বাংলার ‘দ্বিতীয় নবাব’ শমসের গাজী
এখানে আসিয়া কবি শেখ মনোহর ভনে
শমসের গাজী ভাটির বাঘ জানুক জনে।
—গাজীনামা, শেখ মনোহর
ইসফানদিয়র আরিওন : অভিজাত ইতিহাসের উত্তরাধিকারী নয় বলে বাঙালি মুসলমানের একপ্রকার বদনাম রয়েছে। অবশ্য সে বদনামের আট আনা তার নিজেরই কর্মফল। বাংলার ভূমিতে যেসব বীর যোদ্ধা ও শাসকদের উত্থান ঘটেছিল তাদের সম্পর্কে বিপুল গবেষণা করে তারা সে বদনাম ঘুচাতে পারত। কিন্তু তেমন উদ্যোগ কোথায়? সময়ের বহমানতায় এবং ঐতিহ্যের প্রতি অবহেলায় অতীত সে ইতিহাস জাতি আজ হারিয়ে ফেলেছে। মাটির বীরপুরুষদের কথা আজ তারা ভুলতে বসেছে। বঙ্গভূমির পূর্বদিকের মাটিতে এমনই এক ক্ষণজন্মা অমিততেজ বীরপুরুষ শমসের গাজী। নবাব আলিবর্দি খান তাকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘ছানি নবাব’ তথা দ্বিতীয় নবাব।
বাংলাদেশের বর্তমান ফেনী জনপদটি সুলতানি আমল থেকে তিনটি বড় আয়তনের পরগনায় বিভক্ত ছিল—রতননগর, দাঁদরা ও যুগিদিয়া। রতননগর পরগনাটির নাম পরিবর্তিত হয়ে মোগল আমলে চাকলা রোশনাবাদ হয়। ছাগলনাইয়া, পরশুরাম ও ফুলগাজী থানা মিলে এই রোশনাবাদ পরগনাটি ছিল। এর দক্ষিণের কয়েকটি তালুক নিয়ে অষ্টাদশ শতকের শুরুতে দক্ষিণশিক নামে একটি ক্ষুদ্র পরগনা আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমান ছাগলনাইয়ার অধিকাংশ স্থান এই দক্ষিণশিক পরগনার অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে নিজকুঞ্জরা নামে একটি গ্রাম আছে (যা এখনো এই নামে বর্তমান)। সেখানে শমসের গাজী আনুমানিক অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে জন্মগ্রহণ করেন।
শমসের গাজীর পিতা পেয়ার (মতান্তরে পীর) মোহাম্মদ অবশ্য দক্ষিণশিকের বাসিন্দা ছিলেন না। তিনি ওমরাবাদের বজরা কাচারির কর্মকর্তা ছিলেন। বজরা বর্তমানে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার অধীন একটি গ্রাম। সেখানে আর্থিক দুরবস্থায় পতিত হলে সচ্ছলতার সন্ধানে তিনি ফেনীর দিকে বেদরাবাদ পরগনায় এসে আশ্রয় নেন। কিন্তু বঙ্গদেশে বিরাজমান দুর্ভিক্ষ সেখানেও হানা দেয়। ফলে সেখান থেকে তিনি দক্ষিণশিক পরগনায় চলে এলেন। এখানে জমিদার নাছির মোহাম্মদ তাকে স্ত্রী কৈয়ারা বিবি, জ্যেষ্ঠ পুত্র গোলাম আলী (নাবালক) ও ভ্রাতুষ্পুত্র ছাদুসহ নিজকুঞ্জরা গ্রামে থাকতে অনুমতি দেন। এই গ্রামটি ফেনী নদীর পাড়ে এবং রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ছিল। এর উত্তর ও পূর্ব দিকে ত্রিপুরা রাজ্যের রঘুনন্দন পাহাড়, দক্ষিণে ফেনী নদী ও পশ্চিমে বেদরাবাদ পরগনার অবস্থান ছিল।
