গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ৫ বছর আগে ফরমালিনের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। নষ্ট করা হয়েছিল শত শত মন ফল। কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফল-মূল, শাক-সবজি সংরক্ষণে ফরমালিনের কোনো ভূমিকা নেই। মাছের বেলায়ও তাই।
২০১৪ সালে যখন আমসহ আরো অনেক গ্রীষ্মকালীন ফলের ভরা মৌসুম, তখন ঢাকাসহ সারাদেশে জন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন-বিরোধী অভিযানের কথা অনেকেই হয়তো ভোলেননি। ঢাকায় এই অভিযান পরিচালনা করেছিল ঢাকা মট্রোপলিটন পুলিশ। যোগ দিয়েছিল মোবাইল কোর্টসহ সরকারের আরো অনেক সংস্থা। ঢাকার বাইরেও সারাদেশে একইভাবে অভিযান পরিচালনা করা হয়। শত শত মন আম বিনষ্ট করা হয়। বিনষ্ট করা হয় লিচু, তরমুজসহ আরো অনেক মৌসুমী ফল। মাছের বাজার আর শাক-সবজির কাঁচা বাজারেও চলে এই অভিযান। ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়ে ফলের ট্রাক থামিয়েও অভিযান চালানো হয়। আর ফরমালিন মাপার যন্ত্র দিয়ে তখন প্রায় সব ফলেই পাওয় যায় উচ্চ মাত্রার ক্ষতিকর ফরমালিন। লাখ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের। ফলের বাজার, মাছের বাজার শূন্য হয়ে যায়। পরের বছরও একইভাবে চলে অভিযান।
২০১৩ সালে খাদ্যে ফরমালিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয় দেশে। একই সাথে খাদ্য সংরক্ষণে যে কোনো অননুমোদিত রাসায়নিক প্রয়োগের অপরাধে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে আইন তৈরি হয়। আর ২০১৫ সালে সরকার ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন করে এর ব্যবহার ও আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেয়।
কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘ওই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। ফল-মূল এবং শাক-সবজি ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষণ করা যায় না। আর সংরক্ষণের কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি, যা হয়েছে তা ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।”
তিনি বলেনন, ‘‘ফল মূল, শাক-সবজি এগুলো হলো ফাইবার৷ এখানে ফরমালিন দেয়ার কোনো সুযোগই নেই৷ কেউ যদি না বুঝে দেয়ও, তাহলেও কোনো কাজে আসবে না। সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখবে না৷ কারণ, এখানে কোনো প্রোটিন নেই। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ধারণা যে, ফল-মূল, শাক-সবজিতে ফরমালিন দেয়া হয়৷ এটা দুর্ভাগ্যজনক।”
তিান বলেন, ‘‘আমদানি করা আপেলে এক ধরনের এডিবল প্যারাজিন দেয়া হয়। এটা খাওয়ার যোগ্য৷ আমরা আপেল খাওয়ার পর এটা আবার একইভাবে বেরিয়ে আসবে। ফল-মূলে ৪০ ভাগ পানি থাকে৷ প্রতিদিন ওজন কমে ৫ থেকে ১০ গ্রাম। এখন একটি আপেলের প্রতিদিন যদি ৫ গ্রাম ওজন কমে তাহলে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল থেকে আপেল আসতে সময় লাগে ২১ দিন, আসতে আসতেই হাড্ডিসার হয়ে যাবে। কেউ কিনবে না৷ আপনি-আমি যে আপেল খাই, অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও সেই একই আপেল খান। বিদেশে গেলে একটা আপেল , একটা মালটা নিয়ে আসবেন দেড় বছরে কিছু হবে না৷ এটা হলো সায়েন্স। এটা এডিবল প্যারাসিন দিয়ে করা হয়। এখন ফলের খোসা দিয়ে কোটিং তৈরি করা হয়। আবার স্টিকার বের হয়েছে, যা ফলের ওপরে লাগানো থাকে, ওই রকম স্টিকার, যা দিয়ে আমের লাইফ দুই সপ্তাহ বাড়ানো যায়। এখানে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
তবে আগাম আম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমের একটি ক্যালেন্ডার আছে৷ তাই ২০ থেকে ২৫ মে-র আগে আম খাওয়া ঠিক নয়৷ আগাম পেড়ে ফেলা আম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়। সরকারের উচিত হবে মার্চ-এপ্রিলে যে আম আমদানি হয়, তা বন্ধ করা। দুই মাস এলসি বন্ধ রাখা৷ কারণ, সেগুলো শতভাগ কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়।”
তিনি আরো বলেন, ‘‘আঙুর নিয়েও আমাদের এখানে একটা ভুল ধারণা আছে। দেখবেন, আঙুরের ওপর সাদা সাদা পাউডার। অনেক মানুষই মনে করে এটা কীটনাশক। কিন্তু আসলে তা নয়। এটা এক ধরনের ন্যাচারাল কোটিং। এটা ওয়েট লস থেকে রক্ষা করে। পোকা -মাকড়ের আক্রমণ থেকেও রক্ষা করে।”
তিনি জানান, ‘‘আমের মুকুল বা গুটি আমে যে কীটনাশক দেয়া হয়, তা এখন ১৫-২০ দিনের বেশি থাকে না। তাই আতঙ্কের কিছু নেই।”
