গাজীপুর কণ্ঠ, খেলাধুলা ডেস্ক : বিশ্বকাপের ডামাডোলের মধ্যে বাংলাদেশের ফুটবলে বড় এক দুঃসংবাদ। জীবনযুদ্ধে হার মেনেছেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক ডিফেন্ডার আজমত আলী (৬৬)।
মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তিনি গাজীপুর মহানগরের হাড়িনালের নিজ বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
হার্টের সমস্যায় শরীর সুস্থ রাখতে সকালে নিয়ম করেই হাঁটাহাঁটি করতেন। কিছুদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। এরপর আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারলেন না।
বুধবার (৩০ নভেম্বর) বেলা ১০টায় হাড়িনাল ঈদগা মাঠে এবং ১১ টায় গাজীপুর শহরের শহীদ বরকত স্টেডিয়ামে তাঁর জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। মৃত্যুকালে স্ত্রী, দুই ছেলে, ভাই বোনসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।
আজমত আলীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর সমকালীনসহ জেলার ফুটবলাররা মরহুমের বাড়িতে আসেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
ঢাকা মাঠে ‘দমের ডিব্বা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন আজমত আলী। তাঁর ছিল অফুরন্ত দম। কম উচ্চতা নিয়েও স্পট জাম্প করতেন। সে সময় তাঁকে রুখতে হতো শেখ আসলামদের মতো স্ট্রাইকারকে। ওই মানের হেডার তখন দক্ষিণ এশিয়ায় ছিল না। আজমত তাঁর উচ্চতার সীমাবদ্ধতাকে জয় করেই ঢাকার মাঠে আলো কেড়েছিলেন।
জীবদ্দশায় মজা করে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমার উচ্চতা ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির মতো। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা পৃথিবীতেই মনে হয় সবচেয়ে খাটো ডিফেন্ডার, হা হা হা।’ তবে নিজেকে তৃপ্ত ভাবতেন এই বলে, ‘আমার উচ্চতা কম, কিন্তু স্পট জাম্প করতে পারতাম সাড়ে আট ফুটের মতো। কৃষকের ছেলে তো, আমার দম ছিল অনেক। সেই দমের কারণেই অনেকে আমাকে “দমের ডিব্বা” বলত।’
আজমত আলী ঢাকা মোহামেডানে খেলেছেন ১৯৭৭-৭৮, ১৯৮৩-৮৪ সালে; ব্রাদার্সে ১৯৭৮-৭৯, ১৯৮১-৮২, ১৯৮৫-৮৯ ও ১৯৯২; বিজেএমসিতে ১৯৮০ সালে; ফরাশগঞ্জে ১৯৯০-৯১; জাতীয় দলে ১৯৮১-৮৮ পর্যন্ত।
১৯৮৫ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে সবুজ দলের অধিনায়ক ছিলেন আজমত। ১৯৮৭ সালে লাহোরে কায়দে আজম ট্রফিতেও তিনি বাংলাদেশের অধিনায়কের বাহুবন্ধনী পরেন। ১৯৮১ সালে ঢাকায় আগা খান গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন ব্রাদার্স ইউনিয়নের গর্বিত সদস্য ছিলেন। একই বছর প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হেরে রানার্সআপ বাংলাদেশ দলেরও সদস্য ছিলেন। ছিলেন ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের দলে।
১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে রুদ্ধশ্বাস সেমিফাইনালে বাংলাদেশ দলে ছিলেন স্টপার আজমত। ম্যাচ ড্র শেষে টাইব্রেকার শট নিতে চাইছিলেন না তিনি। তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল চতুর্থ শট। তৃতীয় শটটি নেন স্বপন দাস। উত্তেজনার মধ্যে আজমত নিজেকে স্বাভাবিক রেখে চতুর্থ শটটা নিয়ে গোল করেন। পঞ্চম শটে গোল করেন হাসানুজ্জামান বাবলু। ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ।
১৯৮১ সালে আগা খান গোল্ডকাপে ব্রাদার্স ও ব্যাংকক ব্যাংক ক্লাব যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। গোপীবাগের দলটির বাঁধনহারা সেই আনন্দময় ফাইনালটা স্মরণীয় হয়েছিল আজমতের কাছে। মৃত্যুর আগে এক সাক্ষৎকারে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আতাউল হক মল্লিক ভাইসহ অন্য ধারাভাষ্যকারেরা ম্যাচের সময় বলছিলেন, “চীনের প্রাচীর আজমত। একাই সে চারজনের খেলা খেলছে।” রক্ষণে যত চাপ পড়ছিল, সবই আমার ওপর দিয়ে। এক গোলে পিছিয়ে ছিলাম আমরা, চাঁদপুরের ছেলে মনোয়ার ১-১ করল। দারুণ খেলেছিলাম আমরা সে ম্যাচে।’
আশির দশকের মাঝামাঝি একবার বিটিভির ‘ঈদ আনন্দমেলা’য় গেলেন। আবাহনী ও মোহামেডান থেকে তিনজন করে খেলোয়াড়। আজমতের সঙ্গে মোহামেডানের আবুল ও গোলরক্ষক মহসিন। আবাহনীর চুন্নু, গাফফার ও অলোক। উপস্থাপক ছয় ফুটবলারকে বোতলে পাইপ ঢুকিয়ে কোক খেতে দিলেন। কে আগে শেষ করতে পারেন, এটিই পরীক্ষা। হাত পেছনে বাঁধা। আজমতের কাছে পরীক্ষাটা বেশ কঠিনই লেগেছিল। সেই দিনটা নিয়ে পরে বলেছিলেন, ‘আমি তো খেতাম ডাব। কোকটোক খেতাম না। আমি একটানে যখন কোক খাওয়া শেষ করলাম, বাকিরা অর্ধেকও যায়নি তখনো, হা হা হা!’
১৯৭৭ সালে ঢাকা লিগে মোহামেডান অষ্টম হয়েছিল। বাজে অবস্থা চলছিল তখন সাদা–কালোর। একদিন মাঠে নামানো হলো তরুণ আজমতকে, তা–ও রাইট আউটে। ‘ওই দিন আবার টিভিতে খেলা দেখানো হয়েছে। এতে আরও তেতে উঠলাম। হাফিজ ভাই, নওশের ভাই স্ট্রাইকারে। হাফিজ ভাই বললেন, “বল ছাড়িও আমাকে।” নান্নু ভাই ব্রাদার্সের স্টপার। তাঁকে দুবার বিট করলাম। তৃতীয়বার বিট করে বল দিলাম হাফিজ ভাইকে, তিনি গোল করলেন,’ বলেছিলেন আজমত আলী। বলের ওপর কড়া ট্যাকল করতেন। এটা তাঁর বড় গুণ ছিল।
আজ তিনি চলে গেলেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন।