আলোচিত

দুদকের মামলার ফাঁকফোকরে বেরিয়ে যাচ্ছে আসামি!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠনের পর পেরিয়ে গেছে দেড় যুগ। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়েও স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট গড়তে পারেনি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। যাত্রার শুরুতেই করা আইনেও এ বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে, তবু গঠন হয়নি স্থায়ী প্রসিকিউশন। এ কারণে দুদকের মামলার এজাহার, চার্জশিট, বিচার, উচ্চ আদালতে আপিল, আপিল বিভাগে চূড়ান্ত আপিলে পর্যন্ত নানা আইনি ফাঁক-ফোকর থেকে যাচ্ছে। আর এটি কাজে লাগাচ্ছে আসামিপক্ষ।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, দুদকের করা মামলার বিচারে অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। এতে করে দুদক গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে স্থায়ী প্রসিকিউশন গড়ায় গুরুত্বারোপ করছেন আইনজ্ঞরা। জানা গেছে, স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট গড়ে তোলার জন্য কমিশনে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

২০০৪ সালে দুদক গঠনের পর মামলার তদন্ত, চার্জশিট দাখিল থেকে শুরু করে বিচার প্রক্রিয়া পর্যন্ত সার্বিক আইনি কর্মকা- পরিচালনায় অস্থায়ী ভিত্তিতে আইনজীবীদের একটি প্যানেল করা হয়। এখনো সেভাবেই চলছে; প্যানেল আইনজীবীরা দুদকের আইনি কর্মকা- পরিচালনা করছেন; হয়নি স্থায়ী প্রসিকিউশন। দুদকের হিসাবে, বিচারিক আদালতে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত তাদের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩ হাজার ৩২০টি। গত ১১ মাসে গড়ে ১০ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশ মামলায় সাজা আর ৪০ শতাংশ মামলায় খালাস পেয়েছেন আসামিরা। আর উচ্চ আদালতে ৫৬ শতাংশ মামলাতেই হার হয়েছে দুদকের।

সাধারণত কোনো মামলা দায়েরের পর তা বিচারিক আদালতের অধীনে চলে যায়। বর্তমানে কমিশনের মামলাগুলোর মধ্যে ঢাকায় ৮০৯টি এবং ঢাকার বাইরে অন্যান্য আদালতে ২ হাজার ৯৫টি বিচারাধীন। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের আদেশে ৪২৩টির কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৩৩৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ২০০টি মামলায় আসামির সাজা হয়েছে; খালাস হয়েছে ৯২টি মামলায়। এ দুয়ের বাইরে অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪১টি মামলা।

এদিকে উচ্চ আদালতে ৩ হাজার ৩৫১টি মামলা বিচারাধীন। এগুলোর মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে ২ হাজার ৮৭৯টি এবং আপিল বিভাগে ৪৭২টি মামলা। এ ছাড়া ৩৭১টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে গড়ে ১৯ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। গত ১১ মাসে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে ৫৬ শতাংশ মামলাতেই হেরেছে দুদক। আর ৪৪ শতাংশ মামলায় দুদকের পক্ষে রায় এসেছে।

উচ্চ আদালতের মামলাগুলোর মধ্যে ক্রিমিনাল মিস, ক্রিমিনাল আপিল, ক্রিমিনাল রিভিশন ও ক্রিমিনাল রিট মামলা রয়েছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত দুদকের হিসাবে হাইকোর্ট বিভাগে ৬১৮টি ও আপিল বিভাগে ১২৩টি রিট মামলা বিচারাধীন। ক্রিমিনাল মিস মামলা হাইকোর্টে ৭৭৬টি, আপিল বিভাগে ১৯৯টি; আপিল মামলার মধ্যে হাইকোর্টে ৯৮৮টি, আপিল বিভাগে ৬৭টি; রিভিশন মামলার মধ্যে হাইকোর্টে ৪৯৭টি, আপিল বিভাগে ৮৩টি মামলা বিচারাধীন।

মামলার জট, নিষ্পত্তিতে ধীরগতি এবং অর্ধেক মামলায় দুদকের হারের পেছনে স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট না থাকা, যথাযথভাবে মামলার ফাইল না হওয়া, পর্যাপ্ত দালিলিক প্রমাণের অভাব, প্যানেলে দক্ষ ও যোগ্য আইনজীবীর সংকট ইত্যাদি বিষয় দায়ী বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।

একটি স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট গঠনে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ৩৩ ধারায় বলা হয়েছে- (১) এই আইনের অধীন কমিশন কর্তৃক তদন্তকৃত এবং স্পেশাল জজ কর্তৃক বিচারযোগ্য মামলাসমূহ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে কমিশনের অধীন উহার নিজস্ব একটি স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট থাকবে। (২) উক্ত প্রসিকিউটরগণের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী বিধি দ্বারা নির্ধারিত হইবে। (৩) এই ধারার অধীন কমিশনের নিজস্ব প্রসিকিউটর নিযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত, কমিশন কর্তৃক অস্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্ত বা অনুমোদিত আইনজীবীগণ এই আইনের অধীন মামলাসমূহ পরিচালনা করিবে।

কিন্তু ১৮ বছর পরও উপধারা-৩ অনুযায়ী অস্থায়ী ভিত্তিতে আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করছে দুদক। এদিকে কমিশনের আটটি অনুবিভাগের মধ্যে একটি লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন শাখা রয়েছে। সেখানে একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে অন্যরা নিযুক্ত রয়েছেন। এ শাখার মহাপরিচালকসহ অন্যরা বিচার বিভাগ থেকে প্রেষণে এখানে নিয়োজিত আছেন।

লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন শাখার তথ্য বলছে, স্থায়ী প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়নি বলে সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগ ও বিচারিক আদালতে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ করা পাবলিক প্রসিকিউটর ও প্যানেল আইনজীবীরা কমিশনের মামলা পরিচালনা করে থাকেন। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার জন্য ২৫ জন প্যানেল আইনজীবী অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত আছেন। একইভাবে ঢাকায় ১৩টি বিশেষ জজ আদালতে ১৪ জন পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োজিত আছেন। ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলা আদালতেও পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দিয়েছে দুদক। তাদের মনিটরিং করেন কমিশনের ৩৫ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালকবৃন্দ। ক্ষেত্রবিশেষে প্রধান কার্যালয় থেকেও তত্ত্বাবধান ও মনিটরিং করা হয়।

দুদকের অধিকাংশ মামলায় প্রত্যাশিত রায় আসছে না একটি বিশেষায়িত প্রসিকিউশন ইউনিট না থাকায়- এমনটিই মনে করেন বার কাউন্সিলের কমপ্লেইন্ট অ্যান্ড ভিজিলেন্স কমিটির সভাপতি এবং সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। তিনি বলেন, আমাদের বড় দুর্নীতির মামলাগুলো এগোচ্ছে না। এর কারণ উনারা (প্যানেল আইনজীবী) আইনের মধ্যে থাকেন না। আইনচর্চার বিশেষায়িত টিম সেখানে নেই। দুর্নীতির মতো বিশেষ অপরাধকে মোকাবিলায় আমরা এখনো ভূমিষ্ঠই হইনি।

সুপ্রিমকোর্টের এই আইনজীবী আরও বলেন, দুদকের মামলায় বিচারিক আদালত কোনো না কোনো একটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সাজা দেন। সেই মামলা যখন উচ্চ আদালতে আপিলে আসে, তখন লিগ্যাল অ্যাভিডেন্স দিতে না পারায় মামলা থেকে আসামিরা খালাস পেয়ে যান।