শমসের গাজী শৈশবে পিতৃহারা হন। স্থানীয় তালুকদার জগন্নাথ সেন তাকে অপত্যস্নেহে লালন-পালন করেন। তিনি তালুকদারের কাছে তার শুভপুর তালুকে বেড়ে ওঠেন। এখানে তার অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ লাভ হয় এবং অকুতোভয় সাহসিকতার কথা আশপাশের দশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি তিনি লিখতে-পড়তে শেখেন। অপুত্রক তালুকদার জগন্নাথ সেন তাকে খাজনা আদায়, বার্ষিক পুণ্যাহ অনুষ্ঠানসহ নানাবিধ প্রশাসনিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এভাবে জমিদারি পরিচালনা সম্পর্কে তিনি সম্যক অবহিত হন। তালুকদার তাকে বসবাসের জন্য নিজ তালুকের জগন্নাথ-সোনাপুর গ্রামে কিছু জমিজমা প্রদান করেন। এর ক্ষণকাল পরে জগন্নাথ তালুকদার মৃত্যুবরণ করলে দক্ষিণশিকের জমিদার নাছির মোহাম্মদ শমসের গাজীকে জগন্নাথ সেনের স্থলাভিষিক্ত করেন। এভাবে গাজী শুভপুরের তালুকদার হয়ে যান এবং পরবর্তী সময়ে কালক্রমে ত্রিপুরার রাজনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ন্তারূপে আবির্ভূত হন।
জমিদার নাছির মোহাম্মদের এক পুত্র ছিল শমসের গাজীর বন্ধু। তার সঙ্গে দেখা করতে গাজী প্রায় জমিদারবাড়িতে যাওয়া-আসা করতেন। এমন গমনাগমনের প্রাক্কালে জমিদারের কন্যা দরিয়া বিবি (দৈয়্যা বিবি)-কে গাজী দেখতে পান ও তার প্রেমে পড়েন। শমসের গাজী জমিদারের কাছে দরিয়া বিবিকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে জমিদার নাছির মোহাম্মদ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে যান। গাজী বিষয়টি আঁচ করে তত্ক্ষণাৎ বেদরাবাদে চলে যান। তাকে শাস্তিদানের জন্য জমিদার কয়েক হাজার সৈন্য প্রেরণ করলে তারা প্রত্যেকে পরাহত হয়ে চলে আসে। বারবার আক্রমণের মুখে অগত্যা গাজী বেদরাবাদ ও আশপাশের এলাকা থেকে কিছু লাঠিয়াল বাহিনী সংগ্রহ করে শুভপুর ও ঘোপাল এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় কৃষকরা তাকে সমর্থন করেন। জমিদার কর্তৃক অপমান এবং উপরন্তু বারবার আক্রমণ গাজীকে মানসিকভাবে আহত করে। তাই তিনি তার লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে বাঁশপাড়ায় জমিদারবাড়ি আক্রমণ করে দৈয়্যা বিবিকে হস্তগত করতে মনস্থির করেন। এ সময় শমসের গাজীর বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিল ছাদু পালোয়ান। জমিদারের পক্ষ থেকে রতন দেওয়ান গাজীর লাঠিয়াল বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে। বাঁশপাড়ায় সংঘটিত এ যুদ্ধে অনেকেই হতাহত হয় এবং নাছির মোহাম্মদ স্বয়ং নিহত হন। দৈয়্যা বিবি সপরিবারে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে মুহুরী নদীতে ডুবে মারা যান। উক্ত নদীর তীরে দৈয়্যাবিবির ঘাট, দৈয়্যাবিবির হাট প্রভৃতি দরিয়া বিবির স্মৃতি বহন করছে।
অবশ্য এমনটা নিশ্চয়ই শমসের গাজী মনেপ্রাণে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন প্রেমাস্পদকে পেতে। কিন্তু নিয়তি তার এই চাওয়াকে চিরকালের জন্য অসম্ভব করে দিয়েছিল এবং তার জীবনের গল্পকে ভিন্নপথে প্রবাহিত করেছিল। বাঁশপাড়ার জমিদারের জমিদারি, ধনরত্ন ও অস্ত্রশস্ত্র তার হাতে চলে এলে তিনি প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হন। এভাবে সময় তাকে অনাগত সময়ের জন্য তৈরি করে। এ জমিদারি লাভের ঘটনা আনুমানিক ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দের।
দেওয়ান রতন চৌধুরী হূত জমিদারি উদ্ধার করতে ত্রিপুরা রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী উদয়পুরে গিয়ে উপস্থিত হন। ত্রিপুরার মহারাজা জগতমাণিক্য তদীয় অমাত্য জয়দেব নারায়ণ ও সেনাপতি দর্পনারায়ণের নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্য দক্ষিণশিকে পাঠালেন। শমসের গাজী কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না। ভবিষ্যৎ আক্রমণের আগাম আশঙ্কা করে তিনি তার রণকৌশল সাজাতে থাকেন। এর প্রকাশস্বরূপ আশপাশের অঞ্চলের যুবকদের তিনি তার সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দান করেন। ফলে ত্রিপুরার সেনাবাহিনী তার পরগনা আক্রমণ করলে জয়দেব নারায়ণ গাজীর হাতে বন্দি হন। ত্রিপুরার রাজাধিরাজ অন্য উপায় না দেখে দক্ষিণশিকের জমিদারির সনদ শমসের গাজীর নামে প্রেরণ করেন। গাজীও একটি কবুলিয়তনামা মহারাজার কাছে পাঠান। এভাবে শমসের গাজী দক্ষিণশিকের বৈধ জমিদাররূপে আত্মপ্রকাশ করেন।
অতঃপর স্বাধীনচেতা গাজী নিজ রাজ্যে প্রজাদের উন্নয়নে মনোযোগ দেন। সমাজের সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং চুরি-রাহাজানি থেকে প্রজাদের জানমালের নিরাপত্তা প্রদান করতে তিনি সচেষ্ট হন। পাশাপাশি কৃষকদের উন্নয়নে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বর্ষাকালে ত্রিপুরার পাহাড় থেকে আগত ঢলে এই এলাকায় বন্যা হতো এবং ফসলের নিদারুণ ক্ষতি হতো। ফেনী নদীর আঁকাবাঁকা চলন কেটে সোজা করতে কাটাগঙ্গা নামে তিনি নতুন গতিপথ খনন করেন। প্রজা ও কৃষকদের উন্নয়নে কাজ করতে তিনি তাদের এক বছরের খাজনা মওকুফ করে দেন এবং পরবর্তী তিন বছরে ত্রিপুরারাজকে তিনি কোনো কর দিতে পারবেন না বলে ঘোষণা করেন। এ বার্তা নিয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গোলাম আলী উদয়পুর গেলে মহারাজা গোলাম আলীকে বন্দি করে রাখেন। কিন্তু গোলাম আলী পালিয়ে দক্ষিণশিকে চলে আসেন। এর ফলে উদয়পুর ও দক্ষিণশিকের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে।
ত্রিপুরার রাজা জগতমাণিক্য মনে করেছিলেন, খাজনা না দেয়াটা গাজীর বাহানামাত্র। তাই তিনি সাত হাজার সৈন্যের বিশাল একটি উপজাতি বাহিনী প্রেরণ করেন। গাজীর নিকট তৎকালে ছয় হাজার সৈন্য ছিল বলে মনে করা হয়। উভয় পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধে আশপাশের জমিদাররা শমসের গাজীকে রসদ, লস্কর ও অস্ত্র দিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। তার বাহিনী পাঠানগড় থেকে যুদ্ধ করতে করতে খণ্ডলের কিল্লার দিঘির পাড়ে উপস্থিত হয়। এখানে উভয় পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ চলে এবং ত্রিপুরার সেনাবাহিনী পালিয়ে