আলোচিতগাজীপুর

মায়ের জানাজায় ডান্ডাবেড়ি পরানো সংবিধানের লঙ্ঘন

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : “কাউকে জানাজায় দাঁড়ানোর সময় অবশ্যই হ্যান্ডকাপ বা ডান্ডাবেড়ি খুলে দিতে হবে। আমাদের সংবিধান বলেছে, কোন মানুষের সঙ্গে নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করা যাবে না।

কালিয়াকৈরের বোয়ালি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলী আজমের সঙ্গে যেটা ঘটেছে সেটা সংবিধানের লঙ্ঘন হয়েছে।”

গত মঙ্গলবার মায়ের মৃত্যুতে তিন ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন আলী আজম। তিনি যখন মায়ের জানাজা পড়াচ্ছিলেন তখন তার ডান্ডাবেড়ি পরানো ছিল। এক হাতে ছিল হাতকড়া। স্থানীয় লোকজন বললেও ডান্ডাবেড়ি খুলে দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। পুলিশ অযু করার জন্য তার এক হাত থেকে হাতকড়া খুলে দেয়। বিষয়টি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সামাজিক মাধ্যমে পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষের সমালোচনা হচ্ছে।

গাজীপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার বজলুর রশিদ আখন্দ বলেন, “আসামি জেলের বাইরে গেছে, তাই নিরাপত্তার জন্য ডান্ডাবেড়ি দিয়েছি। ওয়ারেন্টে দাগি-নিদাগি কোনো কিছু বলা থাকে না। আমি শুধু মামলার সেকশনগুলো (ধারা) দেখি। সেকশনে আছে, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে ৩, ৪, ৫ ধারা; বিস্ফোরক আইনের মামলা আমি কি ছোট করে দেখব? ওখানে যারা তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের ডান্ডাবেড়ি খোলার সুযোগ ছিল না। তাদের কাছে এর চাবিও ছিল না। আমরা আইনের বাইরে কোন কাজ করিনি।”

যে মামলায় আলী আজমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, ওই মামলার এজাহারে তার নাম নেই। এজাহারের কপি সংগ্রহ করে দেখা গেছে, যে ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে আলী আজম নামটি নেই। এছাড়া অজ্ঞাত হিসেবে আরও ১০০/১৫০ জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সন্দেহভাজন আসামী হিসেবে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। রিমান্ডেরও আবেদন করেছিল, কিন্তু আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করেনি।

ডিসেম্বর মাসে আদালত বন্ধ থাকায় জামিনের আবেদন করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন আলী আজমের ভাই আতাউর রহমান। তিনি বলেন, “আমার ভাই যেহেতু মাদ্রাসা থেকে পাশ করেছে তাই মায়ের শেষ ইচ্ছে ছিল ভাই যেন জানাজা পড়ায়। এ কারণে আমরা হাতকড়া আর ডান্ডাবেড়ি খুলে দিতে বলেছিলাম। কিন্তু পুলিশ এক হাত থেকে হাতকড়া খুলে দিলেও ডান্ডাবেড়ি খোলেনি। আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে অন্য কোনো মামলাও নেই। শুধুমাত্র বিএনপি করার কারণে তাকে গ্রেপ্তার করেছে।”

যে ঘটনায় এই মামলা, সেই ঘটনাটিও আসলে ঘটেছে কিনা জানেন না এলাকাবাসী। মামলার ভাষ্য, গত ২৮ নভেম্বর রাতে চন্দ্রায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের অফিস সহকারী আব্দুল মান্নান শেখ বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু স্থানীয় কোন মানুষ সেখানে ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ পাননি। মামলার বাদিও এখন আর কথা বলতে চাচ্ছেন না। তিনি বলছেন, পুলিশ যেটা বলছে, সেটাই তার ভাষ্য। তবে তিনি স্বীকার করেছেন ঘটনাস্থলে তিনি ছিলেন না। সে সময় একটি দাওয়াত খেতে তিনি অন্য জায়গায় ছিলেন। বিএনপি এটাকে গায়েবি মামলা বলছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক শাহদীন মালিক বলেন, “জেল কোডে যাই থাকুক না কেন সংবিধানের উপরে কিছু নেই। সংবিধান যেখানে বলছে, কাউকে জনসম্মুখে হেয় করা যাবে না, অমানবিক আচরণ করা যাবে না। সেখানে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে মায়ের জানাজায় নিয়ে যাওয়া আইনের বরখেলাপ, সংবিধানের বরখেলাপ। যারা এটা করেছেন তারা সঠিক কাজটি করেননি।”

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমি মনে করি, জানাজার সময় তার হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খুলে দিলে ভালো হতো।” এখন এই ঘটনায় দায় নিতে রাজি নন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, “প্যারোল প্রদানের কর্তৃপক্ষ হলো জেলা প্রশাসক। আমার কাছে আবেদন করেছে, আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তার নির্দেশনা সংবলিত প্যারোলে মুক্তির আদেশ দিয়েছি। এখন তাকে কীভাবে নিরাপত্তার মধ্যে নেওয়া হবে সেটা কারা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ নির্ধারণ করবে।”

বিএনপির পক্ষ বলা হয়েছে, গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সারাদেশেই বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবী মামলা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ২৯ নভেম্বর কালিয়াকৈর থানায় মামলা হয়। এতে উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১১ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০০/১৫০ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় অজ্ঞাত আসামী হিসেবে ১ ডিসেম্বর রাতে আলী আজমকে কালিয়াকৈরের পাবরিয়াচালা গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আলী আজম ছাড়াও পৌরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল কুদ্দুস, আট নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সারোয়ার হোসেন আকুলসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। কালিয়াকৈর থানার ওসি আকবর আলী খান দাবি করেন, ওই মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর তারা আলী আজমের নাম বলেছে।

হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় মায়ের জানাজায় অংশ নেওয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র এক বিবৃতিতে বলেছে, “সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচার বা দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। সংবিধানে এমন বিস্তৃত অধিকার থাকা সত্ত্বেও একজন নাগরিককে মায়ের জানাজায় ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে নিয়ে যাওয়া শুধু অমানবিকই নয় বরং মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থি। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডান্ডাবেড়ি পরানো বিষয়ক উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও অনুসরণ করা হয়নি। তা ছাড়া তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট মামলার আসামি নন। সংস্থাটি এ ধরনের নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অসংবেদনশীল আচরণের তীব্র নিন্দা জানায়।

ঘটনাটি নিয়ে এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গভীর নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, ঘটনাটি সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী। কারা কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার নেওয়ার দাবিও তাদের।

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button