে।
হেরোডোটাস মিসরেও সফর করেছিলেন কাছাকাছি সময়ে। প্রাচীন মিসর সভ্যতার ইতিহাসে অনেক কারণেই বিস্ময় ছড়িয়ে রেখেছে। তেমন একটা উদাহরণ মমি। হেরোডোটাস তুলে ধরেছেন মমি তৈরির মিসরীয় পদ্ধতি। মমি তৈরিতে ব্যবহার করা হতো খেজুরের রস। খেজুর চাষে পূর্ণ ছিল গোটা নীল উপত্যকা। ধ্বংসাবশেষ হিসেবে প্রাচীন মিসরীয় অধিকাংশ চিত্রকর্মেই খেজুর গাছের উপস্থিতি দৃশ্যমান। ভাস্কর্যের ধরনকেও প্রভাবিত করেছে খেজুর গাছের কাঠামো। ফল ও রসের বাইরে ব্যবহূত হয়েছে খেজুরের কাঠ। অর্থাৎ খাদ্য হিসেবে খেজুর, পানীয় হিসেবে খেজুরের রস আর আবাস হিসেবে খেজুরের শাখা। ফলে খেজুর গাছে দেবত্ব আরোপ অস্বাভাবিক ছিল না। মেমফিসে খোদাই করা চিত্রকর্মে ধর্মযাজককে খেজুর চাষে রত দেখা যায়। গম্বুজের দেয়ালে অঙ্কিত হয়েছে খেজুর গাছের বেড়ে ওঠা। খেজুর গাছ ছিল কয়েকজন দেবতার বসতি। বিশেষ করে দেবী হাথোর ও নেফথিস। হাথোর জীবন, সংগীত ও উর্বরতার দেবী। অন্যদিকে নেফথিস মৃত ব্যক্তির জন্য সুরক্ষা দানকারী দেবী। প্রাচীন মিসরীয়রা বিশ্বাস করত, মৃত ব্যক্তির জন্য নেফথিস পানি ও খেজুর নিয়ে হাজির হন। অসীমতার দেবতা হেহ। প্রায়ই তাকে চিত্রিত দেখা যায় দুই হাতে খেজুর শাখা ধরে রাখা অবস্থায়। মিসরীয় মন্দিরগুলোতে খেজুরের শাখা রাখা হতো সময়ের নির্ধারক হিসেবে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অনন্ত জীবনের প্রতীক হয়ে উপস্থিত থাকত খেজুর।
ইহুদি বিশ্বাসে খেজুর পেয়েছে বিশেষ অবস্থান। নবি সলোমনের নির্মিত টেম্পলের দেয়াল ও দরজার কাজে ব্যবহূত হয়েছে খেজুর গাছ। ছিল ভেতরে ও বাইরের পাশের অলংকরণে। যবুর কিতাবে বলা হয়েছে, সৎ কর্মশীলরা খেজুর গাছের মতো সমৃদ্ধি নিয়ে বেড়ে উঠবে। বাইবেলের ভাষ্যে প্রথম পুরুষ আদম যে বেহেশতে বসবাস করতেন তার মধ্যে ছিল জীবনবৃক্ষ। তালমুদের ব্যাখ্যায় সেই জীবনবৃক্ষ মূলত একটা খেজুর গাছ। ইহুদি ঐতিহ্যে সাতদিনব্যাপী পালিত ধর্মীয় উৎসব সুকুত। উৎসবের প্রতিদিনকার ধর্মীয় কর্মকাণ্ডেই ব্যবহূত হয় খেজুরের নরম শাখা। খেজুরের শাখা প্রতীকায়িত করে বনি ইসরায়েলের বিজয়কে। হিব্রু বাইবেলে কানান অঞ্চলকে ‘দুধ ও মধুর ভূমি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাইবেলীয় সময়ে জর্ডান নদীর পাশে ছিল প্রচুর খেজুর গাছ। মধু বলতে খেজুর থেকে উত্পন্ন মধুকেই বোঝানো হতো তখন। ইহুদি নগরী জেরিকোকে বলা হতো ‘খেজুর গাছের শহর’। খেজুর গাছ জুদিয়া রাজ্যের প্রতীক। স্বাধীন হিব্রু রাজ্যে অঙ্কিত মুদ্রাতেও দেখা যায় খেজুর গাছের উপস্থিতি। ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান জেনারেল টাইটাস জেরুজালেমে অভিযান পরিচালনা করেন। দখল করে নেন জুদিয়া রাজ্য। নতুন ব্রোঞ্জের মুদ্রা প্রবর্তিত হয় জেরুজালেম থেকে। জুদিয়া ক্যাপটা নামে পরিচিত মুদ্রাগুলো। মুদ্রায় খোদাই করা থাকত খেজুর গাছ। একটা মুদ্রার এক পিঠে দেখা যায় এক বৃদ্ধাকে, যিনি খেজুর গাছের নিচে বসে কাঁদছেন। রোমান উৎসগুলোতে জেরুজালেম অঞ্চলে উৎপাদিত খেজুরের প্রশংসাবাণী বিদ্যমান। সে সূত্র ধরে গ্রিক ও রোমান মুদ্রাতেও মেলে খেজুর গাছের উপস্থিতি। খেজুর সেখানে তৈরি করেছিল অর্থনৈতিকভাবে স্বতন্ত্র অবস্থান।
