গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সবার আবাসন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে একটি ‘উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প’। ২০০৯ সালে এই প্রকল্প হাতে নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। নানা ঝক্কি-ঝামেলা শেষে উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরে ওই প্রকল্পের ১৬তলা ভবন দাঁড়িয়ে গেছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য কিস্তিতে ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু সেই ফ্ল্যাটের দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নিম্নবিত্ত তো দূরে থাক, মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ফ্ল্যাটের আবেদন থেকে বুঝে পাওয়া পর্যন্ত ১ হাজার ২৭৬ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম পড়বে ৯৩ থেকে ৯৫ লাখ টাকা। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজউককে ব্যবসায়িক চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের বিধিবদ্ধ পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, প্রথমত রাজউককে এ ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম থেকে সরাতে হবে। তাদের সক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ এবং পরিকল্পনা প্রণয়নে সীমিত করে দিতে হবে। স্বল্পমূল্যে ফ্ল্যাট সরবরাহের সক্ষমতা রাজউকের নেই। সামর্থ্যরে সংজ্ঞা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা আকাশছোঁয়া। তারা বলছে, প্রতি বর্গফুট ৪ হাজার ৮০০ টাকা। সেখানে জমির দাম ধরছে না, সেটি ধরলে প্রতি বর্র্গফুটের দাম ৬ হাজার টাকার ওপরে পড়ে। কেউ যদি ৬ হাজার টাকা প্রতি বর্র্গফুট নির্মাণ করে তাতেও ৬০ লাখ টাকায় হয়ে যাওয়ার কথা। ইকবাল হাবিব
বলেন, ‘শুধু ন্যাশনাল হাউজিং অথরিটির মাধ্যমেই স্বল্পমূল্যের আবাসন সম্ভব। খরচ নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেকসই উপায়ে কীভাবে বাড়ি বানাতে হয়, সেই সম্পর্কে রাজউকের অজ্ঞতা রয়েছে। ফ্ল্যাট কেমন হবে, সে ব্যাপারে সুবিধাভোগীদের মতামত নেওয়া দরকার ছিল, যেটি রাজউক করেনি। সরকার তাদের দিয়ে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় অর্থের অপচয় হচ্ছে। নতুন ড্যাপের মাধ্যমে রাজউক যে জনঘনত্বের বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তাতে তাদের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প সাংঘর্ষিক। রাজউক এগুলো সাধারণ মানুষের জন্য করছে না, করছে নিজেদের জন্য। কারণ তাদের লাভ। তাদের টার্গেট এখন রাজউক কর্মকর্র্তা-কর্র্মচারীদের জন্য একটা জায়গা অথবা প্রত্যেকের জন্য ফ্ল্যাট নির্র্মাণ করা, সেদিকে তারা যাচ্ছে। কাজেই তাদের টার্গেট জনগণ, নাকি তাদের টার্গেট নিজেদের উন্নয়ন- এটাই এখন বড় প্রশ্ন।’
দাম বেশি পড়ার বিষয়টি স্বীকার করে উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক ও রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোজাফফর উদ্দিন বলেন, ‘এখন অল্পকিছু ফ্ল্যাট খালি আছে। প্রথম দিকের সার্কুলারে অধিকাংশ ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে। মেট্রোরেল প্রকল্প দেরি হওয়াতে আমাদের প্রকল্পে ফ্ল্যাটগ্রহীতাদের আগ্রহে ভাটা পড়ে। তবে এখন আর সেই সমস্যা নেই। প্রথমদিকে প্রতি বর্গফুটের দাম ছিল ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এখন যেহেতু রেডি ফ্ল্যাট, তাই ৪ হাজার ৮০০ টাকা ধরা হয়েছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের বলা হয় এ কারণে যে, কেউ ফ্ল্যাটের অর্ধেক টাকা দিলে মালিকানা বুঝে পাবেন। এরপর যেভাবে বাসা ভাড়া দিতেন, সেভাবেই কিস্তিতে ৮ বছরে বাকি টাকা শোধ করতে পারবেন।’
রাজউকের ফ্ল্যাটে মানুষের অনাগ্রহের কারণ হিসেবে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি ফ্ল্যাটে যা মূল্য তাই দেখাতে হয়, রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। সে কারণে এখানে হোয়াইট মানির একটা ব্যাপার থাকে। তাই অনেকে সামর্থ্য থাকলেও নিতে চান না। যে কারণে কিছু ফ্ল্যাট ফেরত দিচ্ছেন।’
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ২১২ একর জমিতে এসব ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে রাজউক। তবে সেই প্রকল্প আলোর মুখ দেখতে শুরু করে ২০১০ সালের ২১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার মাধ্যমে। এরপর ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৫৮৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। প্রথমে প্রকল্প শেষ করার সময়সীমা ছিল ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরপর সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এখন সব ভবন নির্র্মাণ করা হলেও সেখানে বসবাস শুরু হয়নি। যোগাযোগব্যবস্থা, স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য সুবিধা না থাকায় ফ্ল্যাট নিয়েও বসবাস করতে চাচ্ছেন না মালিকরা। তাই অনেকে ফ্ল্যাট ফেরত দিতে রাজউকে ঘুরছেন।’
ফ্ল্যাটের আবেদন ও খরচ
প্রথমে রাজউক নির্র্ধারিত ব্যাংকের মাধ্যমে ২ হাজার টাকা দিয়ে একটি আবেদন ফরম সংগ্রহ করতে হবে। সঙ্গে জামানত বাবদ ব্যাংকে দিতে হবে ৪ লাখ টাকা। এরপর যাচাই-বাছাই করে সাময়িক বরাদ্দপত্র বুঝিয়ে দেবে রাজউক। সাময়িক বরাদ্দপত্র দেওয়ার পর ৮ লাখ ৯২ হাজার ৪০০ টাকা জমা দিতে হবে ৪ কিস্তিতে। সেটার পর ফ্লাটের জন্য লটারি হবে। সেখানে যার ভাগ্যে যে ফ্ল্যাটটি উঠবে, তার সেই ফ্ল্যাটের আইডি দেবে রাজউক। এরপর লটারি বিজয়ী ব্যক্তির চূড়ান্ত বরাদ্দপত্র দেওয়া হবে এবং ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর করা হবে। চাবি হস্তান্তরের পর ওই ব্যক্তি চাইলে ফ্ল্যাটে উঠে যেতে পারবেন। এরপর ইউটিলিটি সার্ভিস চার্র্জ ও কার পার্কিং বাবদ ৫ লাখ টাকা জমা দিতে হবে। পরে বাকি টাকা ৮ বছরের সমান কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। এই টাকার ক্ষেত্রে কিস্তি সুবিধার নামে ৯ শতাংশ হারে বাড়তি টাকা দিতে হবে। প্রথম বছরে প্রথম কিস্তির ৪ লাখ ও কিস্তি সুবিধার ৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা দিতে হবে। পরের বছর মূল ৪০ লাখ থেকে ৪ লাখ বাদ দিয়ে ৩৬ লাখের ৯ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। এভাবে কিস্তির মাধ্যমে ৪০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে পারবে ৮ বছরে। তবে কেউ চাইলে চূড়ান্ত বরাদ্দপত্রের পর পুরো টাকা দিয়ে সুদের হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন। প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ হাজার ৮০০ টাকা। তবে ফ্ল্যাট রেডি হওয়ার আগে এই মূল্য ছিল প্রতি বর্গফুট ৩ হাজার ৫০০ টাকা। ২০১৯ সালের পর দাম বাড়িয়ে ৪ হাজার ৮০০ টাকা করা হয়েছে। ফলে একটি ১ হাজার ২৭৬ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম পড়বে ৮৬ লাখ টাকা। রেজিস্ট্রশন ফি ৫ লাখ ও অন্যান্য চার্জসহ একটি ফ্ল্যাটের মূল্য দাঁড়ায় ৯৩ লাখ টাকা।
প্রকল্পে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা
একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি কেন্দ্রীয় মসজিদ, কনভেনশন হল, কমার্শিয়াল স্পেস, সুপারশপ, শোরুম অ্যান্ড কিচেন মার্কেট , সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, সব সার্ভিসলাইন- ওয়াসা, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, টেলিফোন, ক্যাবল নেটওয়ার্ক, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ব্যবস্থা, গাড়ি পার্কিং সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধাদি।
প্রকল্প এলাকায় ১৬ তলার ১৮৩টি ভবনে ১৫ হাজার ৩৭৫টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘এ’ ব্লকে ৭৯টি ভবনে রয়েছে ৬ হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট। এই ভবনের প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ১ হাজার ৬৫৪ বর্গফুট (গ্রস)। তবে ফ্ল্যাটের নিট আয়তন ১ হাজার ২৭৬ বর্গফুট। ব্লক ‘বি’-তে ৫২টি ভবনে ৪ হাজার ৩৬৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ১ হাজার ২৫০ বর্র্গফুট, গ্রস ১ হাজার ৬৪১ বর্র্গফুট। ‘সি’ ব্লকের ৫২টি ভবনে ৪ হাজার ৩৬৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে। যার প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ৮৫০ বর্র্গফুট, গ্রস ১ হাজার ২২০ বর্গফুট।
সূত্র: আমাদের সময়