নির্বাচনের আগে প্রশাসনে থাকা চিহ্নিতদের সরানোর পরিকল্পনা, চলছে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : চলতি বছরের শেষে বা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। সে হিসেবে বর্তমান সরকারের মেয়াদ রয়েছে প্রায় ১০ মাস। তার আগেই সরকার প্রশাসনে বড় রদবদলের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতোমধ্যে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে মাঠ প্রশাসনে কর্মরত জেলা প্রশাসক (ডিসি), জেলার পুলিশ সুপার (এসপি), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) তালিকা নিয়ে বিশ্লেষণ শেষ হয়েছে। তাদের পারিবারিক, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এমনকি যারা নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরে প্রধান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন, তাদের সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এদের অনেকেই বিএনপি সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা। অনেকের পারিবারিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। তাদের চূড়ান্ত তালিকা সরকারের কাছে রয়েছে। নির্বাচনের আগে এসব কর্মকর্তাকে মাঠ প্রশাসন থেকে সরিয়ে আস্থাভাজনদের নিয়োগ দেওয়ার মতামত দিয়েছেন সরকারের আস্থাভাজন একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা। এরই অংশ হিসেবে সরকার জনপ্রশাসনে রদবদল শুরু করতে যাচ্ছে।
চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে অথবা মার্চের প্রথম সপ্তাহে ফিটলিস্টে থাকা ২৭ ব্যাচের উপসচিবদের নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে দেড় ডজনের বেশি ডিসি প্রত্যাহার করা হবে। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ জেলায় ডিসির রদবদল আনা হবে। গোয়েন্দা তথ্যে যাদের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিবেদন এসেছে, এমন বেশ কয়েকজন এসপি ও ওসিকে সরিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের সেসব পদে বসানো হবে। একই সঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ শাখায় রদবদল এবং কয়েকজন সচিবের দপ্তরও বদল করা হবে।
সূত্র আরও জানায়, বিভিন্ন জেলায় কর্মরত এসপি ও থানার ওসিদের সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া উপপরিদর্শকদের (এসআই) বিষয়ে ভালোভাবে তথ্য সংগ্রহ করছে গোয়েন্দারা। তাদের মধ্যে যাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য এসেছে, তাদের তালিকা সংশ্লিষ্টদের হাতে রয়েছে।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকার প্রশাসনে যোগ্যদের পদায়নে সচেষ্ট রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারির শেষে অথবা মার্চে নতুন ডিসি নিয়োগ করা হবে। এ নিয়ে কাজ চলছে। তা ছাড়া বিভিন্ন জেলায় কর্মরত ডিসিদের অনেকের মেয়াদ দুই বছরও হয়ে গেছে। তবে সবকিছু যাচাই করে ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগেও যোগ্য এবং মেধাবীদের পদায়ন করা হবে। এক্ষেত্রে রদবদল আনা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৩ সালে বিএনপি সরকারের আমলে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের কাছে বহুল আলোচিত একটি ভবনের পাঠানো তালিকা অনুযায়ী সিভিল ও পুলিশ বিভাগের অনেকের চাকরি হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ মেধার চেয়ে তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনায় চাকরি পেয়েছিলেন। আবার অনেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও মেধা কোটায় কর্মকর্তা হতে পেরেছিলেন। তাদের অনেকেই এখন মাঠ প্রশাসনে ডিসি, এসপি পদে কর্মরত আছেন। কেউ কেউ মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী পদায়ন পেয়েছেন। এমন কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে রাখার বিষয়ে সরকার ইতিবাচক। তবে সরকারবিরোধী মতাদর্শের ডিসিদের সরিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন নীতিনির্ধারকরা।
অন্যদিকে বিএনপি আমলে নিয়োগ পাওয়া এসআইদের অধিকাংশই এখন দেশের বিভিন্ন থানায় ওসি পদে রয়েছেন। তারা এখন সরকারের নির্দেশ মানলেও নির্বাচনের আগে কী ভূমিকা পালন করবেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। কারণ, তাদের অনেকের সেই আলোচিত ভবনের সুপারিশে চাকরি হয়েছিল। তারাই এখন বর্তমান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি ভীষণ প্রীতভাব দেখাচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, তারা কৌশলে সরকারকে বিভাজন করে রাখাসহ নানান কায়দায় স্বার্থ হাসিল করছেন। কর্তব্যে অবহেলা, দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করারও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এসব র্কমর্কতার নাম ও পারিবারিক অবস্থান সম্পর্কে তদন্ত করেই তালিকা করেছে সরকার।
অন্য একটি তথ্য বলছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে খোলস পাল্টে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক কর্মকর্তারাও ‘আওয়ামী সমর্থক’ হয়ে যান। তারাই পরবর্তী সময়ে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। একের পর এক বাগিয়ে নেন পদোন্নতি ও পদায়ন। সেই সুবিধাভোগীরাই এখন সরকারের শেষ সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গোপনে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি আমলে নিয়োগ পাওয়া অনেকেই মাঠ প্রশাসনে ডিসি, এসপি ও ওসি হিসেবে কর্মরত আছেন। আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত তাদের তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সচিব থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের সব পদের কর্মকর্তার তথ্য নেওয়া হচ্ছে।
সূত্র বলছে, জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে পদোন্নতিবঞ্চিত বেশ কিছুসংখ্যক সিভিল ও পুলিশ কর্মকর্তা গোপনে সরকারবিরোধী কাজে সক্রিয় হয়ে উঠছেন। তারা প্রশাসনে জামায়াত-বিএনপি ঘরানার কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। তারা অতীতে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ছিলেন। এদের ওপর সরকারের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। তাদের অনেকের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। এদের চিহ্নিত করে তালিকাও প্রস্তুত রয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশের কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী কার্যক্রমে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে বলে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘তারা বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের তথ্য ফাঁস করে দিয়ে আসছিলেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারের শেষ মেয়াদে একশ্রেণির কর্মকর্তার সরকারি কাজে অসহযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে তারা সমন্বয় করছেন না; যথাযথভাবে দায়িত্বও পালন করছেন না। অথচ তারাই বিভিন্ন মন্ত্রীর প্রীতিভাজন হয়ে আছেন। এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে সরকারের জন্য বুমেরাং হতে পারে।
সূত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