ফিনিশীয় মুদ্রায়ও দেখা যায় খেজুর গাছের খোদাইচিত্র। মূলত গ্রিক থেকে উৎসারিত ফিনিশিয়া নামটিই খেজুরের সঙ্গে সম্পর্কিত। খেজুর গাছ দেখা যায় কার্থেজের মুদ্রাতেও। গ্রিক পুরাণমতে, অ্যাপোলো ও তার যমজ বোন আর্তেমিস জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটা খেজুর গাছের নিচে। ফলে অ্যাপোলোর মন্দিরে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে খেজুর গাছ। অ্যাপোলোর জন্মস্থান ডেলোস দ্বীপে তৈরি করেছে বিশেষ জায়গা। পরবর্তী সময়ে যখন এথেন্সের নেতৃত্বে গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলো নিয়ে গড়ে ওঠে ডেলিয়ান লিগ, তাদের আইকন ছিল খেজুর গাছ। গ্রিক সভ্যতায় খেজুর নতুন মাত্রা তৈরি করেছিল। ৪৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংঘটিত ইউরিমেডনের যুদ্ধে জয়ের পর স্মারক হিসেবে ডেলফির মন্দির প্রাঙ্গণে রোপণ করা হয় খেজুর গাছ। গ্রিক সমুদ্রদেবতা পসাইডনের হাতে খেজুরের শাখা ধরে রাখা অবস্থায় দেখা যায়, খেজুরের ডাল যেন ক্ষমতা ও আভিজাত্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। ক্রমে বিজয়ের প্রতিশব্দ হিসেবেই খেজুর গাছ ব্যবহূত হতে শুরু করে প্রাচীন গ্রিস ও রোমে। জুলিয়াস সিজার ক্ষমতায় আসার আগে দেবী নাইকির মন্দিরে অলৌকিকভাবে গজিয়ে উঠেছিল খেজুর গাছ, যা তার বিজয়ের ইঙ্গিত বহন করে। কোনো যুদ্ধ কিংবা সামরিক অভিযানে বিজয়ী হয়েছেন, এমন ব্যক্তিরা পরবর্তী অভিযানে বিশেষ ধরনের টোগা পরিধান করতেন। টোগা পালমার নামে পরিচিত সেই টোগায় প্রতীকায়িত হয়ে থাকত খেজুর গাছ। বিজয়ী সামরিক দল কিংবা প্রতিযোগিতামূলক খেলায় বিজয়ীর মাথায় পরিয়ে দেয়া হতো পাতার তৈরি জয়মাল্য। হাতে তুলে দেয়া হতো খেজুরের পাতা। অবশ্য বিজয়ীকে বরণের এমন রীতি সেমেটিক ঐতিহ্যেও চর্চিত ছিল দীর্ঘদিন। খেজুর মাহাত্ম্য আরো বেশি করে চিত্রিত হয়েছে গ্রিক পৌরাণিক বীর হেরাক্লেসের আলোচনায়। পাতাল থেকে ফিরে আসার পর হেরাক্লেস সবার আগে খেজুর পাতা দেখতে পান। তিনি নিজে সেই পাতা দিয়ে মুকুট বানিয়ে মাথায় পরেন। গ্রেকো-রোমান সভ্যতায় আলংকারিক হিসেবেও খেজুর ও খেজুরের গাছ ছাপ রেখে গেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। খেজুর গাছ খোদিত হয়েছে মোজাইকে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের স্থাপত্যকলার অংশ হিসেবে তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়া পর্যন্ত মোজাইকে দেখা যায় খেজুর গাছ ও খেজুর। খেজুর গাছের প্রশংসাবাক্য কীর্তিত হয়েছে হোমারের মহাকাব্য ওডেসিতে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের আকিমেনিদ সিলমোহর পাওয়া গেছে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায়। সেখানে খেজুর গাছের উপস্থিতি স্পষ্ট। অর্থাৎ প্রাচীন পারসিক ঐতিহ্যেও খেজুর গাছে অপরিচিত ছিল না।
খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে খেজুরের শাখাকে গণ্য করা হয় বিজয়ের স্মারক হিসেবে। লাস্ট সাপারের আগে যখন যিশুখ্রিস্ট জেরুজালেমে প্রবেশ করেন, সেখানকার মানুষ তাকে খেজুরের শাখা নেড়ে স্বাগত জানায়। বিজয়ীকে বরণ করার রীতি এমনই ছিল তখন। যিশুকে বরণ করে নেয়ার এই দিনকে পরবর্তী সময়ে আত্মীকৃত করে নিয়েছে চার্চ। রূপ দিয়েছে বার্ষিক উৎসবের। পালন করা হয় পাম সানডে। বর্তমান সময়েও ক্যাথলিক, লুথারিয়ান, মেথোডিস্ট, অ্যাংলিকান ও মোরাভিয়ান খ্রিস্টধর্মে আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয় ‘পাম সানডে’। খেজুর শাখা খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে শহীদি চেতনার প্রতীক। মৃত্যুকে মনে করা হয় শরীরের ওপর আত্মার বিজয়। কবরে খেজুরের ডাল রাখার অর্থ মনে করা হয় এটা কোনো শহীদের কবর। ক্রুসেডাররা ঘরে ফিরত খেজুর গাছের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে। যার সিলসিলা ধরেই ক্যাথলিক চার্চ থেকে এখনো ‘পাম অব জেরুজালেম’ অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। খ্রিস্টধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপে বৃদ্ধি পেয়েছে খেজুরের জনপ্রিয়তা। অনুপ্রেরণা হিসেবে ছিল গ্রেকো-রোমান সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। সাদা পাতা প্রতীকায়িত করে ঐশ্বরিক বিশুদ্ধতাকে। এখন স্পেনের এলচি বিখ্যাত বার্ষিক উৎসবের জন্য। উৎসবটিকে বলা হয় পিলগ্রিমেজ টু এলচি। উৎসবের অন্যতম প্রধান অঙ্গ হলো মাতা মেরির মৃত্যু ও স্বর্গে আরোহণ। এক ফেরেশতা আকাশ থেকে এসে মা মেরির সামনে থামেন। তার হাতে তুলে দেন খেজুরের শাখা। বিশ্বাস অনুসারে এর অর্থ হলো এখন থেকে তার কবরে খেজুর গাছ জন্মাবে। বুক অব রিভেলেশনের শেষ অধ্যায়ে উদ্ধৃত হয়েছে এ প্রসঙ্গ। ‘নদীর উভয় পাশেই রয়েছে জীবনবৃক্ষ। যেখানে ১২ রকমের ফল ধরে। প্রতি মাসেই পাওয়া যায় ফল। সে গাছের পাতায় রয়েছে মানুষের আরোগ্য।’ ১২ সংখ্যার তাত্পর্য রয়েছে। প্রাচীন মিসরীয় সংস্কৃতিতে গাছের ডালকে বছরের সঙ্গে ও পাতাকে মাসের সঙ্গে তুলনা করা হতো। খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যে বিশ্বাস করা হয়, খেজুর গাছ থেকে প্রতি মাসে একটি করে নতুন অঙ্কুর গজায়। ফলে গাছ যেন বারো মাসকে ধারণ করা বছরকেই প্রতীকায়িত করে। খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস করা ক্রিসমাস ট্রির মাহাত্ম্যও এখানে।
ইসলাম ধর্মে খেজুর আল্লাহ প্রদত্ত অলৌকিক ফল। শরীর ও আত্মার সুস্থতায় ভূমিকা রাখে খেজুর। খেজুরবিহীন বাড়িকে দরিদ্র বাড়ি বলে অভিহিত করেছেন রাসুল (সা.)। কোরআনেও খেজুরের কথা বারবার উদ্ধৃত হয়েছে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ ও প্রাচুর্যের উদাহরণ হয়ে। বিশ্বাসীদের জন্য জান্নাতে খেজুর গাছ থাকবে। নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে খেজুরের স্মৃতি। একবার এক খেজুর গাছ রাসুলের সামনে মাথা অবনত করে সম্মান জানায় বলে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। মদিনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামের প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়েছিল খেজুর পাতায়। মুয়াজ্জিন বেলাল প্রায়ই খেজুর গাছ বেয়ে উঠে দিনে পাঁচবার আজান দিতেন। মুসলিম চিত্রকলায় খেজুর গাছ পাওয়া যায়। মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম বিশেষ উদাহরণ মিনার, যা প্রভাবিত খেজুর গাছ থেকে। আরব মননে খেজুর গাছ ছিল পূর্ণতার প্রতীক। কেবল লেখাজোখায় না, তাদের চিত্রকর্ম ও স্থাপত্যে উঠে এসেছে খেজুর গাছের প্রভাব। বলা হয়, ‘খেজুর গাছের মতো হও, কেউ যখন ঢিল ছুড়বে, জবাব দেবে একটা মিষ্টি খেজুর ছুড়ে’। আরবরা যখন বাগদাদ থেকে আন্দালুসিয়ায় গেল, বিস্তার ঘটে খেজুরের। উমাইয়া শাসক আবদুর রহমান আন্দালুসিয়ায় গিয়ে একটা নিঃসঙ্গ খেজুর গাছ দেখে লিখে ফেলেছিলেন অবিস্মরণীয় এক কবিতা—
