গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর এক বছরে বাংলাদেশে ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। চলতি বছরের ১২ মাসে তিনটি ক্রসফয়ারের ঘটনা ঘটেছে বলে মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।
এর আগের বছর ২০২১ সালে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ৫১ জন। চলতি বছরের সঙ্গে গত বছরের তুলনা করলে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনা শতকরা ৯৪ ভাগ কমে গেছে।
অবশ্য চলতি বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মোট ১৮ জন মারা গেছেন। ‘ক্রসফায়ার’ এর তিনজন বাদে বাকি ১৫ জন নির্যাতনসহ আরো কয়েকটি কারণে মারা গেছে বলে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়। আর যারা মারা গেছেন তারা সবাই র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন বলে জনানো হয়েছে।
এই তিনজনের মধ্যে দুইজন গ্রেপ্তারের আগে এবং একজন গ্রেপ্তারের পরে নিহত হন।
নিষেধাজ্ঞার আগে-পরে
গত বছরের (২০২১) ১০ ডিসেম্বর পুলিশ ও র্যাবের সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞারচার মাস পর চলতি বছরে প্রথম ‘ক্রসফায়ার’এর ঘটনা ঘটে। গত ১৭ এপ্রিল রাতে কুমিল্লার সদর আদর্শ উপজেলার গোলাবাড়ি এলাকায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রাজু নামে একজন নিহত হন। তিনি সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈম হত্যার আসামি। মহিউদ্দিন সরকারকে গত ১৩ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে ডেকে নিয়ে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সীমান্ত এলাকায় দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে।
এরপর গত ১৯ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে কক্সবাজারের টেকনাফে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মোহাম্মদ মুবিন নামে একজন ‘মাদক কারবারি’ নিহত হন। র্যাবের দাবি, নিহত যুবক একজন মাদক কারবারি। ঘটনাস্থল থেকে দুই লাখ ২০ হাজার ইয়াবা, একটি বিদেশি পিস্তল, ম্যাগাজিন ও চারটি গুলি উদ্ধার করা হয়। আর গত ১০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শাহীন মিয়া ওরফে সিটি শাহীন নামে এক ‘‘তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী’’ নিহত হন। ওই দিন দুপুরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর বিকেলে ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
আসক বলছে, ২০২১ সালে ‘ক্রসফায়ারে’ মোট নিহত হন ৫১ জন। তাদের মধ্যে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩০জন নিহত হন। তাদের ২৮ জন নিহত হন গ্রেপ্তারের আগে এবং দুই জন গ্রেপ্তারের পরে। পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান পাঁচজন। এরা সবাই গ্রেপ্তারের আগে নিহত হন৷ ডিবির সঙ্গে চার জন। তিনজন গ্রেপ্তারের আগে এবং একজন গ্রেপ্তারের পরে। বিজিবির সঙ্গে ১২ জন৷ এরা সবাই গ্রেপ্তারের আগে নিহত হন।
২০২০ সালে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে মোট ১৮৮ জন নিহত হন৷ তাদের মধ্যে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ৬০ জন। পুলিশের সঙ্গে ৯০ জন। ডিবির সঙ্গে ১৩ জন এবং বিজিবির সঙ্গে ২৫ জন। ২০১৯ সালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মোট নিহত হন ৩৫৬ জন। তাদের মধ্যে র্যাবের সঙ্গে ১০১ জন, পুলিশের সঙ্গে ১৭২ জন, ডিবির সঙ্গে ৩০ জন, যৌথ অভিযানে একজন, কোস্ট গার্ডের সঙ্গে একজন এবং বিজিবির সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে ৫১ জন নিহত হন।
কিন্তু চলতি বছরে র্যাব ছাড়া অন্য কোনো বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কেউ মারা যাননি।
‘ক্রসফায়ার’ কমার নেপথ্যে কী?
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) সাধারণ সম্পাদক নূর খান মনে করেন, ‘‘গত ডিসেম্বরে র্যাব ও র্যাবের যারা পরে পুলিশে কর্মরত ছিলেন তাদের কয়েকজনের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এটা এক বছরে তিন জন বলা হলেও চার বা পাঁচজনও হতে পারে। সেটা হলেও অনেক কমে গেছে৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো আমরা মানবাধিকার কর্মীরা যখন এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হই তখন তা আমলে নেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত যেতে হলো। এটা আমাদের নিজেদেরই বন্ধ করা উচিত ছিলো। তা না করে বিদেশি চাপে করা হলো।’’
তার কথা, ‘‘শুধু ক্রসফায়ার নয়। গুম, অপহরণসহ আরো যেসব অপরাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িয়ে পড়েছিলো তাও কমে আসছে। কেউ নিখোঁজ হলে ছয়-সাত দিনের মধ্যেই তাকে আবার পাওয়া যাচ্ছে।’’
তবে তিনি মনে করেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যপদ্ধতি বা আচরণে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। যা ইতিবাচক হচ্ছে তা চাপের মুখে। সরকার এখনো এমন কোনো পদ্ধতি তৈরি করেনি যাতে ভবিষ্যতে এটা আর হবে না তেমন আশা করা যায়। যারা এইসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনারও কোনো ইচ্ছা সরকারের আছে বলে এখনো স্পষ্ট হয়নি। সেটা প্রয়োজন। প্রয়োজন স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে দায়ীদের চিহ্নিত করা। মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের পরও কয়েক মাস ক্রসফায়ার বন্ধ থেকে আবার শুরু হয়। তাই ক্রসফয়ার যে আবার শুরু হবে না তা কিন্তু এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’’
রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে
বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয়া বা না দেয়া বড় কথা নয়। রাষ্ট্রকেই মানবাধিকারের বিষয়গুলো দেখতে হবে। রাষ্ট্র বিষয়গুলো তার প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেখবে এটাই তো সবাই প্রত্যাশা করে। তবে এটা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা সরকারসহ সব পক্ষকে সচেতন করে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা একটি রাষ্ট্রের জন্য জরুরি।’’
তার কথা, ‘‘মানবাধিকার কমিশন এখন প্রতিটি ঘটনার প্রতি নজর রাখছে। কোথায় কী ঘটছে তা কমিশনের নজরদারির মধ্যে আছে৷ যেখানে প্রয়োজন সেখানেই কমিশন কাজ করছে।’’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘এই বিষয়গুলো নিয়ে নানা মহলে কথা হচ্ছে। আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমও কথা বলছে, প্রতিবেদন করছে। ফলে যা হয়েছে তাহলো, সব ক্ষেত্রেই এক ধরনের সচেতনতা বাড়ছে। বিষয়গুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার কারণে এগুলো যে বন্ধ করা দরকার, দমন করা দরকার তার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে। ফলে বিচার বহির্ভূত হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে।’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা, নানা রকম দুষ্কৃতি ঘটে থাকে কিছু খারাপ লোকের কারণে। তাদের ওপর যদি নজরদারি বাড়ানো হয়, তাদের ওপর যদি খবরদারি জোরদার করা হয় তাহলে এধরনের ঘটনা অবশ্যই কমতে বাধ্য।’’
সূত্র: ডয়চে ভেলে