গাজীপুরে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবী
নিজস্ব সংবাদদাতা : অপরিকল্পিত শিল্পায়ণ ও নগরায়ন, কৃষি জমির অপব্যবহার, বায়ূদূষণ, খালবিল-নদীনালার অবৈধ দখল-ভরাট, অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্যসহ বর্জ্য নদনদী ও জলাশয়ে অবাধে অপসারণ প্রভৃতি কারণে পরিবেশ দূষণে গাজীপুর বসবাসের অনুপযোগি শহরে পরিনত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জেলার বিভিন্ন কমিউনিটির মানুষ।
ভয়াবহ দূষণ থেকে গাজীপুরকে বাঁচাতে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারী ও বেসরকারী সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সাথে জনসচেতনতা ও সব শ্রেনীপেশার মানুষকে পরিবেশ দূষণরোধে এগিয়ে আসতে হবে বলে মতামত দিয়েছেন।
সোমবার (০৭ নভেম্বর) “পরিবেশ দূষণে বিপর্যস্ত গাজীপুর: উত্তরনের উপায়” শীর্ষক গণশুনানীতে অংশ নেয়া জেলার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এসব কথা বলেছেন।
জেলা শহরের শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার অডিটরিয়ামে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র আয়োজনে ওই গনশুনানী অনুষ্ঠিত হয়। বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মো. আনিসুর রহমান। বক্তব্য রাখেন গাজীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রীনা পারভীন, ভাষা শহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক, বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন প্রমূখ।
গাজীপুরের শিল্প দূষণ, নদী-খাল-জলাশয়ের বর্তমান অবস্থ, বন দখল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জনদুর্ভোগ বিষয়ক উপস্থাপনা পেশ করেন ভাওয়াল বদরে আলম সরকারী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অসীম বিভাকর।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই গাজীপুরের পরিবেশ সমস্যার উপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। পরে পরিবেশ দূষণে ভূক্তভোগী জনগোষ্ঠির অভিযোগ উপস্থাপন ও মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ, ছাত্রছাত্রী, পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার বিভিন্ন পেশার লোকজন, সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ।
তাঁরা গাজীপুরের পরিবেশ বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরে বলেন, আইন লংঘন করে, একশ্রেণীর দখলদাররা এখানকার নদনদী, খালবিল জলাশয় বেদখল করে নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ও উন্মুক্ত জলাশয়ে শিল্পবর্জ্য ফেলার কারণে গাজীপুরের সব নদনদী ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়ে পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাতœক ক্ষতিসাধন করছে। জলাশয়গুলো জলজপ্রাণী ও মৎসশুন্য হয়ে পড়েছে। ফলে জলাশয় কেন্দ্রীক অনেক জনগোষ্ঠি তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। দখলে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে জেলার সরকারী পুকুর, খাল, লবনদহ নদী, বালু নদী, তুরাগ নদ, বানার নদ প্রভৃতি। অপরিকল্পিত উন্নয়ণের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে চাষযোগ্য ফসলী জমি ও বনভূমি। এতে গাজীপুরের পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জনজীবন ভয়ংকর পরিনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ থেকে গাজীপুরকে বাঁচাতে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
অনুষ্ঠানে গাজীপুরের পরিবেশ দূষণরোধে কতিপয় দাবী উত্থাপন করা হয়। এসব দাবীর মধ্যে রয়েছে, নদনদী, খাল, জলাশয়ের সীমানা চিহ্নিত করে সংরক্ষন করা, দখল ও দূষণরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, শিল্পকারখানাতে ইটিপি প্ল্যান্ট বসানো ও তা চালু রাখার ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, নতুন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে স্থানীয়দের জনমত গ্রহণপূর্বক পরিবেশগত প্রভাব নিরূপন, শহরের বর্জ্য সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞানসম্মত ও আধুনিক ব্যবস্থপনার আওতায় নিয়ে আসা, কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া, জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সকল সরকারী সংস্থর সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা, দেশে বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা, কৃষিজমি দখল ও বিরুদ্ধ ব্যবহার রোধ করে কৃষিজমি সুরক্ষা প্রদান, সংবিধান, আইন ও আদালতের আদেশ মেনে বনভূমির যথাযথ সংরক্ষণ এবং শিল্পায়ণের ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ও বিদ্যমান নিয়মনীতি কঠোরভাবে প্রতিপালন করা।
শুনানীতে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মো. আনিসুর রহমান বলেন, জেলায় সরকারের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর অনেক দায় রয়েছে। গত ত্রিশ বছরে গাজীপুরে অর্থনৈতিক ট্রান্সফরমেশন হয়েছে। আগে জলাশয়ের যে প্রবাহ খাল বিলে ছিল এখন আর নেই। তাঁর সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে দোষীদের নিবৃত করার চেষ্টা করেছেন।
তিনি আরো বলেন, সিটি করপোরেশনের ২০৬টি পুকুর বেদখল হয়ে গিয়েছিল। সেখানে ইতোমধ্যে আমরা ৮টি পুকুর উদ্ধার করেছি। আমার কাছে এনফোর্স করার মতো সুযোগ রয়েছে কিন্ত সাসটেইন করার মতো বাজেট নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে মিটিং করে সকল পুকুরগুলোকে একটি প্রকল্পের আওতায় এনে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। সাসটেইন করার দায়িত্ব তিনি জনসাধারণকে নেয়ার আহবান জানান। মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া গাজীপুরের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন।