গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : নরসিংদীর পলাশ উপজেলার বাগপাড়ায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা। এগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাণ আরএফএল গ্রুপ। দেশের বৃহত্তম এ কোম্পানিটি শীতলক্ষ্যার একটি বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় বৃহত্তম এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদী। এতে একদিকে হারাচ্ছে নদীর নাব্য অন্যদিকে বিপাকে পড়েছেন এ অঞ্চলের জেলেরা।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বেপরোয়া দখল, দূষণ ও বালু ভরাটের ফলে শীতলক্ষ্যার একটি অংশ হুমকির মুখে পড়েছে। কারখানায় শিল্প বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি স্থাপন করলেও তা সার্বক্ষণিক চালু রাখছে না প্রাণ-আরএফএল কর্তৃপক্ষ। ফলে দূষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। দখল-দূষণ, ভরাট রোধ করে প্রাণ গ্রুপের হাত থেকে শীতলক্ষ্যাকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে নদীতীরবর্তী প্রাণের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও কারখানায় সার্বক্ষণিক ইটিপি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, ঘোড়াশাল সার কারখানা, পলাশ সার কারখানা, দেশবন্ধু সুগার মিল, জনতা জুটমিল, ক্যাপিটাল পেপার মিলসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত বর্জ্য এই নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে শীতলক্ষ্যা তার যৌবন হারাচ্ছে। নদী দূষণে এগিয়ে প্রাণ-আরএফএল কোম্পানির কারখানাগুলো।
নরসিংদীর পলাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদীটির রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বিশেষত্ব। শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের জমিগুলো ছিল সবুজ ফসলে ভরা। নদীতে ছিল প্রচুর প্রজাতির মাছ। আজ তা অতীত গল্পমাত্র। বাস্তবতা হচ্ছে শীতলক্ষ্যা এখন আর বহমান নয়। আমৃত্যু লালিত শীতলক্ষ্যা হারিয়েছে তার নাব্য। প্রাণের মতো প্রভাবশালীরা লুট করে নিচ্ছেন শীতলক্ষ্যার যৌবন। শীতলক্ষ্যা এখন স্থবির, জীর্ণ ও অসহায় এক নদীর নাম।
একসময় এ নদীপথে যোগাযোগ ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবন-মান উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে নদী ভরাট করে দখল আর শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত বর্জ্যে নদীগুলো হারাচ্ছে তার যৌবন।
সরেজমিন ঘুরে আরও দেখা গেছে, শীতলক্ষ্যার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। প্রাণের এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কটিতে তৈরি হচ্ছে প্রাণ ফুডের নানা ধরনের পণ্য। এই পণ্য এখানে উৎপাদন করে বাজারজাত করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলছে তার অবৈধ স্থাপনা। দখল করছে শীতলক্ষ্যা নদীতীরের সম্পদ। দূষিত করছে নদী।
নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদীটি এক সময় ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল চালিকাশক্তি। নদীপথে যোগাযোগ ও ব্যবসা- বাণিজ্যসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা ছিল এই নদীর। নদী পাড়ের কৃষি জমিগুলো ছিল ফসলে ভরা। নদীতে ছিল নানা প্রজাতির মাছ। চিতল, রুই, কাতল, মৃগেল, পাবদা পাঙ্গাশসহ বিভিন্ন প্রজাতির সুস্বাদু মাছ। দীর্ঘদিন ধরে নদীর পাড়ে অবস্থিত শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষিত হয়ে কালচে হয়ে গেছে। ফলে বিপন্ন হয়ে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। আর বেকার হয়ে পড়েছে অইেশ জেলে পরিবার। কেননা একটা সময় ছিল এখানকার জেলেরা শীতলক্ষ্যায় মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু বর্তমান সময়ে প্রাণের এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কটির অবৈধ দখল আর বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে এখন আর নদীটিতে তেমন মাছ পাওয়া যায় না। ফলে জেলেরা হয়ে পড়ছে বেকার। কিন্তু প্রাণের এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কটিতে স্থানীয় কিছু লোকজনদের চাকরির ব্যবস্থা করে প্রতিষ্ঠানটি। এলাকার উন্নয়নের কথা বললেও, বাস্তবতা হচ্ছে উন্নয়নের নামে প্রাণ দখল ও দূষিত করছে শীতলক্ষ্যা।