খেজুরের দেশ থেকে বহু দূর
রুসাফার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে এক খেজুর বৃক্ষ
বললাম, ‘তুমি যেন ঠিক আমারই মতোন, একা এই দূর পরবাসে
পরিবার ও বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন
এমন জায়গায় বেড়ে উঠছ, যেখানে তুমি পরদেশী
আমার মতোন, ঘর থেকে বহু দূরে, বহুদূরে।’
আরব পরিচিতির স্মারক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে খেজুর গাছ। যা পরবর্তী সময়ে স্পেন থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ইতালি ও ইউরোপের অন্যান্য অনুকূল আবহাওয়া অঞ্চলে। আন্দালুসিয়ার ৮০০ বছরের আরব শাসনে খেজুর গাছ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির জেরে উপঢৌকন হিসেবে পাঠানো হয়েছে খেজুর। পঞ্চম শতাব্দীতে আরবদের আন্দালুসিয়া থেকে বিতাড়ন করা হয়। অদ্ভুতভাবে তুলে ফেলা হতে থাকে খেজুর গাছ। আন্দালুসিয়ার খেজুর গাছকে মনে করা হতো অবিশ্বাসীদের ফেলে যাওয়া পদচিহ্ন। কেবল দক্ষিণ স্পেনের এলচিতে থাকা খেজুর বাগানই রক্ষা পেয়েছিল ক্রোধ থেকে।
খেজুরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সঙ্গে খেজুরকেন্দ্রিক উৎসবের উদাহরণও কম নেই। প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতায় বসন্তকালীন উৎসবে স্মরণ করা হতো দেবী ইশতারকে। ইশতার খেজুর বৃক্ষের পৃষ্ঠপোষকতা দানকারী দেবী। ইহুদিদের সুকুত ও খ্রিস্টান পাম সানডের মতো অন্যান্য সংস্কৃতিতেও রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে। দক্ষিণ লিবিয়া ও উত্তর শাদের সীমান্তবর্তী গ্রাম টিবেস্টিতে দেখা যায় খেজুরকেন্দ্রিক উৎসব। বর্তমানে খেজুর চাষ তাদের জীবনযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। উৎসবে খেজুর গাছকে কেন্দ্র করে নৃত্য ও খেজুরের মদ পান করা সাধারণ দৃশ্য। মধ্যপ্রাচ্যে খেজুর সামাজিক উৎসবে প্রবেশ করেছে। বাহরাইনে বিয়ের অনুষ্ঠানে ফটক সাজানো হয় খেজুরের শাখা দিয়ে। খেজুর সেখানে প্রতিনিধিত্ব করে আনন্দ ও আশীর্বাদের। ওমানে এখনো পুত্রসন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে একটি খেজুর গাছ রোপণ করা হয় প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে। সম্প্রতি উপসাগরীয় অঞ্চলে শুরু হয়েছে খেজুর উৎসব। খেজুর চাষীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। সবচেয়ে ভালো খেজুরচাষী লাভ করেন পুরস্কার। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে খোদ ক্যালিফোর্নিয়ায় উদযাপিত হয় খেজুর উৎসব। স্পষ্ট যে এখনো অটুট রয়েছে খেজুরের আধিপত্য। অজস্র গল্প জন্ম দিয়ে এখনো এগিয়ে চলছে খেজুর ও মানুষের মহাকাব্যিক সম্পর্ক।
লেখক : আহমেদ দীন রুমি