রাজা বলেন, ‘অস্থায়ী আইনজীবীদের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করলে যা হয়, তা হচ্ছে- তারা সকালে একটা কোম্পানি মেটার করল, দুপুরে একটা সাধারণ রিট করল, পরের দিন সকালে দুর্নীতির মামলা পরিচালনা করল। এতে নলেজ, রেফারেন্স, পারদর্শিতার ক্ষেত্রে গলদ থেকে যাচ্ছে। এর পর তিনি যোগ করেন, দুদক আইনের ৩৩ ধারার উদ্দেশ্যে আছে- দুর্নীতি এমন একটি জিনিস, যা গভীরভাবে করা হয়, সেখানে সুপার স্পেশাল টিম ছাড়া সেই দুর্নীতি অ্যাড্রেস করা যায় না। যেমন- যারা বুদ্ধিভিত্তিক আইন, কপিরাইট আইন, ট্রেড মার্ক আইন নিয়ে প্র্যাকটিস করেন তারা কিন্তু অন্য কোনো প্র্যাকটিস করেন না। তারা শুধু সেই কাজটিই করেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনে স্থায়ী প্রসিকিউশন টিম রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী বলেন, এখানে যেন একটি সুপার স্পেশালাইড টিম গঠিত হয়। দুর্ভাগ্যজনক যে, দুদক ভাড়া করা অন্যের পাখায় উড়ছে। যার ফলে কাউকে নোটিশ দেওয়া, এফআইআর করা, চার্জশিট দেওয়া, ট্রায়াল, হাইকোর্টে আপিল, আপিল বিভাগে আপিলটা ফেস করা, সব জায়গায় একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। এতে করে দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ার যে প্রত্যাশা আমাদের, সেটি পূরণ হচ্ছে না।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনও মনে করেন দুদকের স্থায়ী একটি প্রসিকিউশন টিম থাকা উচিত ছিল। তিনি বলেন, কমিশনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তা করা হয়নি; প্রসিকিউশন করা দরকার ছিল, করা হয়নি। দুর্নীতির ব্যাপারে সরকার তো বটেই, আমরাও সবাই বলি জিরো টলারেন্সের কথা। সেটি হতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটা বিশেষায়িত প্রসিকিউশন টিম থাকা উচিত ছিল। সেটি তারা করেনি, এটি তাদের একটা বড় ঘাটতি।’

স্থায়ী প্রসিকিউশনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে এক সময় দুদকের প্যানেল আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাধীন সংস্থা হিসেবে দুদক যা মনে করবে আইনের মধ্যে থেকে তারা তা করতে পারে। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন, সেটি তাদের ব্যাপার, উনাদের আইনে আছে স্বাধীনভাবে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন। সেটি আমার কোনো দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। উনারা খরচসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যা সাশ্রয়ী মনে করবে সেটি করবেন। উনারা তো আইনের মধ্যেই আছেন।’

স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট না থাকায় মামলায় দুদকের হার, মামলা জট এবং নিষ্পত্তির হার কমার জন্য দায়ী কিনা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এমন প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ জানান, এ বিষয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। তিনি বলেন, প্যানেল আইনজীবীদের পাশাপাশি কমিশন থেকে সরাসরি আইনজীবী নিয়োগ করার বিষয়ে ভাবছে কমিশন। সে জন্য আইনের সংশোধন প্রয়োজন হবে।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, আইনের ৩৩ ধারায় প্রসিকিউশনের কথা বলা আছে যে, প্রসিকিউশন থাকবে। একটা বড় ধরনের সমস্যা সেখানে আছে, এ জন্য বিধিবিধান করতে হবে। সমস্যা হলো যদি আমরা নিয়োগ দিই, দিতে পারব সহকারী পরিচালক, এর ওপরে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। কোর্টে লড়তে হয় সিনিয়র আইনজীবীর মাধ্যমে, যিনি ডিজি হওয়ার যোগ্য। সে ক্ষেত্রে সহকারী পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হলে মামলা লড়ে আমরা জিততে পারব না। প্রসিকিউশন ইউনিট কীভাবে করা যায়, শুধু এ নিয়েই স্টাডি করা দরকার।

 

সূত্র: আমাদের সময়

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button