দিল্লি যেন শিল্পীর ক্যানভাস
নিজাম আশ শামস : ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ প্রাচীন এক জনপদ দিল্লি। সব শ্রেণীর মানুষের কাছে তা এক মায়ানগর, জাদুর শহর। সুফি দরবেশদের অন্যতম আধ্যাত্মিক কেবলা। আর অনুরাগীদের কাছে এ শহর পুরো পৃথিবীর কেন্দ্র।
মির্জা গালিবের কবিতায় তারই প্রতিধ্বনি—
‘এক রোজ রুহ ছে পুছা কি দিল্লি কিয়া হ্যায়,
তো ইয়ুঁ জওয়াব ম্যায় কেহ গ্যায়ি,
ইয়ে দুনিয়া মানু জিসম হ্যায়, আউর দিল্লি উসকি জান।’
(একদিন আমি আমার রুহকে প্রশ্ন করলাম, দিল্লি কী? তখন সে আমাকে উত্তর দিল—এ দুনিয়া হলো শরীর আর দিল্লি তার প্রাণ।)
দিল্লি বলতে যে চিত্র আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে, তার যাত্রা শুরু মুসলমান শাসকদের হাত ধরে। সুলতানি ও মোগল শাসনামলজুড়ে তিলে তিলে নির্মিত হয় তিলোত্তমা এ নগরী। মোগল আমলে দিল্লি শহর কীভাবে গড়ে উঠেছে তার ওপর আলোকপাত করা হবে।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। উপমহাদেশে শুরু হয় মোগল শাসনামল। আগ্রা ও দিল্লি হয়ে ওঠে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। ভারতীয় এবং ইসলামী সংস্কৃতির মিশ্রণে গড়ে ওঠে মোগল স্থাপত্যরীতি। পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিয়ে আসা হয় গুণী স্থপতি ও দক্ষ কর্মীদের। তৈরি হয় যুগান্তকারী সব নিদর্শন। সে সকল মোগল স্থাপত্যকর্ম অদ্যাবধি দেশ-বিদেশের পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে টিকে আছে স্বমহিমায়। মোগলদের স্থাপত্যকর্মে প্রধান উপকরণ হিসেবে লাল বেলে পাথর এবং শ্বেত মার্বেল পাথরের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। দেয়ালগুলোতে উত্কীর্ণ থাকত পবিত্র কোরআনের লিপি। এছাড়া ফারসি কবিতা খোদাই করা থাকত। দিল্লিতে মোগল স্থাপত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য নমুনা হলো সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি। ১৫৫৮ সালে হুমায়ুনের প্রথম ও প্রধান মহীষী সম্রাজ্ঞী বেগা বেগমের পৃষ্ঠপোষকতায় তা নির্মিত হয়। সমাধিটির নকশা করেন বেগা বেগমের মনোনীত পারস্য স্থপতি মিরাক মির্জা গিয়াস ও তার পুত্র সাইয়্যিদ মুহাম্মদ। ভারতবর্ষে এটি হলো প্রথম সমাধিসৌধ, যেখানে প্রচুর পরিমাণে লাল বেলে পাথর ব্যবহূত হয়েছিল। সমাধি এলাকায় মূল কবরটি সম্রাট হুমায়ুনের। তাছাড়া এখানে সম্রাজ্ঞী বেগা বেগম, হামিদা বেগম, দারা শুকোসহ পরবর্তী কয়েকজন মোগল সম্রাট এবং অভিজাতদের কবর আছে। ৩০ একর এলাকাবিশিষ্ট একটি চারবাগের কেন্দ্রে সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিটি অবস্থিত। চারবাগ বলা হয় পারস্য রীতিতে নির্মিত চতুর্ভুজাকৃতির বাগানকে। ভারতবর্ষে বাগান বেষ্টিত প্রথম সমাধি এটি। সমাধিটিকে ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে। তবে দিল্লির সঙ্গে যার নাম জড়িত, তিনি সম্রাট শাহজাহান। দিল্লিতে তিনি নতুন রাজধানী নির্মাণ করেন। নাম দেন শাহজাহানাবাদ। ১৬৩৯ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে এখানে নতুন কেল্লার নির্মাণকাজ শুরু হয়। নয় বছরে কাজ সম্পন্ন হয়। ১৬৪৮ সালের ১৯ এপ্রিল সম্রাট শাহজাহান নতুন কেল্লায় প্রবেশ করেন। তিনি শাহজাহানাবাদকে মোগল ভারতের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। সম্পূর্ণ শহর একটি পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরাও ছিল। দেয়ালটির উচ্চতা ২৭ ফুট, পুরুত্ব ১২ ফুট আর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় চার মাইল। শহরে প্রবেশের সাতটি শাহি দরওয়াজা ছিল। এগুলো হলো কাশ্মীরি দরওয়াজা, মোরি দরওয়াজা, কাবুলি দরওয়াজা, লাহোরি দরওয়াজা, আজমেরি দরওয়াজা, তুর্কমানি দরওয়াজা ও আকবরাবাদি দরওয়াজা। কেল্লার বাইরে ছিল একটি সুবৃহৎ এবং প্রাণবন্ত শহর। প্রশস্ত রাস্তা, সুপরিসর চক, খোদাইকৃত বাজার এবং আবাসিক এলাকা ও সুদৃশ্য বাগানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে শহরটি। শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত ছিল একটি খাল, যা যমুনা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। শাহজাহানের বড় কন্যা জাহানারা বেগম তার মা মমতাজ মহলের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রভূত সম্পত্তি লাভ করেছিলেন। তা দ্বারা তিনি একটি অষ্টভুজাকৃতির চক নির্মাণ করেন। এর ঠিক মধ্যভাগে ছিল একটি জলাশয়। পূর্ণিমা রাতে সে জলাশয়ের পানিতে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হতো। তাই জায়গাটি চাঁদনী চক নামে পরিচিতি লাভ করে। শাহজাহান তার তৃতীয় স্ত্রী ইজ্জুননেসাকে উপহার হিসেবে একটি বাগান নির্মাণ করে দেন। শহরের পশ্চিম দিকে বাগানটি অবস্থিত ছিল। এর নামকরণ করা হয় ‘শালিমার বাগ’। পরবর্তী সময়ে ইজ্জুননেসা নিজ খরচে বাগানের ভেতর একটি সরাইখানা নির্মাণ করেন। শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত কেল্লা থেকে সম্রাট শাহজাহান তার শাসন চালাতেন। তখন তা ‘কেল্লা এ মোয়াল্লা’ (মহিমান্বিত কেল্লা) নামে অভিহিত হতো। বর্তমানে তা ‘লাল কেল্লা’ নামে সুপরিচিত। কেল্লার ঠিক বাইরে নির্মিত হয় দিল্লির জামে মসজিদ। ১৬৫৬ সালের মধ্যে মসজিদটির নির্মাণ সমাপ্ত হয়। এটি মোগল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় জামে মসজিদ। তা নির্মাণে মূলত লাল বেলে পাথর ব্যবহার করা হয়। কিছু শ্বেত মার্বেল পাথরের ব্যবহারও আছে। পাঁচ হাজার শ্রমিকের শ্রমে নির্মিত হয় মসজিদটি। মসজিদটির চারপাশের এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠে বিভিন্ন মহল্লা এবং কাটরা। এগুলোর নামকরণ হয়েছিল তাদের অধিবাসীদের নামে। চুড়ি, বালার কারিগররা যেখানে বাস করত সেটির নাম ছিল ‘চুড়িওয়ালা’, কসাইরা যেখানে বাস করত তার নাম হয় ‘কাসসাবপুরা’ ইত্যাদি। দিল্লির অন্যতম পুরনো বাজার চাঁদনী চক। এটি একটি ব্যস্ত পাইকারি বাজার। বর্তমানে দেয়ালঘেরা শহরের মাঝবরাবর, লাল কেল্লার লাহোরি দরওয়াজা থেকে ফতেহপুরি মসজিদ পর্যন্ত বিস্তৃত সোজা যে রাস্তাটি আছে, তা চাঁদনী