আলোচিতজাতীয়

আগেরগুলোই শেষ হয়নি, আরো দুটি স্যাটেলাইট শহর করতে চায় রাজউক!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : প্রশাসনিকসহ দেশের প্রায় সব কাজেরই কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী ঢাকা। ফলে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ নতুন করে ঢাকামুখী হচ্ছে। বিস্তৃত হচ্ছে নগর। বাড়ছে অবকাঠামো। পুরনো এ শহরের অবকাঠামো দেখভালে ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি)। ঢাকার প্রথম মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে তারা। তবে ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে পরিচালিত তত্কালীন ডিআইটি পরবর্তী সময়ে ১৯৮৭ সালে আইন সংশোধনের মাধ্যমে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) করা হয়। সংস্থাটির পরিধি বাড়ে সাভার, কেরানীগঞ্জসহ ৫৯০ বর্গমাইল এলাকায়। নগরবাসীর আবাসিক সমস্যা সমাধানে হাতে নেয় বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা। তবে এখন পর্যন্ত কোনো আবাসন প্রকল্পই শেষ করতে পারেনি সরকারের এ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি। অথচ আরো দুটি স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ করতে চায় তারা। নগর পরিকল্পনাবিদরা অবশ্য বলছেন, উন্নয়ন বা আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন নয়, রাজউকের মূল কাজ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ করা। তাছাড়া দূষণ ও যানজটে নাকাল ঢাকায় নতুন করে আবাসনের সুযোগ তৈরি করা মানে এ শহরের ওপর আরো চাপ বাড়ানো।

রাজউকের তথ্য বলছে, প্রস্তাবিত তুরাগ নদের বন্যাপ্রবাহ এলাকা, জলাশয় সংরক্ষণ ও কম্প্যাক্ট টাউনশিপ উন্নয়ন প্রকল্প এবং কেরানীগঞ্জ ওয়াটারফ্রন্ট স্মার্ট সিটি—প্রকল্প দুটির ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ হয়েছে। গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এগুলোর সংক্ষিপ্তসার ও পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করা হয়েছে। সুপারিশ অনুযায়ী এখন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠনের কার্যক্রম চলমান। এর মধ্যে ৪ হাজার ৭০০ একর ভূমির ওপর গড়া হবে কেরানীগঞ্জ উপজেলায় স্যাটেলাইট সিটি। প্রকল্পের খসড়া লে আউট প্ল্যানে নিম্নবিত্তদের আবাসনের জন্য কয়েকটি ব্লক নির্দিষ্ট রয়েছে।

আবাসন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় কোটির অধিক জনসংখ্যার নগরীতে প্রতি বছর নতুন করে বসতি গড়ছে পাঁচ-সাত লাখ মানুষ। অথচ সম্প্রতি রাজউকের গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৭০ ভাগ নগরবাসীর আবাসন চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য নেই। তাই এ বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে ঢাকার জমির সুষ্ঠু ব্যবহার ও নগর উন্নয়ন নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করছেন নগরবিদরা। রাজউকের যদিও সেদিকে মনোযোগ কম। সংস্থাটির আবাসন প্রকল্পে লটারির মাধ্যমে ভাগ্যবান কিছু ব্যক্তি প্লট বরাদ্দ পাচ্ছেন। কম মূল্যে বরাদ্দ পাওয়া এসব প্লট পরে তারা বিক্রি করছেন উচ্চমূল্যে। এভাবে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষকে বিত্তবান হওয়ার সুযোগ করে দেয়া ছাড়া রাজউকের আবাসন প্রকল্পে কোনো লাভই হচ্ছে না নগরবাসীর।

খাতসংশ্লিষ্টরাও বলছেন, রাজউকের কাজ নগর উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সেটিতে মনোযোগ না দিয়ে তারা ভূমি উন্নয়নের মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ দিয়ে একটি অসম শ্রেণী তৈরি করছে। কেননা জমি বরাদ্দ পাওয়াদের বেশির ভাগেরই সেখানে বাড়ি বানানোর সামর্থ্য থাকে না। রাজউক ঢাকার কেরানীগঞ্জে ঝিলমিল আবাসন প্রকল্পটি হাতে নেয় ১৯৯৭ সালে। কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০০১ সালে। এরপর দুই দশক পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটি শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি। একাধিকবার সময় বেড়েছে, ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১৩৬ কোটি টাকা, এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩৩৫ কোটি টাকায়। প্রকল্পটির আওতায় ১ হাজার ৭৪০টি প্লট এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ৯ হাজার ৫০০টি অ্যাপার্টমেন্ট করার কথা রয়েছে।

ঝিলমিল প্রকল্পটি গ্রহণের সময় বলা হয়েছিল, রাজধানীর বর্ধিত এলাকার নিকটবর্তী শহরের বাসিন্দাদের বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি করে ঢাকার জনসংখ্যার চাপ কমানো হবে। এছাড়া ঢাকা ও কেরানীগঞ্জকে ধীরে ধীরে নগরীকরণের মাধ্যমে নাগরিক সুবিধা প্রসারিত করা। প্রকল্পটি ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পাশে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর দুই কিলোমিটার পশ্চিমে।