যেতে শুরু করে। গাজীর বাহিনী পলায়নরত সেনাদের ধাওয়া করতে করতে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরে উপনীত হয়। মহারাজা স্বয়ং প্রাণভয়ে ভীত হয়ে উদয়পুর ছেড়ে দেবতামুড়া নামক এক গিরিগুহায় আত্মগোপন করেন। রাজ্যবিস্তারে শমসের গাজীর তেমন মনোযোগ ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন প্রজাদের মঙ্গল করতে। কিন্তু ঘটনাক্রমে তিনি ওপরে বর্ণিত খণ্ডলের তৃতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়ে বসেন। উদয়পুরসহ তদীয় উত্তরে অবস্থিত সিলেটের শমসেরনগর পর্যন্ত তার রাজ্যের সীমা বিস্তৃত হয়। আগে ত্রিপুরা রাজ্যের কাঞ্চনপুরের পেঁচারথাল পর্যন্ত তার সীমানা প্রসারিত ছিল। পরে ভুলুয়া পরগনাও তার হস্তগত হয়।
ত্রিপুরা অধিকার করলেও তিনি সেখানে অবস্থান করতে তেমন একটা পছন্দ করতেন না। তিনি পরাজিত মহারাজার এক ভ্রাতুষ্পুত্রকে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসান। মুর্শিদাবাদের নবাবদের অনুকরণে তিনি সেখানে ফৌজদার, দেওয়ান ও নিজস্ব প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। তিনি তৎকালে মুর্শিদাবাদের নবাবের রাজকোষে বার্ষিক ১৩,৬০০ টাকা রাজস্ব প্রদান করতেন। প্রশাসনিক প্রয়োজনে তিনি মুর্শিদাবাদের নবাবের ঢাকার নায়েব-নাজিম হোসাইন উদ্দিন খানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট হন। হোসাইন উদ্দিন খানকে তিনি স্বীয় কন্যা দান করেন।
১৭৫২-১৭৫৪ সালে এসলামাবাদের (চট্টগ্রাম) নায়েব-নাজিম ছিলেন আগা বাকের খান। তিনি মূলত হোসাইন উদ্দিন খানের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এবং ঢাকার নায়েব-নাজিম হওয়ার গুপ্ত ইচ্ছা পোষণ করতেন। তাই কর্মস্থল এসলামাবাদ হলেও তিনি বেশির ভাগ সময় ঢাকায় অবস্থান করতেন। তিনি নাকি নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্ররোচনায় লালবাগ কেল্লায় ঘুমন্ত অবস্থায় হোসাইন উদ্দিন খানকে হত্যা করেন। এ ঘটনার বছরাধিক পরেই পলাশীর যুদ্ধ হয়।
যা-ই হোক, শমসের গাজীর সঙ্গে আগা বাকেরের শত্রুতা শুরু হয়। কারণ ১৭৫২-৫৩ সালের মধ্যে সংঘটিত মোবারকঘোনা ও কুমিরার যুদ্ধে গাজীর বিজয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অঞ্চল তার করায়ত্তে আসে। আগা বাকের শমসের গাজীর দোর্দণ্ডপ্রতাপের সামনে টিকতে না পেরে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। গাজীর চট্টগ্রাম বিজয় নিয়ে অভূতপূর্ব এসব তথ্য পাওয়া যায় মৌলভি হামিদুল্লাহ খান বাহাদুর রচিত ‘আহাদিসুল খাওয়ানিন’ নামক ফারসি ইতিহাসগ্রন্থে। তার মতে, এ সময়ে চট্টগ্রামে শমসের গাজীর রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
এদিকে হোসাইন উদ্দিন খানের মৃত্যুর পর ঢাকার নায়েব-নাজিম হন জসরত খান। তিনি ইংরেজদের পদলেহনকারী ছিলেন এবং গাজীকে পরাস্ত করতে সৈন্য প্রেরণ করেন। কুমিল্লার নবীনগরে এ বাহিনী গাজীর হাতে পরাজিত হয়। এভাবে একের পর এক যুদ্ধ জয় করে তিনি অমিততেজা হয়ে ওঠেন। ফেনী নদীর মোহনায় ইংরেজরা এ সময়ে বাণিজ্য কুঠি বিস্তার ও বস্ত্র কারখানা স্থাপনে তত্পর হয়। কিন্তু শমসের গাজীর এমন অপ্রতিরোধ্য উত্থান ইংরেজদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। কারণ এরই মধ্যে মুর্শিদাবাদের মসনদ চাখনাচুর হয়ে গেছে। শমসের গাজীকে বাড়তে দেয়া মানে হলো ব্রিটিশ রাজ্যের বর্ধিষ্ণু সীমানায় বিষফোড়া রেখে দেয়া।
আগেই উল্লেখ করেছি, উদয়পুরে বসবাস করতে গাজী চাইতেন না। তবুও নানা সময়ে তিনি সাম্রাজ্যের রাজধানী উদয়পুরে থেকেছেন। কিন্তু তার মন পড়ে থাকত দক্ষিণশিকের রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে জগন্নাথ-সোনাপুরে নির্মিত ভদ্রাসনে। বর্তমানে এটি ছাগলনাইয়ায় অবস্থিত। গাজীর পতন সম্পর্কে দুটো মতবাদ পাওয়া যায়। কাজী মোজাম্মেল হক বিরচিত তিন হাজার বছরের নোয়াখালী গ্রন্থে বলা হয়েছে যে জসারত খাঁ, আগা বাকের ও ত্রিপুরার রাজ্যহারা রাজা কৃষ্ণমণির ষড়যন্ত্রে অদূরদর্শী নবাব মীর কাসিম এই স্বাধীন শক্তিকে চিরতরে মুছে ফেলতে সচেষ্ট হন। কৃষ্ণমণিই ত্রিপুরা রাজ্যের সিংহাসনে আসীন হয়ে গাজীর জগন্নাথ-সোনাপুরের প্রাসাদ তোপের মুখে গুঁড়িয়ে দেন। অন্যদিকে ফেনীর ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা জমির আহমেদ এ বিষয়ে অন্য মত দিয়েছেন। তার মতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনী ইউরোপীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গাজীর প্রধান কেল্লা তথা ভদ্রাসন আক্রমণ করেছিল। উভয় পক্ষে লড়াই বাধে। এক ফাঁকে গাজী শত্রুর হাতে বন্দি হন। ইংরেজরা তখন তার কেল্লা ধূলিসাৎ করে দেয়।
শমসের গাজীর পরিণতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা একমত হতে পারেননি। তিনি বন্দি হয়ে ঢাকায় আনীত হয়েছিলেন। কেউ বলেন, তাকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেখান থেকে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। স্থানীয় কিংবদন্তি হলো, শমসের গাজী পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে। ইংরেজরা তাকে খুঁজে বের করতে বাঁশিওয়ালা নিয়োগ করে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভদ্রাসনে। মোহনবাঁশির টানে তিনি একদিন ছুটে আসেন। ধরা পড়ে যান শত্রুর হাতে। এরপরই ইংরেজ তাকে তোপের মুখে উড়িয়ে দেয়। এভাবেই শমসের গাজীর মতো এক অসামান্য ক্ষণজন্মা বীর ইংরেজ-মোগল-ত্রিপুরারাজ তিন দলের চক্ষুশূল হয়ে চিরজনমের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান। কিন্তু ইতিহাসের প্রতি বাঙালি মুসলমানের এত অবহেলা সত্ত্বেও তিনি আর্তচিৎকার হয়ে বেঁচে আছেন রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে ধ্বংসপ্রাপ্ত গড়খাই আর একখুইল্লা সুড়ঙ্গের নয়নাভিরাম জগন্নাথ-সোনাপুর গ্রামে।