আলোচিতজাতীয়

আবারো ‘স্যার’ বিতর্ক: সরকারের উচিত এ ব্যাপারে নীতিমালা করা

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কি ‘স্যার’ ডাকতে হবে? এই বিতর্ক ২০২১ সালে শেষ হলেও রংপুরের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) আচরণে বিষয়টি আবারো সামনে এসেছে। সাবেক আমলা ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারের উচিত এ ব্যাপারে নীতিমালা করে দেয়া।

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক উমর ফারুক ২২ মার্চ তার এলাকার একটি স্কুল নিয়ে ডিসির সঙ্গে কথা বলতে তাকে ‘স্যার’ না বলায় অশোভন আচরণের শিকার হন বলে অভিযোগ করেন। প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক প্ল্যাকার্ড নিয়ে ডিসি অফিসের সমনে অবস্থান নেন। পরে ডিসি দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে সহাকারী অধ্যাপক উমর ফারুক মনে করেন, তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে অবস্থান না নিলে, সবাই এগিয়ে না এলে ডিসি দুঃখ প্রকাশ করতেন কীনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

২০২১ সালের নভেম্বরে একই ধরনের কয়েকটি ঘটনা ঘটার পর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন তখন বলেন, ‘‘সরকারি সেবা নিতে আসা জনসাধারণকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করতে হবে, এমন কোনো নীতি নেই।”

তিনি আরো মনে করিয়ে দেন, ‘‘যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা জনসাধারণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে তবে তা দুর্নীতির শামিল।”

‘স্যার’ নিয়ে আলোচিত বিতর্ক

ওই বছরের ৯ জুলাই মানিকগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুনা লায়লাকে ‘ম্যাডাম’ না বলে আপা বলায় ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাসকে লাঠিপেটা করে তার সাথে থাকা পুলিশ। ইউএনও একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় এই ঘটনা ঘটে।

একই বছরের ৩০ মে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ দাস এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকরা তাকে ভাই বলায় বিরক্ত হন। তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের ভাই বলে ডাকার রেওয়াজ আর গেল না, জানেন আমাদের এই চেয়ারে বসতে কত কষ্ট করতে হয়েছে?’’ এপ্রিলে নেত্রকোনার কালমাকান্দা উপজেলায় ইউএনওকে স্যার না বলায় থানার ওসি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে হেনস্তা করেন।

চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মামুন খানকে সাংবাদিক আশিক জামান ফোনে তথ্য নিতে গিয়ে ভাই বলায় তিনি ক্ষেপে যান। এসি ল্যান্ড সাংবাদিককে তথ্য না দিয়ে বলেন, ‘‘তার আগে বলেন আপনি এসিল্যান্ডকে ভাই কেন বলছেন, আমি আপনার কেমন ভাই.” স্যার ডাকলে তিনি খুশি কীনা ওই সাংবাদিক জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘না না আপনার স্যার ডাকতে হবে না। কিন্তু কখনো ভাই ডাকবেন না। এটা ফরমাল কোনো ডেকোরাম না।”

‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা’
বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ একটি নীতি আছে. সেটা প্রশাসনের জন্য প্রযোজ্য। আমরা প্রশাসনে নিজেদের মধ্যে যখন অফিসিয়াল চিঠি লিখি, যোগাযোগ করি তখন কাকে কীভাবে সম্বোধন করব. তবে এটা জনগণের জন্য নয়।”

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘আমি ৩২ বছর সরকারি চাকরি করলাম। আমার তো কখনো মনে হয়নি আমাকে স্যার বলতে হবে। আমাকে স্যার না বললে সার্ভিস দেবো নো এটা তো মানসিকতা হতে পারে না। প্রশিক্ষণে তো সরকারি কর্মকর্তাদের জনগণের সাথে ভদ্র, নম্র ব্যবহার করতে বলা হয়। তাদের স্যার বলতে হবে এটা তো কখনো বলা হয় না।”

তার মতে, স্যার বলা বা বলতে বাধ্য করানো ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা’৷ সম্মানের বিষয়টি পারস্পরিক তা জোর করে আদায় করা যায় না। তবে তিনি মনে করেন, সাধারণ মানুষ সরকারি কর্মচারীদের কীভাবে সম্বোধন করবেন সেই বিভ্রান্তি দূর করতে সরকারের নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। ‘‘যেহেতু এটা নিয়ে বার বার কথা হচ্ছে তাই সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত সম্বোধন কী হবে। এটা নাম, পদ বা অন্য কোনোভাবে সম্বোধন হতে পরে। তবে অবশ্যই স্যার না,” বলেন শেখ ইউসুফ হারুন।

‘নাগরিকরা প্রজা নন, মালিক’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘‘সরকারি কর্মকর্তারা হলেন সরকার ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। জনগনের সেবক। সংবিধানে নাগরিকেরা প্রজাতন্ত্রের মালিক৷ নাগরিকরা তো প্রজা নন, মালিক-এটা সরকারি কর্মকর্তাদের বুঝতে হবে।”

তিনি মনে করেন, ‘‘সমস্যা স্যার নিয়ে নয়, কেউ কাউকে স্যার বলতে পারেন, নাও বলতে পারেন। কিন্তু আমাদের এখানে স্যার শব্দটি ক্ষমতা প্রকাশ করে৷ তাই তারা স্যার শুনতে চান।”

নীতিমালা করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে মনে করেন না তিনি। তার মতে এক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধার চর্চা বেশি প্রয়োজন।

যার প্রতিবাদের কারণে নতুন করে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সহকারী অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুকে অনেকেই ‘মুজিব ভাই’ বলে ডাকতেন। কিন্তু এই সময়ে আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে এক ধরনের আধিপত্যবাদ বিরাজ করছে। রাষ্ট্রের যারা সেবক তারা ভুলে যাচ্ছেন এই রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছেন জনগণ। প্রশাসনের মধ্যে যে ডেকোরাম আছে সেটা যে নাগরিকদের জন্য নয় সেটাও তারা ভুলে যাচ্ছেন।’’

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button