টঙ্গীতে রেলসেতু নির্মাণ নিয়ে বিবাদে রেলওয়ে বিআইডব্লিউটিএ
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ঢাকা থেকে টঙ্গী হয়ে জয়দেবপুর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্পটি জটিলতায় পড়েছে টঙ্গীর তুরাগ নদের ওপর রেল সেতুতে এসে। নির্মাণাধীন সেতুর উচ্চতা নিয়ে আপত্তি তুলেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তারা বলছে, এটি নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটাবে। পাশাপাশি সংস্থাটির অভিযোগ, তুরাগে নতুন করে রেল সেতু বানানোর জন্য রেলওয়ে তাদের কাছ থেকে কোনো ছাড়পত্রও নেয়নি।
তবে রেলওয়ে বলছে, প্রকল্পটি ২০১২ সালে হাতে নেয়া। রেললাইনসহ সেতুর নকশা করা হয় তখনই। সে অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছে। এমন অবস্থায় সেতুর নকশায় পরিবর্তন আনলে জটিলতা তৈরি হবে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও অবহিত করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
ভারতের লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়াল গেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় এসব রেললাইন যৌথভাবে নির্মাণের কাজ করছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাফকন্স ও কল্পতরু পাওয়ার ট্রান্সমিশন লিমিটেড (কেপিটিএল)। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করা হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বলছে, উদ্বোধনের পর এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। টঙ্গী সেতু নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ আপত্তি তোলায় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথ গড়ে তোলার একটি পরিকল্পনা রয়েছে বিআইডব্লিউটিএর। এ পরিকল্পনা শুরু হয়েছে ২০০৪ সালে। এর মধ্যে একবার ঢাকার চারপাশের তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদ দিয়ে জাহাজ চালানোর উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয় সংস্থাটি। ব্যর্থতার প্রধান কারণ কম উচ্চতার একাধিক সেতু। এ সেতুগুলোর কারণে জাহাজের বদলে কার্গো চালাতে হচ্ছে। সম্প্রতি টঙ্গীতে রেলওয়ে আরেকটি সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করেছে। নতুন সেতুটি বানানো হচ্ছে আগের দুই সেতুর সমান্তরাল উচ্চতায়। এ সেতুটি বৃত্তাকার নৌপথ গড়ে তোলার পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা। মূলত এ কারণেই সেতুটি নির্মাণে আপত্তি তোলা হয়েছে।
আপত্তির বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকারের গেজেট অনুযায়ী, আমাদের (বিআইডব্লিউটিএ) জায়গায় কোনো সেতু নির্মাণ করতে হলে আমাদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। এরপর আমরা বলে দেব, সেতুর উচ্চতা কত হবে। আমরা চারটি শ্রেণীতে এ উচ্চতা ঠিক করে দিই। টঙ্গী সেতুটি পড়েছে তৃতীয় শ্রেণীতে। এটা আমরা করি, যেন নদী দিয়ে জাহাজ চলাচলে কোনো অসুবিধা না হয়। কিন্তু এ সেতুটি নির্মাণের বিষয়ে রেলওয়ের পক্ষ থেকে আমাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের ছাড়পত্র নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ রেলওয়েতে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টি জানার পর তাদের (বাংলাদেশ রেলওয়ে) আনুষ্ঠানিকভাবে একটা চিঠিও দিয়েছিলাম। সেখানে আমরা নির্মাণাধীন সেতুটির উচ্চতা ও চওড়া কী হবে, তা জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের কোনো কথাই রেলওয়ে শোনেনি। তারা আগের উচ্চতা রেখেই সেতুটির নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি নদীর উপরে সেতুর জন্য যে দুটি পিলার বানানো হচ্ছে, সেগুলোও নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটাবে। তবে দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে বিষয়টির একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান আমরা বের করতে চাই। গত সপ্তাহে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। রেলওয়ের প্রকল্পটি যেমন জনগুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ঢাকা শহরের চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথ নির্মাণের উদ্যোগও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই, দুটি প্রকল্প এমনভাবে এগিয়ে যাক, যেন একটির সঙ্গে অপরটি সাংঘর্ষিক না হয়।
ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুরে নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন হয় ২০১২ সালে। ওই সময় প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৮৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০১৫ সালের জুনে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (আরডিপিপি) অনুযায়ী, কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালের জুনে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ে চুক্তি করেছে ৩৬ মাসে কাজ সম্পন্নের। চুক্তিটি সম্পাদন হয়েছে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুলাইয়ে কাজ শেষ হওয়ার কথা। টঙ্গীতে তুরাগ নদে সেতু নির্মাণ নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ আপত্তি তোলায় নির্মাণকাজ আরো পিছিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিআইডব্লিউটিএ যখন আপত্তি তুলেছে, তখন রেলওয়ে বলছে এ মুহূর্তে নকশায় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর নতুন রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রেলওয়ে বেশ আগে থেকেই করছে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিদ্যমান দুটি রেল সেতু যে উচ্চতায় আছে, সেই উচ্চতাতেই নতুন রেল সেতুটি নির্মাণের নকশা করা হয়েছে। এখন বিআইডব্লিউটিএ আপত্তি তুলেছে। তারা বলছে, এ সেতুর উচ্চতা আরো বাড়াতে হবে, যেন সেতুটি নৌযান চলাচলে প্রতিবন্ধক না হয়। বিষয়টি এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানানো হয়েছে। তিনি একটা সমন্বিত সিদ্ধান্ত দিলেই বিষয়টি সুরাহা হয়ে যাবে। আপাতত সেতুর এ অংশটিতে এসে প্রকল্পের কাজ (ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন নির্মাণ) কিছুটা আটকে আছে। বিআইডব্লিউটিএ যে উচ্চতায় টঙ্গী সেতুটি নির্মাণের কথা বলছে, সেটি করতে হলে নকশায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, যা এ মুহূর্তে ‘অসম্ভব’।
সূত্র: বণিক বার্তা