আইন-আদালতআলোচিত

জঙ্গি ছিনতাই : ব্যবস্থা প্রহরার, নাকি জঙ্গিদের ‘সহায়তার’?

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ঢাকার আদালত এলাকা থেকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত বলে আটক জঙ্গিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। মামলার এজাহারে এ কথা উল্লেখ করা হয়।

তাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পুলিশ বা কারাগারের ভিতরের কারো হাত আছে কিনা এ প্রশ্নও উঠেছে।

রোববার জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় পুলিশ যে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে তা স্পষ্ট। এই ঘটনায় তাই পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আর জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০১৪ সালেও পুলিশ ভ্যানে হামলা চালিয়ে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়া হয়। শুধু জঙ্গি নয়, পুলিশ হেফাজত থেকে আসামিদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

রবিবার ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করেছে৷ মামলায় বলা হয়েছে , যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে তাদের আগে থেকেই জানানো হয়েছিল যে, আনসার আল ইসলামের সদস্যরা আদালতের কাজ শেষে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেবে৷ মোট চারজনকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল৷ এজন্য তিনটি মোটরসাইকেলও প্রস্তুত ছিল৷ কিন্তু দুইজনকে নিতে পারলেও বাকি দুইজনকে পারেনি৷ তারা একটি মোটর সাইকেলও ফেলে রেখে যায়৷

ওই চার জঙ্গিসহ মোট ১২ জন আসামিকে আদালতে নেয়া-আনার জন্য মাত্র তিনজন কনেস্টবল দায়িত্বে ছিলেন৷

আদালতে কাজ শেষে বের হওয়ার সময় ওই চার জঙ্গির সঙ্গে মাত্র একজন কনেস্টবল ছিল৷ পাবলিক প্রসিকউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, “তাদের নিরাপত্তা ছিল খুবই ঢিলেঢালা৷ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি এবং সাধারণ আসামিদের একই সঙ্গে আনা হয়৷ জঙ্গিদের এক হাতে হ্যান্ডকাফ ছিল৷ কোনো ডান্ডাবেড়ি পরানো ছিল না৷ আর একজন কনস্টেবল মাত্র তাদের নিরাপত্তায় ছিল৷”

তার কথা, ‘‘এইভাবে সাধারণ আসামিদের মতো তাদের আদালতে আনায় আমি বিস্মিত হয়েছি৷ এখানে দায়িত্বে অবহেলা স্পষ্ট৷’’

বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, আদালতে আটক আসামি আনার প্রক্রিয়া হলো, যে থানার মামলায় আসামিদের হাজিরা, সেই থানার পুলিশ কারাগারে গিয়ে আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে আসবেন৷ এরপর আদালত এলাকায় এনে প্রসিকিউশন পুলিশকে (কোর্ট পুলিশ) বুঝিয়ে দেবেন৷ তারা আসামিদের প্রথমে কোর্ট হাজতে রেখে তারপর আদালতে হাজির করবেন৷ আদালতের কাজ শেষে তারাই প্রিজন ভ্যানে উঠিয়ে দেবেন৷ এরপর আবার কারাগার পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ নিয়ে গিয়ে কারাগারকে বুঝিয়ে দেবেন৷

এই দুই জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে প্রসিকিউশন বা কোর্ট পুলিশের কাছে থাকা অবস্থায়৷ তবে হ্যান্ডকাফ, হেলমেট ডান্ডাবেড়ি এগুলো কারাগার থেকেই পরানোর কথা৷

ওই জঙ্গিদের ঢাকার আদালতে আনা হয়েছিল কাশিমপুর কারাগার থেকে৷ কাশিমপুর কারাগারের জেল সুপার তরিকুল ইসলাম দাবি করেন, “আমাদের দায়িত্ব হলো কারাগারের ভিতরে৷ আদলাতে আসামিদের নেয়া এবং কারাগারে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব কোর্ট পুলিশ ও থানা পুলিশের৷ আমরা তাদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে আসামিদের রেডি রাখি৷ তারা কীভাবে নেবেন, হ্যান্ডকাফ বা ডান্ডাবেড়ি পরাবেন কিনা তা তাদের দায়িত্ব৷ হ্যান্ডকাফ তারাই নিয়ে আসেন৷”

প্রসিকিউশনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. জসিম উদ্দিন জানান, ‘‘আসামিদের নিরাপত্তার জন্য জেল কোডেই বলা আছে৷ কাদের ডান্ডাবেড়ি পরানো হবে, কাদের শুধু হ্যান্ডকাফ- এটা জেলখানাই নির্ধারণ করে৷ আমরা কারাগারকে আগেই জানিয়ে দিই আসামি কী প্রকৃতির৷ আমরা এই জঙ্গিদের ব্যাপারেও জানিয়েছিলাম৷’’

তার মতে, “ওই জঙ্গিদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেয়া হয়নি৷ মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের কারাগার থেকেই হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও ডান্ডাবেড়ি পরানোসহ আরো যেসব নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল তা নেয়া হয়নি৷ তাদের সাধারণ আসামিদের সঙ্গে আনাও ঠিক হয়নি৷ আমরা জঙ্গি বা দুর্ধর্ষ আসামিদের আলাদাভাবে আনতে বলি৷”

তবে আদালতে আনার পর জঙ্গিদের নিরাপত্তার বিষয়টি যথাযথভাবে নেয়া হয়নি বলে তিনি স্বীকার করেন৷ তিনি এজন্য জনবলের অভাবকে দায়ী করেন৷ তিনি বলেন, “আমার জনবলের সংকট আছে৷ প্রত্যেকদিন গড়ে ৫০০-৬০০ আসামি আসে৷ তাদের জন্য আমার আছে ১৫০ জন পুলিশ সদস্য৷ তাই পর্যাপ্ত পুলিশ জঙ্গিদের সঙ্গে দেয়া যায়নি৷”

এখন পর্যন্ত জঙ্গিদের ঘটনায় যে পাঁচজন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তারা সবাই প্রসিকিউশনের৷

আইনজীবী অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদার অবশ্য বলেন, “২০১৭ সালের মার্চে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানো নিষিদ্ধ করেন৷ এটা জেলখানার মধ্যে কোনো অপরাধ করলে তার একটি শাস্তি৷ তবে আদালত আসামিদের ধরন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তার কথা বলেছে৷ আসামিদের অপরাধ ও ধরন বুঝে এটা করতে বলা হয়েছে৷”

তিনি বলেন, “জেল কোড অনুযায়ী, আসামিদের আদালত পর্যন্ত আনা এবং নিয়ে যাওয়া ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব৷ বাকিটা দেখে প্রসিকিউশন পুলিশ৷”

এসব বিষয় নিয়ে আইজি প্রিজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি৷

পুলিশের সাবেক ডিআইজি এবং গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সৈয়দ বজলুল করিম মনে করেন, “এখানে গোয়েন্দা ব্যর্থতাও আছে৷ এমনকি এই ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদেরও হাত থাকতে পারে৷ তা না হলে জঙ্গিরা আগে থেকে কীভাবে জানবে যে তাদের ছিনিয়ে নেয়া হবে৷ জঙ্গিদের সাথে তো কারো দেখা করার সুযোগ থাকার কথা না৷ আর মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত জঙ্গি জানার পরও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা উদ্দেশ্যমূলকও হতে পারে৷”

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button