একইভাবে রাজধানীর অদূরে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটি ১৯৯৫ সালে হাতে নেয় রাজউক। ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ কমাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জে ৬ হাজার ১৫০ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠছে নতুন এ শহর। এখানে প্লট হবে ২৫ হাজার। অধিগ্রহণ জটিলতায় আট বছর পর ২০০৩ সালে শুরু হয় প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নকাজ। সব মিলিয়ে ২৭ বছরে এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৭২ শতাংশ। দীর্ঘসূত্রতায় প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। যখন কাজটি হাতে নেয়া হয়, তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৩১১ কোটি টাকার মতো। পরবর্তী সময়ে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা বেড়েছে প্রকল্পটির ব্যয়। বাড়তি এ ব্যয়ের পুরোটাই বহন করতে হচ্ছে প্লটগ্রহীতাদের।

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। পরে এর মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। রাজউকের নিজস্ব অর্থায়নে এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২৮৫ কিলোমিটার রাস্তা, ৪৩টি ব্রিজ, প্রকল্পের ৪৮ দশমিক ২০ কিলোমিটার লেক ও খাল এবং নদীর তীর উন্নয়ন ও প্রটেকশন কাজের ২৬ দশমিক ২০ কিলোমিটার সম্পন্ন হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ অংশের ২২ কিলোমিটার লেক উন্নয়ন ও প্রটেকশন কাজও চলমান। এ পর্যন্ত ২২ হাজার ২৭৭টি আবাসিক প্লটের দখল হস্তান্তর করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৭৫টি প্লটে বাড়ি নির্মাণের লক্ষ্যে নকশার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বেশকিছু প্লটে বাড়ি নির্মাণকাজও চলছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পটির এ পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ এবং আর্থিক ৫৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এ অবস্থায় রাজউকের আরো দুটি নতুন স্যাটেলাইট সিটি প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘রাজউকের মূল কাজ পরিকল্পনা তৈরি ও পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণ করা। আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন তাদের মূল কাজ নয়। তাছাড়া রাজউক আগে এ ধরনের যেসব প্রকল্প নিয়েছে, সেগুলো এখনো শেষ করতে পারেনি।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের এ অধ্যাপক আরো বলেন, ‘উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে রাজউকের দুর্বলতা প্রকট। তাদের দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে ঢাকা শহরের অধিবাসীদের ভুগতে হচ্ছে। রাজউক নতুন যেসব বিধিমালা করেছে, সেখানে প্লটকেন্দ্রিক উন্নয়ন না করার কথা বলা হয়েছে। সেখানে নতুন স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণ রাজউকের বিদ্যমান বিধিমালার সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। আর যদি এ ধরনের উন্নয়নকাজ করতেই হয়, তাহলে সরকারের এ-সংক্রান্ত যেসব সংস্থা রয়েছে তাদের দিয়ে বাস্তবায়ন করানো উচিত।’

নতুন পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, ‘প্রকল্প দুটির একটির কাজ এগিয়ে চলেছে। কেরানীগঞ্জ ওয়াটারফ্রন্ট স্মার্ট সিটি প্রকল্পটির অবস্থান ঝিলমিল প্রজেক্টের অদূরে। ওয়ার্কপ্ল্যান অনুযায়ী এগোচ্ছে কাজ। এখন ডিপিপি তৈরির কাজ চলমান। এছাড়া তুরাগ নদের বন্যাপ্রবাহ এলাকা, জলাশয় সংরক্ষণ ও কম্প্যাক্ট টাউনশিপ উন্নয়ন প্রকল্পটিও প্রধানমন্ত্রী পছন্দ করেছেন।’ প্রকল্পটির বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘এয়ারপোর্টের থার্ড টার্মিনালের কাজ হচ্ছে। যদি বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ ওদিকে না হয় বা ফ্লাইং জোন বিষয়ক কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে আমরা সেখানে প্রকল্পটি নির্মাণের বিষয়ে প্রাথমিক চিন্তাভাবনা করেছি। এজন্য সিভিল এভিয়েশনকে একটি চিঠি দিয়েছি, তাদের সঙ্গে একটি বৈঠকও হবে। আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রকল্পের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ওই প্রকল্পে ৭০ শতাংশ জলাশয়, বাকি ৩০ শতাংশে অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। অনেকটা দ্বীপের মতো সেগুলো কানেক্টেড থাকবে।’

আগের প্রকল্পগুলো শেষ না করেই নতুন পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘ঝিলমিল আবাসিক এলাকাটি বাড়ি করার উপযোগী হয়েছে। ওই প্রকল্পে আবাসিক ও বাণিজ্যিক অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের প্রকল্প ছিল। তবে যাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল তারা সে অনুযায়ী কাজ এগিয়ে নিতে পারেনি। সে কারণে ওখানে অগ্রগতি কম। অন্যদিকে পূর্বাচলে এরই মধ্যে ৩০০ বাড়ির পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। পাঁচটি সেক্টরে পানি সরবরাহের কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর কাজও চলছে। রাস্তাঘাটের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ। প্রকল্প এলাকার বাসিন্দাদের সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের বিষয়েও কাজ চলছে। ডিসেম্বর নাগাদ আশা করা যায় সে বিষয়ে কাজ হয়ে যাবে।’

আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, ‘শুরু থেকে ধরলে কিছু প্রকল্পে অনেক সময়ই লেগেছে, এ বিষয়ে অস্বীকার করা যাবে না। তবে ভবিষ্যৎ প্রকল্প এ রকম হবে না বলেই আশা করা যায়। নতুন যে প্রকল্পগুলো নেয়া হবে সেখানে পুরো কর্মপরিকল্পনা বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। আগেরগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে চেষ্টা করব যাতে দেরি না হয়।’

 

সূত্র: বণিক বার্তা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button