চক নামে পরিচিত। রাস্তাটি তিনটি বাজারে বিভক্ত। লাহোরি দরওয়াজা থেকে চক কোতোয়ালি পর্যন্ত অংশকে বলা হয় উর্দু বাজার। চক কোতোয়ালি থেকে চাঁদনী চক পর্যন্ত অংশ জোহরি বাজার নামে পরিচিত। আর চাঁদনী চক থেকে ফতেহপুরি মসজিদ পর্যন্ত বিস্তৃত অংশের নাম ফতেহপুরি বাজার। সব ধরনের পণ্য এবং খাবারের প্রাপ্তিস্থল বাজারটি দিল্লির অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন। লাল কেল্লার বিপরীত পাশে বাজারটি অবস্থিত। এ বাজারে অবস্থিত ফতেহপুরি মসজিদ। সম্রাট শাহজাহানের এক স্ত্রী ফতেহপুরি বেগম মসজিদটি নির্মাণ করেন। শাহজাহানাবাদে অবস্থিত মোতি মসজিদ সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে নির্মিত হয়। ১৬৬৩ সালে মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। এটি আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত প্রার্থনা ঘর হিসেবে ব্যবহূত হতো। দিল্লিতে মোগলদের নির্মিত সর্বশেষ স্থাপত্যকর্মটি হলো ‘জাফর মহল’। এটি মেহরৌলির কেন্দ্রে অবস্থিত। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পর পরাক্রমশালী মোগল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। বিপরীতে উত্থান ঘটে উর্দু কবিতার। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে দিল্লির উর্দু কবিদের মধ্যে মির্জা মুহাম্মদ রাফি সওদা, মীর তকি মীর, খাজা মীর দার্দ, মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব, মোমিন খান মোমিন, শায়খ মুহাম্মদ ইব্রাহিম জওখ, নবাব মির্জা খান দাগ দেহলভী, সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নাম উল্লেখযোগ্য। মোগল ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে তারা বিলিয়েছিলেন কবিতার সৌরভ। দিল্লির সৌন্দর্যে অভিভূত মীর তকি মীর লিখেছেন,
‘দিল্লি কে না থে কুচে, আওরাক-এ-মুসাব্বার থে,
যো শকল নজর আয়ি, তাসবির নজর আয়ি।’
(এগুলো দিল্লির রাস্তা নয় বরং শিল্পীর ক্যানভাস; যা কিছু দেখি, সবই যেন ছবি।)
শায়খ ইব্রাহিম জওখের কবিতায় দিল্লি এসেছে এভাবে—
‘হামনে মানা কেহ্ দাক্কান মে হ্যায় বহুত কদর-এ-সুখন,
কৌন যায়ে জওখ পর দিল্লি কি গলিয়াঁ ছোড় কর!’
(মেনে নিচ্ছি যে দাক্ষিণাত্যে কাব্যের মর্যাদা বেশি; কিন্তু দিল্লির প্রিয় গলি ছেড়ে কে যেতে চায়!)
আবার চোখের সামনে প্রিয়তমা দিল্লিকে বিবর্ণ হতে দেখার হাহাকারও ফুটে উঠেছে তাদের কবিতায়। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কবিতায় যেমনটা এসেছে—
‘নেহি হাল-এ-দিল্লি সুনানে কে কাবিল,
ইয়ে কিসসা হ্যায় রোনে আউর রোলানে কে কাবিল।’
(শোনানোর মতো কোনো অবস্থা দিল্লির নেই; যা আছে তা কেবল কান্নার উদ্রেক করে।)
তবু প্রেমিকের কাছে দিল্লির আবেদন চিরন্তন। সুলতানি আমলে দিল্লির বিখ্যাত ফার্সি কবি আমির খুসরোর কালামে যেন সেই সুর—
‘আগর ফিরদৌস বর রুয়ে যমিন আস্ত,
হামিন আস্ত, হামিন আস্ত, হামিন আস্ত।’
(যদি দুনিয়ার কোথাও স্বর্গ থেকে থাকে, তবে তা এখানেই, এখানেই, এখানেই।)
লেখক ও অনুবাদক : নিজাম আশ শামস