সুলতানি বাংলার সামরিক বাহিনী
শহিদুল হাসান : মান্যবর প্রয়াত ইতিহাসবিদ সুখময় মুখোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর: স্বাধীন সুলতানদের আমল গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন:
১৩৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে শুরু করে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহের উচ্ছেদ পর্যন্ত পুরোপুরি দুশো বছর বাংলা যে রকম অবিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতা ভোগ করেছিল, তত দীর্ঘদিন ধরে আর কোনো সময় তার স্বাধীনতা স্থায়ী হয়নি। এই দুশো বছর বাংলার ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়। এ সময়ে বাংলার সুলতানগণ নিজেদের যোগ্যতা, শক্তি ও ঐশ্বর্যের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নৃপতিদের অন্যতম হয়ে উঠেছিলেন।
উপর্যুক্ত ভাষ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উষ্মা ও অগ্নি-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও এটি স্বীকার্য যে চতুর্দশ শতকের চতুর্থ দশক থেকে ষোড়শ শতকের মধ্য পর্ব অবধি বাংলার সুলতানগণ দিল্লির পরাক্রমশালী সৈন্যবাহিনীকে মোকাবেলা করেছিল অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে। সমকালীন দিল্লির দরবারি ইতিহাসবিদগণ বিষয়টিকে কৌশলী হস্তে এড়িয়ে গেলেও বাংলার সুলতানদের লেখমালা এবং মুদ্রায় উল্লিখিত শব্দ বা শব্দগুচ্ছে বারংবার রণিত হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ হোসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হোসেন শাহের মুদ্রাকে পাঠকের সমীপে পেশ করা যেতে পারে। তাঁর মুদ্রায় বহুল ব্যবহূত লকবটি (সম্মানসূচক উপাধি) হলো: আল ফাতিহ কামরু-কামতা-জাজনগর-উড়িশ্যা (কামরূপ-কামতা-জাজনগর এবং উড়িশা বিজয়ী)। এটির ঈষৎ পরিবর্তিত কিংবা হুবহু উল্লেখ দেখা যায় এই শাসকের একাধিক শিলালেখতে। ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, সিকান্দর শাহ, রুকনুদ্দিন বারবক শাহ কিংবা নুসরত শাহের সামরিক সাফল্য ইতিহাসে সুবিদিত। বর্তমান লেখায় তাঁদের বীরগাথার পুনরাবৃত্তির কোনো ইরাদা আমার নেই। বাংলার জল-জমিন-শৈলশীলার ভূমিকা কিংবা সুলতানদের সামরিক কৌশলও আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। এ সমস্ত বিষয়ের পাশাপাশি সুলতানদের সামরিক সাফল্যের অন্যতম কারিগর ছিলেন বাংলার সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ। সুলতানদের সামরিক বাহিনীর গঠন-শ্রেণিবিন্যাস ও সৈন্যদের পরিচয়ের বিচ্ছিন্ন সূত্রগুলিই কেবল আমি পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই।
পরিসর বিবেচনায় এ বিষয়ক আকর সূত্রাদির (Primary Source) বিশ্লেষণ পর্বকে বাদ দিতে হলেও এ বিষয়ক সমকালীন লিখিত সূত্রাদির অনুপস্থিতিকে মান্যতা ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ কিংবা নৃবিজ্ঞানীদের পূর্ববর্তী লেখনী ও গবেষণাতে নানাভাবে উঠে এসেছে। সমকালীন লেখমালাই প্রধান ভরসা। কেননা ‘তারিখ’ শিরোনামা গ্রন্থাদির লেখকদের উদ্দেশ্য ছিল দিল্লির সুলতানদের সাতকাহন লিখে যাওয়া— ‘বাংলা’ ছিল তাঁদের মনিবের শত্রু।
আবদুল করিম তাঁর ‘Aspects of Muslim Administration in Bengal down to AD 1538’ (১৯৫৮ সালে প্রকাশিত) গবেষণা নিবন্ধে বাংলার সুলতানদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার নানা দিক তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে এটিকে তিনি সামরিক শক্তিনির্ভর প্রশাসন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। করিমের বিশ্লেষণে বাংলার সালতানাতের প্রশাসনিক কাঠামোই ছিল আধা সামরিক। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী সুলতানগণই ছিলেন সেনাবাহিনীর ‘চিফ’। সৈন্যবাহিনীর ফরমেশন ছিল: (ক) পাইক বা পদাতিক (খ) তিরন্দাজ (গ) গোলন্দাজ (ঘ) অশ্বারোহী (ঙ) হাতি বাহিনী এবং নৌবহর। সামরিক অফিসারদের চৌকস নেতৃত্বে বাংলার সৈন্যবাহিনীকে পরিচালনা করা হতো। সমর কৌশল নির্ধারণ ও সৈন্যবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এবং সামরিক অভিযানের নেতৃত্বে থাকতেন বাংলার সুলতানগণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কখনো কখনো প্রধান সেনাপতি বা অন্য কোনো দক্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতির নেতৃত্বেও সামরিক অভিযান প্রেরণ করার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন পরবর্তী ইলিয়াস শাহী (মাহমুদ শাহী বংশ হিসেবেও সুপরিচিত) শাসক সুলতান রুকনুদ্দিন বারবক শাহ সেনাপতি-সুফি শাহ ইসমাঈল গাজির নেতৃত্বে কামরূপ অঞ্চলে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহও কামরূপ-কামতা অঞ্চলে সামরিক অভিযানে যুবরাজ দানিয়েল এবং বড় উজিরকে (অহমিয়া সূত্রে তাকে বিত্মালিক বা মিত্মালিক বলা হয়েছে) তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সেনাবাহিনীর ‘কমান্ডার ইন চিফ’ করেছিলেন। হোসেন শাহের অন্য তনয় নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহকে চট্টগ্রাম বিজয়ের জন্য সামরিক অভিযানে পাঠিয়েছিলেন।
স্বাধীন সুলতানি পর্বে বাংলার সামরিক বাহিনীর গঠনে স্থানীয় সম্পৃক্ততার প্রমাণ আবদুল করিম, সুখময় মুখোপাধ্যায়, মমতাজুর রহমান তরফদার, সৈয়দ এজাজ হোসেন প্রমুখ ইতিহাসবিদদের গবেষণা ও প্রকাশনায় নানা গড়নে উপস্থাপিত হয়েছে। কেন স্থানীয় জনগোষ্ঠী তুরস্কজাত শাসকদের যুদ্ধযাত্রায় সহযোদ্ধার ভূমিকায় কুণ্ঠিত হয়নি? কেবল চাকরির প্রয়োজনেই কি স্থানীয় জনগণ দিল্লির সাথে যুদ্ধে ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদেরকে সমর্থন করেছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর সমসাময়িক লিখিত গ্রন্থের মধ্যে খোঁজার চেষ্টা ‘অরণ্যে রোদন’-এর নামান্তর। প্রাজ্ঞ ইতিহাসবিদগণ নানা ব্যাখ্যা করেছেন। সুলতানদের উদারতা, মধ্য এশিয়া থেকে সৈন্য আসার প্রক্রিয়ায় বিরতি, স্থানীয়দের মুসলিম হওয়া, বাংলা ভাষার প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা—এসব কারণই পূর্ববর্তী গবেষকদের উপসংহারে পৌঁছানোর অবলম্বন। এগুলির সাথে দ্বিমতের অবকাশ খুবই ক্ষীণ। কেবল পাঠকের অনুসন্ধিত্সু মনের খচখচানি থামানোর জন্য দিল্লির দরবারি লেখক জিয়াউদ্দিন বারানির তারিখ-ই-ফিরুজশাহী গ্রন্থের কিয়দংশের ইংরেজি অনুবাদ নিম্নে দেয়া হলো:
The well-known paiks of Bengal, who, for years, gave themselves name of Abu Bangal (Father of Bengal) and claim to be (heroic) man, took promises before Ilyas … to sacrifice their lives (for him) and standing in front of his (array of horses), together with the Rais of the river-grit bengal, (they) bravely threw about their arms and legs.
উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিতে এটি স্পষ্ট যে বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহের জন্য স্থানীয় পাইক (পদাতিক) সৈন্যরা জীবন দানেও প্রস্তুত। এমনকি বেতনভুক্ত সামরিক শক্তির পাশাপাশি নদীমাতৃক বাংলার রায়গণও (জমিদার) দিল্লির বিরুদ্ধে ইলিয়াস শাহের পক্ষে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। এমন সংবাদের উল্লেখ পাওয়া যায় সমকালীন আরেকটি ফারসি গ্রন্থ তারিখ-ই-মুবারক শাহীতে। লেখক ইয়াহিয়া বিন আহমেদ সরহিন্দি বাংলা-দিল্লির যুদ্ধের বর্ণনায় লিখেন (ইংরেজি অনুবাদ):
On the 27th Rabi’-ul-Awal (755 H. Monday, 21st April 1354 A.D.), the Sultan arrived at the fort of Ikdala, and there was a great battle. The Bengalis were defeated and their casuality was great. Shahadeo, their chief with several others were killed on that day.
যুদ্ধে নিহত সাহদেও নামটি সম্ভবত স্থানীয় অমুসলিম ‘সহদেব’ নামের ফারসিকৃত রূপ। আবদুল করিম সহদেবকে দিল্লির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী স্থানীয় বাঙ্গালিদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করেন। সুলতানের অধীন পরবর্তী সামরিক কর্মকর্তার পদটিই সম্ভবত ‘শর-ই-লস্কর’। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের ১৫০২ খ্রিস্টাব্দের একটি শিলালেখে জনৈক ইউসুফ শাহের সন্তান মজলিশ খানকে শর-ই-লস্কর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো লেখতে উজির-ই-লস্কর শব্দযুথ পাওয়া যায়। সৈয়দ এজাজ হোসেনের মত হলো, সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদের সময় রায় রাজ্যধর ছিলেন শর-ই-লস্কর এবং জালালুদ্দিন ফতেহ শাহের সময় দৌলত খান ছিলেন উজির-ই-লস্কর। যাবতীয় সামরিক বিষয়াদি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল শর/উজির-ই-লস্করের।
স্থানীয় জনগণ স্বদেশাগত তুর্কি-আফগান জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বাংলার সৈন্যবাহিনীতে হাবসিদের উপস্থিতির তথ্য পাওয়া যায় গোলাম হোসেন সলিমের রিয়াজ-উস-সালাতিন গ্রন্থে। পরবর্তী ইলিয়াস শাহী শাসকদের উত্খাতপূর্বক হাবসিদের বাংলা সালতানাত দখল ও শাসনের (১৪৮৭-৯৩) ইতিহাস অজানা নয়। পঞ্চদশ শতকের বাংলার সামরিক শক্তিতে তাদের সরব উপস্থিতির বহিঃপ্রকাশ এটি। সুলতানের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হিসেবে হাবসি সৈন্যদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। গোলাম হোসেন সলিমের ভাষ্যমতে, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ক্ষমতায় এসেই হাবসিদের ক্ষমতা খর্ব করেন। পূর্ববর্তী রাজ দেহরক্ষীদের বরখাস্ত করে নতুন পাইকদের নিয়োগ দেন এবং হাবসিদের বাংলা থেকে তাড়িয়ে দেন।
ইউক্রেন-রাশিয়ার মিসাইল-ক্ষেপণাস্ত্র সমরযুদ্ধের কালে পাঁচ শতাব্দী পূর্ববর্তী পদাতিক-অশ্বারোহী-হস্তী বাহিনীর যুদ্ধের কথকতা পাঠকের কাছে জুতসই হবার কথা নয়; লেখকের প্রত্যাশাও সেটি নয়—এই সদয় স্বীকারোক্তির মাধ্যমেই ইতি টানলাম বাংলার সুলতানদের সামরিক শক্তির সুলকনামা খোঁজার এই প্রয়াসের।
লেখক: শহিদুল হাসান, সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।