এ ছাড়া শীতলক্ষ্যা দূষণের জন্য প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কটি থেকে বিগত সময়ে দফায় দফায় জরিমানাও আদায় করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তারপরও বন্ধ হয়নি তাদের বর্জ্য ফেলা। ছোট-বড় অর্ধশত পাইপ ও ড্রেন দিয়ে গোপনে ও প্রকাশ্যে প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হচ্ছে। একইভাবে বর্জ্য নিক্ষেপ করে নদীটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো।
স্থানীয়রা জানান, শীতলক্ষ্যা নদী এখন উন্নয়নের বলি। যে যেভাবে পারছে দূষণ করে নদীর অস্তিত্ব বিলীন করছে। নরসিংদী ও গাজীপুরের নদী পাড়ের শিল্পকারখানার সব বর্জ্য ফেলানোর স্থান হচ্ছে এই নদীতে।
স্থানীয় দোকানদার আলমগীর মিয়া বলেন, প্রাণ গ্রুপ একদিকে যেমন নদীদূষণ করছে। অন্যদিকে সরকারি জায়গা দখল করছে। তারা নদী পাড়ে কারখানা করে নদীতীরের জায়গা দখল করছে। বড় করছে তাদের কোম্পানি। নদীর সরকারি জায়গা দখলের বিষটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, দখল করছে সরকারি জায়গা। আমার জায়গা তো করে নাই। সরকারি জায়গা দখল করেছে অথচ সরকারি লোকজন কিছুই বলছে না। তারা বিষয়টি দেখেছে। তারা কেন বলে না। তাদের কি লাভ। তারা বললে হয়তো এমন হতো না।
এ ব্যাপারে নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, শিল্পায়ন এবং দূষণ দুটি প্যারালালে চলছে। শিল্পায়ন করার জন্য কীভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় আমাদের সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শুধু শিল্পায়ন করলেই হবে না পাশাপাশি এর দূষণ থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে হবে। পরিবেশ ভালো ও সুন্দর থাকলে আমরা ভালো থাকব। তাই আমাদের উচিত শিল্পায়ন করার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নরসিংদীতে একটি বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এর আগেও পরিবেশ দূষণ করার অভিযোগ উঠেছে। তারা কেন বা কি কারণে এমন করছে আমার জানা নেই। তবে আমি মনে করি, প্রাণ যেহেতু বারবার সমালোচিত হচ্ছে তাই এ বিষয়ে তাদের আরও যত্নবান হওয়া উচিত।
বাঁচাও শীতলক্ষ্যা নদী আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহবুব সৈয়দ বলেন, প্রাণ আরএফএল গ্রুপের নদী দখলের মানসিকতায় শীতলক্ষ্যা নদী আজ খালে পরিণত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, ভূমি অফিস-সবাই নিশ্চুপ দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। যার ফলে প্রাণ গ্রুপ শীতলক্ষ্যা নদীর জমি ভরাট করে গড়ে তুলেছেন কয়েক ডজন শিল্পকারখানা। আমরা দীর্ঘদিন ধরে নদী দখল ও দূষণে প্রাণ গ্রুপের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি উল্টো প্রাণ গ্রুপ আমাদের মামলা হামলা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনী করে আসছে। প্রশাসনের উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা ও নিষ্ক্রিয়তায়ই শান্ত স্বচ্ছ জলধারার জোয়ার ভাটা প্রবাহিত শীতলক্ষ্যা নদী আজ বিপন্নের পথে। আমাদের বিদ্যাচর্চা নদীও পরিবেশ সংরক্ষণে শাণিত নয়। হাজার নদীর ঐতিহ্যমণ্ডিত দেশে আমরা পানি হাহাকারের দিকে ধাবমান। পানি সংকট আমাদের গ্রাস করতে তেড়ে আসছে। তাই কালক্ষেপণ না করে সরকারকে এখনিই প্রাণ গ্রুপের সব অবৈদ স্থাপনা উচ্ছেদ করে শীতলক্ষ্যা নদী রক্ষার্থে যত দ্রুত সম্ভব বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপক তৌহিদুজ্জামানের মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে পলাশ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ভাস্কর দেবনাথ বাপ্পি বলেন, সম্প্রতি আমরা সব শিল্পকারখানার মালিকদের নিয়ে আলোচনা করেছি। সব মালিকপক্ষকে বলা হয়েছে ২৪ ঘণ্টা ইটিপি ব্যবহারের জন্য। আর তা আমরা যেন কেন্দ্রে বসেও পর্যবেক্ষণ করতে পারি, তার জন্য সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা কার্যকর করা হবে।
আর প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের অবৈধ দখল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন শুধু প্রাণ নয়, সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান আর সরকারি জমি কেউ দখল করে আছে কি না, তার জন্য সহকারী কমিশনার ভূমিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কাজ চলমান আছে। আর যদি কেউ সরকারি জমি দখল করে থাকে তাহলে তা উচ্ছেদের জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
আরো জানতে………
কালীগঞ্জে রেলওয়ের সাড়ে ৩ একর জমি প্রাণ আরএফএল’র দখলে!
ট্যাক্স ফাঁকির অভিযোগে আরএফএল গ্রুপের সদর দফতরে এনবিআর’র অভিযান