ব্রিটিশ জাহাজে লস্করজীবন
আহমেদ দীন রুমি : গ্রেবসেন্ডে নোঙর করল ‘দি ইউনিয়ন’। সাড়ে পাঁচ মাসের সমুদ্রযাত্রার পর ইংল্যান্ডে পা রাখলেন ক্যাপ্টেন জন লুক। ক্যালেন্ডারে দিনটি ১৮০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। ‘দি ইউনিয়ন’ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ নয়। মালিক উইলিয়াম ও হর্সলি পামার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীতি অনুসরণ করে বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে সরব ছিল ভারত মহাসাগরে। তবে খুব দ্রুতই অন্য কারণে শিরোনাম হয় ‘দি ইউনিয়ন’। লস্করদের সঙ্গে ভয়াবহ আচরণ করছে কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। উঠে আসে লস্করদের প্রতি ক্যাপ্টেন লুক ও তার অফিসারদের চালানো অত্যাচারের ফিরিস্তি। বাংলা থেকে যাত্রা শুরু করার পরই শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। অসুস্থ হয়ে পড়ে লস্কররা। তার পরও বাধ্য করা হয়েছে কাজে। ছিল না খাওয়া, ঘুম ও বিশ্রামের উপযুক্ত ব্যবস্থা। কাজের গতি কম হলে কিংবা ঘুমিয়ে গেলে পরিণাম ছিল ভয়াবহ। ফলে অধিকাংশই মৃত্যুবরণ করে। ‘দি ইউনিয়ন’ সমালোচনা তুলে সভ্য মহলে। প্রশ্ন দেখা দেয় সমুদ্রপথে লস্করদের সঙ্গে আচরণ নিয়ে।
১৮৭০ সালের পর জাহাজে যুক্ত হয় বাষ্পীয় ইঞ্জিন। ফলে নৌপথ শিল্পায়িত হয়ে ওঠে দ্রুততম সময়ের মধ্যে। কমে যেতে থাকে দক্ষ নাবিকের জরুরত। ভারি শ্রম দিতে পারে ও দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারে, এমন যে কেউ যোগ দিতে পারে জাহাজের কাজে। সে চাহিদা পূরণের জন্যই ব্রিটিশরা নিয়োগ দেয় ভারতীয়দের। লস্কর নামে পরিচিত এসব ভারতীয়ের জীবন ছিল নির্যাতিত নির্বাসিতের মতো। দি ইউনিয়নের ঘটনাই তার একটা প্রমাণ হতে পারে। তবে আইনি দিক থেকেও বৈষম্য হয়েছে ভারতীয়দের সঙ্গে। ১৮৫৯ সালের বাণিজ্যিক আইনে জাহাজে ইউরোপীয় ক্রুদের তুলনায় লস্করদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা ছিল অর্ধেকেরও কম। ১৮৭৬ সালের আইনে ইউরোপীয়দের জন্য ১০ বর্গফুট বরাদ্দের বিপরীতে লস্কররা পেয়েছে ৬ বর্গফুট। পরবর্তী সময়ে আরো কয়েক দফা পরিবর্তিত হয়। কিন্তু বৈষম্য ঘোচেনি। দুর্দশার এ চিত্র ছাপিয়ে গিয়েছিল আরো অনেক দূর। তার প্রমাণ পাওয়া যায় সার্জন ডব্লিউ ই হোমের পরিসংখ্যানে। তিনি তুলনামূলকভাবে উত্থাপন করেন ইউরোপীয় ও লস্করদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি। ১৯১৩ ও ১৯১৪ সালে ইউরোপীয় ও লস্করদের তালিকায় দেখা যায়, প্রতি হাজারে ইউরোপীয়দের মৃত্যুহার ৩ দশমিক ৫ হলেও লস্করদের মৃত্যুহার ৫ দশমিক ৪। মৃত্যুর কারণ প্রায়ই হতো সংক্রামক রোগের মাধ্যমে। খুব অল্প স্থানে অধিক লস্কর গাদাগাদি করে বসবাস করার কারণে সংক্রামক ব্যাধি অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত শিবিরে। নিউমোনিয়া ও যক্ষ্মার প্রকোপ ছিল মারাত্মক। অথচ লস্করদের স্বাস্থ্যকে থোড়াই বিবেচনা করত কোম্পানি।
১৯২১ সালের জরিপে দেখা যায়, বিভিন্ন অসুখে ভুগে প্রতি হাজারে ৪ দশমিক ৬৭ জন মৃত্যুবরণ করে সমুদ্রযাত্রায়, ব্রিটিশ নাবিকদের জন্য এ পরিমাণ ২ দশমিক ৮। ঠিক পরের বছরই হাজারে ৪ দশমিক ১৪ জন লস্করের মৃত্যুর বিপরীতে ২ দশমিক ১৬ জন ব্রিটিশ নাবিকের মৃত্যু ঘটে। পরের বছরগুলোয়ও লস্করদের মধ্যে মৃত্যুহার দেখা যায় তুলনামূলকভাবে বেশি। অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার থেকে সহজেই তাদের আবাসন ও খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। অবশ্য তার চেয়ে বড় কথা অসুস্থতার সময়ে তাদের চিকিৎসা সেবাদানেও পার্থক্য ছিল। ১৯২৮ ও ১৯৩২ সালে কলকাতা বন্দরের একটা স্বাস্থ্যগত পরিসংখ্যানে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এ পাঁচ বছরে লস্করদের হাসপাতালে ভর্তির হার ইউরোপীয়দের হাসপাতালে ভর্তির হারের তুলনায় কম। আবার ভর্তি হওয়াদের অধিকাংশই কলেরায় আক্রান্ত রোগী। মৃত্যুহারও কলেরায় বেশি দেখা গেছে। বিপরীতে ইউরোপীয়দের কলেরায় আক্রান্তের হার কম। মৃত্যুর তথ্য নেই। যেহেতু কলেরার প্রধান কারণ খাদ্য, পানি ও স্বাস্থ্যবিধানের সঙ্গে জড়িত। ফলে কলেরায় আক্রান্তের পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে লস্করদের জীবনমান। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরও ১৯৩০ সালের পরিসংখ্যানে লস্করদের মৃত্যুহার ছিল ব্রিটিশদের তুলনায় বেশি। ১ দশমিক ৬৭ জন ইউরোপীয়ের বিপরীতে ১১ দশমিক ৭৬ জন ভারতীয়। চিকিৎসাসেবার মান ও কখন হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে, সেটাও বিবেচ্য। তাতে শুধু প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার চিত্রই দৃশ্যমান হয়। প্রেসিডেন্সি, হাওড়া ও বোম্বে হাসপাতালে ভারতীয়দের সেবা পাওয়াটাই কঠিন ছিল। চিকিৎসকের অভাবে লস্করদের চিকিৎসা করত জাহাজের অফিসার। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে চিকিৎসার নামে কী পেত, তা অনুমেয়।
লস্কররা ব্রিটেনের মাটিতে অসুস্থ হয়ে গেলে তাদের চিকিৎসা খরচ হওয়া অর্থ মজুরি থেকে কাটা যেত। সেখানকার খরচের হিসাবও আলাদা। ফলে প্রায়ই দেখা যেত দীর্ঘ যাত্রার শেষে কোনো প্রকার মজুরি দেয়া ছাড়াই লস্করকে দেশে পাঠানো হয়েছে। মজুরি কাটতে কাটতে পকেটে কোনো টাকাই পড়েনি। লস্করদের জীবন ছিল কঠিন ও বিপজ্জনক। ভারী কাজ করার জন্য তাদের খাওয়া-দাওয়া ঠিক রাখা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সঠিকভাবে নজর রাখেনি কর্তৃপক্ষ। খাবারে ভিটামিন বি-১-এর অভাবে বেরিবেরি রোগ হয়। ১৯২৫ ও ২৭ সালে বেরিবেরি ছিল লস্করদের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম রোগ। এখানেও ইউরোপীয় কিংবা ব্রিটিশদের তুলনায় লস্করদের আক্রান্তের হার ছিল আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। খাবারের মান ছিল খুবই নিম্ন। দেখা গেল লস্করদের খাবার যথা সময়েই পৌঁছে গেছে ঠিকই। কিন্তু সবজি কিংবা মাছটা পচা। ভাত কিংবা রুটি বাসি হয়ে গেছে। আলু ও পিঁয়াজ প্রায়ই আধাআধি পচেই থাকত। এদিকে খাবারের বণ্টনও সুষম ছিল না। উত্তর ভারতের পাঠান, দোগরা, শিখ, গুর্খা ও পাঞ্জাবিদের সঙ্গে বাঙালিদের এক কাতারে রাখা হতো না। একই চিত্র দেখা দেয় মজুরির বেলায়ও। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ছিল এক্ষেত্রে সংজ্ঞা নির্ধারক। তখন ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের বীর তকমা দেয়া হয়। বিদ্রোহকারী অঞ্চলের মানুষ ছিল তাদের মতে ভীতু ও দুর্ভিক্ষপীড়িত। জাহাজের একই কাজে তাদের মজুরি ভিন্ন হতো। একজন ব্রিটিশ ক্রুকে যত মজুরি দিতে হতো, সে মজুরিতে অনায়াসে তারা নিযুক্ত করত দুজন ভারতীয়কে। একই রকম কাজের জন্য লস্কর ও অন্যান্য দেশের ক্রুদের মজুরি ছিল আলাদা। লস্করদের মজুরিতে এ বৈষম্য অনেকটা ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির অন্তর্ভুক্ত। দুই দেশের শ্রমিকেরা একই দাবি উত্থাপন করে একত্র হবে, এমন সুযোগ বন্ধ করার নীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা এ বৈষম্যের ব্যাপারে সচেতন হয়। কারণ তখন ভারতীয়দের উত্তেজনার পরিণাম সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ ছিল। খোদ ভারতীয়দের মধ্যেই মজুরি কাঠামো পৃথক হতো বন্দরভেদে। দেখা যেতে বোম্বে বন্দরের থেকে কলকাতার বন্দরের মজুরি উল্লেখযোগ্য হারে কম। কলকাতায় ১৯১৯ সালে মজুরি ছিল মাসে ২৫ রুপি। অথচ বোম্বেতে ছিল মাসে ৩০ রুপি। ফলে লস্করদের মধ্যেও বাঙালিরা ছিল আরো বেশি শোষিত ও অধিকারবঞ্চিত।
এর মধ্যে ব্রিটিশ অফিসারদের ঘুস দেয়ার রীতিও বেশ জোরেশোরেই প্রচলিত ছিল তখন। আনুক্রমিক ধাপ ছাড়া বন্দরের কাঠামো কল্পনা করা ছিল অসম্ভব। ফলে ক্ষমতাকাঠামোয় ঊর্ধ্বতন প্রায়ই অধস্তনের থেকে ঘুস আদায় করে নিত। রেহাই দেয়া হয়নি বর্ণবাদের শেকল। কৃষ্ণাঙ্গদের ইঞ্জিন রুম ও সেলুনে নিযুক্ত করা হতো। রান্নাঘর ও খাবারের সরঞ্জামাদি বিষয়ক কর্মকাণ্ডকে গণ্য করা হতো মেয়ে বা দুর্বল লোকদের কাজ হিসেবে। শ্বেতাঙ্গদের রাখা হতো ডেকের কাজে। এ বৈষম্য লস্কর হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সময় থেকেই শুরু হতো। দেখা গেছে মালাবার উপকূলের মানুষদের সমুদ্রের মানুষ হিসেবে গণ্য করতে থাকে ১৯৫৮ সালের পর থেকে। বিপরীতে বাংলা অঞ্চলের মানুষ শিকার হয় রোষের। সে রোষ সহজ নয়। ব্রিটিশ নীতিতে বৈষম্যের সাক্ষ্য ছিল ইউনিফর্মেও। সারেং ও লস্করদের ইউনিফর্ম হতো আলাদা। লস্করদের ইউনিফর্মের মান ও বিন্যাসেই থাকত নিচু হিসেবে উপস্থাপনের চিত্র। তাদের ওপর লঘু পাপে গুরু দণ্ড ছিল খুবই সাধারণ। ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার নাম করে চলত অকথ্য নির্যাতন। প্রথমে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে বেঁধে রাখা হতো পাটাতনে। তারপর ক্ষতস্থানে ছিটিয়ে দেয়া হতো লবণ। রয়েছে খুন করার রেকর্ডও। আরেকটা অদ্ভুত সাজা ছিল। মুসলমানদের জন্য শূকরের মাংস খাওয়া ধর্মীয়ভাবে নিষেধ। এটা সবারই জানা। ফলে শাস্তি হিসেবে মুসলমান লস্করদের মুখে শূকরের মাংস ঠেসে ধরা হতো। নানাভাবে অপদস্থ ও অপমানিত করা হতো লস্করদের। অপমান করার এ চর্চা সবসময় যে শাস্তি হিসেবে দেয়া হতো, তা কিন্তু না। মাঝে মাঝে দেয়া হতো নিছক নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য। তবে লস্করেরা যে সবসময়ই চুপ থেকেছে তা নয়। বিভিন্ন সময়ে অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে শিখেছে ধীরে। ‘দ্য ডেইলি মেইল’-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯০৭ সালে ৪৯ জন লস্কর বাকিংহাম প্যালেসে রাজার কাছে অভিযোগ করেন জোরপূর্বক শ্রম আদায়ের। ১৯২১ সালে ৩৬ জন লস্কর এক যোগে ক্যাপ্টেনের কথা অমান্য করে। আরো কিছু সহিংস কিন্তু যৌক্তিক প্রতিবাদের নমুনা দেখা যায় পরবর্তী সময়ে। তখন অবশ্য ভাষা একটা সীমাবদ্ধতা ছিল। সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ক্রমে লস্কররা ইংরেজিতে দক্ষ হতে থাকে। যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে থাকে স্থানীয় ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে। ব্রিটেন হয়ে উঠতে থাকে ভারতীয়দের আরেক আবাসভূমি। যা সূচনা করেছে ব্রিটিশ ভূমিতে ভারতীয়দের ইতিহাস।