অর্থনীতিআলোচিতজাতীয়

মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায়, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১১ শতাংশ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ঢাকায় এক বছরে নাগরিকদের জীবনযাত্রার গড় ব্যয় বেড়েছে শতকরা ১১ ভাগ। এটা আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি। আর এই ব্যয় বাড়ার পিছনে ভোগ্য ও সেবাপণ্যের দাম বাড়াই আসল কারণ।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিশেন অব বাংলাদেশের(ক্যাব) এক জরিপে এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। তারা বলছে, গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১.০৮ ভাগ৷ খাদ্যমূল্যস্ফীতির হার ১০.০৩ শতাংশ এবং খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ১২.৩২ শতাংশ, যা সরকারের হিসাবের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, এখন দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮.৭১ শতাংশ৷ যা ক্যাবের গড় হিসাবের চেয়ে ২.৩৭ শতাংশ কম। ক্যাবের এই হিসাব ২০২২ সালের ১২ মাসের গড়। কোনে কোনো মাসে মূল্যস্ফীতি ১৬-১৭ শতাংশ পর্যন্ত হয়। সেপ্টেম্বরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি হয়েছিলো ১৭.২৫ শতাংশ।

ক্যাব বলছে, ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির চাপে রীতিমতো পিষ্ট হতে হচ্ছে সব শ্রেণীর ভোক্তাদের। গত ৭ সাত বছরের মধ্যে সাধারণ মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে গত গত বছর।

কিছু পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি

ক্যাব তাদের প্রতিবেদনে কিছু পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরে৷ তাতে দেখা যায় কোনো কোনো পণ্যের দাম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে৷ যেমন মোটা চালের দাম গড়ে বেড়েছে ৪.৮৭ শতাংশ, মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ১০.০২ শতাংশ, চিকন চালের দাম বেড়েছে ১৭.২২ শতাংশ৷ গম ও আটার দাম বেড়েছে ২৭.৪৬ শতাংশ, চিনির দাম বেড়েছে ১৪.৫৭ শতাংশ, কাঁচা মরিচের দাম বেড়েছে ৩৮.৬৪ শতাংশ, গোসলের সাবানের দাম বেড়েছে ১৬.৭১ শতাংশ, কাপড় ধোয়া সাবানের দাম বেড়েছে ১৯.২০ শতাংশ, পরিধেয় কাপড়ের দাম বেড়েছে ৬০.৮৪ শতাংশ৷ শিক্ষাখাতে গড়ে ব্যয় বেড়েছে ৩.০৩ শতাংশ৷

ক্যাবের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্যমূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে৷ জ্বালানি মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী সংশোধন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়৷ এটি সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে৷ জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট খাদ্য-বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার দ্রুত অবমূল্যায়ন উৎপাদন খরচ, আমদানিকৃত পণ্যের দাম এবং পরিবহণ খরচ বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, যা মূল্যস্তরের তীব্রতা বৃদ্ধিতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে৷

শহর ও গ্রাম সব খানেই পণ্যের দাম বেড়েছে, যা বাংলাদেশের লাখ লাখ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারের দুর্দশা বাড়িয়েছে৷ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও মন্দাভাব সৃষ্টি হয়েছে এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটেছে৷ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ মানুষের প্রকৃত আয় এবং পারিবারিক কল্যাণ হ্রাস করে৷ এটি বেতনভোগী নিম্ন-মধ্যম এবং মধ্য আয়ের পরিবারের দুর্দশা বাড়িয়ে দেয়৷

ক্যাবের এবারের এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর৷ তিনি জানান, ঢাকার ১১টি বাজার থেকে মাসিক দামের তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে৷ দৈনিক দাম পর্যবেক্ষণে ১৪১টি খাদ্যসামগ্রী, ৪৯টি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং ২৫টি পরিষেবা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে৷

ক্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮.২১ শতাংশ ২০২০ সালে ৬.৮৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে এই হার ছিল ৬.৫ শতাংশ৷ আর ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ও মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিলো ৬ শতাংশ৷ আর ২০২২ সালে রেকর্ড ১১.০৮ শতাংশ৷

বিবিএসের হিসেবে মূল্যস্ফীতি কম হয় কেন?

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘‘বিবিএস ভিত্তি বছর হিসেবে ২০১৫ সালকে ধরে৷ ফলে সেই সময়ের সঙ্গে তুলনা করে৷ তারা ঢাকা শহর এবং ৬৪ জেলা থেকে পণ্যের দাম সংগ্রহ করে তার গড় করে৷ ফলে শহরে উচ্চমূল্যের চাপ প্রতিফলিত হয়না৷ আর তারা পাইকারি ও খুচরা পণ্যের গড় করে৷ ফলে তাদের হিসেবে স্বাভবিক কারণেই মূল্যস্ফীতি কম হয়৷ এটা তাদের হিসাব পদ্ধতির ফল৷ কিন্তু এটা বাস্তব চিত্র নয়৷”

তিনি তার গবেষণায় বলেছেন, ‘‘উচ্চ মূল্য প্রকৃত মজুরি এবং সঞ্চয়কে হ্রাস করে যা নিম্ন আয়ের পরিবারগুলিকে আগের চেয়ে আরও দরিদ্র এবং আরও দুর্বল করে দেয়৷ উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রায়-দরিদ্র পরিবারের একটি অংশকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নিয়ে যায় এবং কিছু দরিদ্র পরিবারকে অতিদরিদ্রে পরিণত করে৷”

তিনি বলেন, ‘‘সারাবছর মূল্যস্ফীতি এক রকম ছিলোনা৷ জুলাই মাস থেকে এটা অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে৷ সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ বাড়ে৷ এরপর কমতে শুরু করে৷ ওই সময় মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়৷”

মানুষ চলছে কীভাবে?

‘‘আমি জরিপ করতে গিয়ে দেখেছি যখন আটার দাম বাড়তে শুরু করে এক পর্যায়ে নিম্ন আয়ের মানুষ আটা খাওয়া ছেড়ে দেয়৷ এখন তারা শুধু কম দামের মোট চাল খায়৷ তাও আগের চেয়ে কমিয়ে দিয়েছে৷ এই অবস্থা প্রায় প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রে,” বলেন ড. মাহফুহ কবীর৷ তার কথা, ‘‘মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মানুষের ফুড বাস্কেটের কী অবস্থা এবং আয়-এই দুইটি বিষয় নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা হওয়া দরকার৷ সেটা হলে মানুষ কতটা চাপে আছে তা স্পষ্ট হবে৷”

আর ক্যাবের সহ-সভপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, নিম্ন আয়ের মানুষ প্রথমে ঋণ করে দ্রব্যমূল্যের চাপ সামাল দিতো৷ এখন আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা এনজিও থেকে তারা ঋণও পাচ্ছে না৷ কারণ আগের ঋণ শোধ করতে পারনি৷ তাই তারা খাদ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে এবং সেসব পণ্যের দাম কম সেগুলো কিনছে৷ অনেকে মাছ-মাংস কেনা ছেড়েই দিয়েছে৷”

‘‘এরফলে স্বাভাবিক কারণেই অপুষ্টি বাড়ছে৷ আমরা এটা নিয়েও একটা গবেষণা করতে চাই৷ সেটা করা গেলে বোঝা যাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবের নেতিবাচক ফল কতটা গভীর হতে পারে,” বলেন এস এম নাজের হোসেন৷

তার কথা, ‘‘এবার আমরা মাস ভিত্তিক আলাদা আলাদা মূল্যস্ফীতির হিসাব করায় চিত্রটা আরো পরিস্কার হয়েছে৷ সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিলো এক মাসে গত বছর৷ এই এক মাসের ধকলই অনেক বড়৷ তাপর কিছুটা কমলেও সেটাও ছিলো অনেক৷ ফলে সারাবছর মানুষকে কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে৷”

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button