মন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করে জঙ্গিদের আদালতে হাজির: কারা কর্মকর্তাদের বদলি
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : পুরান ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর নিরাপত্তা জোরদারে নড়েচড়ে বসেন কর্তাব্যক্তিরা। আপাতত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের অন্য মামলায় আদালতে হাজির করা থেকে বিরত থাকতে কারা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তাঁরা। তবে তা উপেক্ষা করেই পরদিন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজনসহ জেএমবির সাত জঙ্গিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার আদালতে পাঠানো হয়।
এ ঘটনার পর কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. আবদুল জলিলকে রাজশাহী কারাগারে বদলি করা হয়েছে। বদলি করা হয়েছে ঢাকা বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামকেও। তাঁকেও রংপুর বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আগে একবার আমি ও আইনমন্ত্রী একসঙ্গে বসে বলে দিয়েছিলাম, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের আদালতে আনতে হবে না। যেহেতু তাদের ফাঁসির আদেশ হয়েই গেছে। জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পরও আমি কারা কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছি। এই আদেশ কেন মানা হয়নি?’
গত রোববার (২০ নভেম্বর) ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতের ফটকে পুলিশকে মারধর ও চোখে পিপার স্প্রে করে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের দুই সদস্যকে ছিনিয়ে নিয়ে যান জঙ্গিরা। তাঁরা হলেন মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব। তাঁরা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এ ছাড়া আরও কয়েকটি হত্যা মামলারও আসামি তাঁরা। ওই দুজনসহ ১২ আসামিকে সেদিন সিজেএম আদালত ভবনের চতুর্থ তলায় সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল থেকে পাশের ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (সিএমএম) হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল।
সেদিন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওই জঙ্গিদের ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়নি জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এ ঘটনায় পুলিশ ও কারাগার সবার গাফিলতি রয়েছে। তদন্ত শেষ হলে পুরো বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে পারব।’
জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের দায় ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে পুলিশ সদর দপ্তর ও ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। রোববার ওই ছিনতাইয়ের ঘটনার পর কারা কর্মকর্তাদের প্রতি মন্ত্রীদের নির্দেশনা আসে। সেদিনই কারা অধিদপ্তর এক আদেশে শীর্ষ সন্ত্রাসী, দুর্ধর্ষ, জঙ্গি বন্দিদের আদালত ও অন্যত্র স্থানান্তরকালে ডান্ডাবেড়ি পরানোর নির্দেশ দেয়।
এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তর থেকে সারা দেশের কেন্দ্রীয় ও জেলা কারাগারগুলোতে পাঠানো এক চিঠিতে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক শেখ সুজাউর রহমান লেখেন, ‘এখন থেকে আপনার কারাগারে আটক বিশেষ প্রকৃতির বন্দি যেমন শীর্ষ সন্ত্রাসী, দুর্ধর্ষ, জঙ্গি (জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, হিযবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম ইত্যাদি) বন্দিদের বিজ্ঞ আদালতে হাজিরা বা অন্যত্র হস্তান্তরের সময় আনা–নেওয়ার পথে ডান্ডাবেড়ি পরানোসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।’
এদিকে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হক সব কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে জেল সুপারদের নির্দেশ দেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে জেল সুপারদের কাছে পাঠানো এক বার্তায় তিনি আটক জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং বিভিন্ন নিষিদ্ধ সংগঠনের কয়েদি বা হাজতিদের নিয়মিত নজরদারিতে রাখতে বলেন। সঠিক পরিকল্পনা করে তাঁদের নিয়মিত সেল ও ওয়ার্ড পরিবর্তন করা এবং জেলা পর্যায়ের আদালতে হাজিরা না থাকলে কেন্দ্রীয় জেল বা হাই সিকিউরিটি কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ কয়েদিদের অন্য মামলায় হাজিরার জন্য আদালতে পাঠানো থেকে বিরত থাকতে নির্দেশনা দেন আইজি প্রিজন। এর পরেও কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সাত জঙ্গিকে আদালতে পাঠানো হয়। তাঁরা হলেন মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দি এনায়েত উল্লাহ জুয়েল (জেএমবি), মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দি শরিফুল ইসলাম (জেএমবি হলি আর্টিজান), হাজতি তারেক মোহাম্মদ আদনান (জেএমবি), নাজমুল ওরফে মামুন, তানভীর আহাম্মদ ওরফে আবু ইব্রাহীম, আবদুল্লাহ আইচান কবিরাজ ও হাফিজুর রহমানকে ঢাকার আদালতে হাজিরার জন্য পাঠানো হয়।
এরপর বদলি হওয়া জেল সুপার আবদুল জলিলের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আসামি আদালতে পাঠানো হয় খুব ভোরে, আমি কীভাবে জানব? এসব তো শাখার কাজ, জেল সুপার কীভাবে সব দেখবে?’ তিনি বলেন, ‘আমাকে বন্দি না পাঠানোর যে নির্দেশ আইজি (প্রিজন) দিয়েছিলেন, আমি সেই মেসেজ আমাদের জেলের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে, সেখানে জানিয়েছি। তারপরও আদালতে নিয়ে গেছে, যার দায় আমার ওপর পড়েছে, আমাকে বদলি করা হয়েছে।’
এ ঘটনায় বদলি হওয়া ঢাকার ডিআইজি (প্রিজন) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘এসব বন্দী আনার বিষয়ে আমি জেল সুপারদের আইজির নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে বলেছি। তারপরও তারা স্পর্শকাতর বন্দীদের পরদিনই আদালতে নিয়ে এসেছেন। এ ঘটনায় আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, তবুও আমাকে বদলি করা হয়েছে।’
সূত্র: প্রথম আলো