ফরমালিন টেস্টের পদ্ধতি এবং কীট নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘ফরমালিন টেস্টের নামে যেসব কিট এখানে ব্যবহার করা হয়েছিল, ওই কিটগুলো ঠিক ছিল না। সেটা তখন বলায় বেনজীর আহমেদ (ডিএমপি’র তখনকার কমিশনার) আমাকে অ্যারেস্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু আদালতের নির্দেশে অ্যামেরিকায় পরীক্ষা করে এখন প্রমাণ হয়েছে ওই কীটগুলো ঠিক ছিল না।”
তিনি বলেন, ‘‘যে মাছ পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়, যেমন মলা, কাচকি মাছে এক সময় দশমিক তিন থেকে পাঁচ ভাগ ফরমালিন কেউ কেউ সময় সময় ব্যাবহার করতো। ফরমালিনের এমন ঝঁঝালো গন্ধ, যা বেশি ব্যবহার করা যায় না। এটা ধুয়ে ফেললে আর থাকে না। তবে এটা এখন আর দেয়াই হয় না।”
তাঁর মতে , ‘‘আমরা আসলে ফরমালিন আতঙ্কে ভুগছি৷ এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি করে ফল-মূল, শাক সবজি। এখন আমরা আতঙ্কে তা খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছি। এটা আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করছে।”
তিনি আরো বলেন, ‘‘ফরমালিন হলো হাইলি ভোল্যাটাইল এবং হাইলি সোলিবল। ভোল্যাটাইল মানে হলো উদ্বায়ী। একটি আম যদি ফরমালিনে চুবানো হয়, তাহলে আমটা তোলার পর দ্রুত ফরমালিন উড়ে যাবে। আর পানিতে দিলে খুব দ্রুত এটা দ্রবীভূত হয়ে যাবে। আসলে ফল-মূল, শাকসবজি সংরক্ষণে এর কোনো ভূমিকা নেই।”
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মাহবুব কবীর বলেন,‘‘এখন দেশে ফরমালিনই নেই৷ সুতরাং ফরমালিন মেশানোর সুযোগও নেই। ২০১৫ সালে এটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, ফরমালিন ফল-মূল সংরক্ষণে কাজ করে কিনা। প্রোটিন বন্ডেজ ছাড়া সেলুলোজ বন্ডেজে ফরমালিন দিলেও কাজ করবে না। কাজেই কেউ যদি অতীতে শাক-সবজি, ফল-মূল সংরক্ষণে ফরমালিন দিয়েও থাকেন, তা কাজে আসেনি৷ আসবেও না।”
তিনি জানান, ‘‘তবে এমনিতে ন্যাচারালি ফরমাল ডিহাইড থাকে। এটা সহজাত। প্রত্যেকটি ফলে সিজস্ব ফরমাল ডিহাইড ক্রিয়েট হয়, যা ফলকে পাকতে সহায়তা করে। নয়তো ফল পাকতো না৷ আর আমদানি করা ফল, যেমন আপেল সংরক্ষণের জন্য ওয়াক্স কোটিং দেয়া হয়। আমাদের যে ধারণা দেশি ফল-মূল এবং বিদেশ থেকে আনা ফলে ফরমালিন দেয়া হয়, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এটা আমাদের একটা আতঙ্ক। আর এ কারণে আমরা জাতি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।”
তিনি বলেন, ‘‘মাছের ক্ষেত্রে কেউ যদি মাছ ফরমালিনে চুবিয়ে উঠিয়ে রাখে, তাহলে বৈজ্ঞানিকভাবেই ফরমালিন কাজ করার কথা নয়। ২৪ ঘণ্টা ফরমালিনের মধ্যে চুবিয়ে রাখতে হবে। তাহলে বন্ডেজ ক্রিয়েট হবে৷ আর তীব্র ঝাঁঝালো ঘন্ধ থাকায় এটাকে ফরমালিনে ডুবালে লুকানো যায় না।”
তাহলে এত যে অভিযান, এত ফল-মূল ধংস করা হলো, তা কি ভুল ছিল? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘হয়ত আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। ফরমালিন পরীক্ষার কিট হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা করে দেখা গেল আমাদের কিট ঠিক ছিল না। তবে সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে ওই অভিযান হয়েছে৷ তাই সেটা নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক হবে না।”
তিনি বলেন, ‘‘যেহেতু ফলে ন্যাচারালি ফরমাল ডিহাড তৈরি হয়, তাই স্বীকৃত মেশিন দিয়ে মাপলেও ফলে ফরমালিন পাওয়া যাবে৷ আমাদের জানতে হবে, ক্ষতিকারক মাত্রা কত। আবার এই ক্ষতিকারক মাত্রাও সুনির্দিষ্ট করা নেই। এটা সর্বোচচ ১০০ পিপিএম পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য।”
দেশে ফরমালিন আমদানি নিষিদ্ধ করার আগে শিল্পে ব্যবহারের জন্য এর আমদানীর অনুমতি দেয়া হতো। ওই সময়ে হয়তো বুঝে না বুঝে ফরমালিনের অপব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। মাহবুব কবীর জানান, ‘‘২০১৪ সালে এক বছরে ফরমাল ডিহাইড পাউডার আমদানি হয়েছিল সাড়ে ১৭ হাজার মেট্রিক টন। এক কেজি পাউডারে ৪০ লিটার পানি দিলে সেটা ফরমালিন হবে। তাহলে ওই এক বছরে দেশে মোট ফরমালিন এসেছে ৬ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। এত ফরমালিন কী কাজে লেগেছে সেটা অনুসন্ধান করার প্রয়োজন আছে। তখন ফরমালিনের দামও কম ছিল। লিটার বিক্রি হতো ৮০-৯০ টাকায়।”
তিনি বলেন, ‘‘তখন হয়ত কেউ বুঝে-না-বুঝে ফরমালিন ব্যবহার করে থাকতে পারেন৷ তবে তা কাজে আসেনি।”
সূত্র: ডয়চে ভেলে