আলোচিতজাতীয়

আবাদযোগ্য জমি অপচয়ে শীর্ষে বান্দরবান, সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : অবাধ নগরায়ণ, অবকাঠামো নির্মাণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে প্রতিনিয়ত কমছে দেশের কৃষিজমির পরিমাণ। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। আবাদযোগ্য যে পরিমাণ জমি এ মুহূর্তে দেশে রয়েছে তাও পুরোপুরি চাষাবাদের আওতায় আসছে না। সে হিসেবে দেশে প্রায় ৬ লাখ ৭১ হাজার একর বা ৬ কোটি ৭১ লাখ শতক আবাদযোগ্য জমি অপচয় হচ্ছে। জেলাভিত্তিক হিসাবে, বান্দরবান, ফরিদপুর ও সুনামগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি আবাদযোগ্য জমির অপচয় হচ্ছে। জমি অপচয়ের শীর্ষ ১০ জেলার চারটিই সিলেট বিভাগের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট জ্বালানি ও খাদ্য সংকটের প্রেক্ষাপটে কিছুদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবাদযোগ্য প্রতি ইঞ্চি জমির যথাযথ ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করছেন। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, আসন্ন সংকট মোকাবেলায় অপচয় হওয়া ভূমির বড় এ অংশটিতে চাষাবাদ করা গেলে ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে তা ভূমিকা রাখবে।

বিবিএস প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ভূমির পরিমাণ ৩ কোটি ৬৪ লাখ ৬৫ হাজার একর। এর মধ্যে ২ কোটি ৮১ হাজার একর জমিতে চাষাবাদ হয়। এছাড়া প্রায় ৬ লাখ ৭১ হাজার একর জমি আবাদযোগ্য হওয়ার পরও তা চাষের আওতায় আসেনি, যা মোট ভূমির প্রায় ১ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

পরিসংখ্যানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট আবাদযোগ্য জমি অপচয়ে শীর্ষে রয়েছে বান্দরবান জেলা। জেলাটির মোট ভূমির পরিমাণ ১১ লাখ ৭ হাজার একর। এর মধ্যে ১ লাখ ৬ হাজার একর আবাদযোগ্য জমি অপচয় হচ্ছে, অর্থাৎ এসব জমি চাষের আওতায় আসছে না। বান্দরবানের মাত্র ৮১ হাজার একর জমিতে ফসলের আবাদ হয়। যদিও জেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, আবাদকৃত জমির পরিমাণ ১ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর।

স্থানীয়রা বলছেন, পার্বত্য এ জেলার মূলত সমতল ভূমিতেই চাষাবাদ করা হয়। তবে যেহেতু এখানে বেশির ভাগই পাহাড়ি জমি, তাই কিছু পাহাড়ি স্থানে জুমের ফসল, কফি, কাজুবাদাম ও আনারসসহ বিভিন্ন ফলের চাষ করা হয়। এর বাইরে বড় একটি অংশ আবাদের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এছাড়া জেলার সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর তীরবর্তী স্থানেরও একটি অংশ আবাদের বাইরে থাকছে।

আবাদযোগ্য ভূমি অপচয়ের দিক থেকে বান্দরবানের পরই সুনামগঞ্জ জেলার অবস্থান। জেলার ৯ লাখ ২৬ হাজার একর জমির মধ্যে ৪৬ হাজার একর আবাদযোগ্য জমি চাষের আওতায় আসছে না। হাওরের রাজধানী খ্যাত জেলাটির পাঁচটি উপজেলা সীমান্তবর্তী। জেলা সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার অধিকাংশ এলাকার সীমান্তে অনেক আবাদযোগ্য জমি অনাবাদি রয়েছে। এ জমির বড় অংশ পাহাড়ি ও নদীতীরবর্তী। এসব জমিতে সবজি, ফলমূলসহ নানা ধরনের ফসল চাষ করা সম্ভব। কিন্তু বন্যা, পাহাড়ি ঢলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির শঙ্কায় এসব জমিতে কৃষকরা ফসল চাষে আগ্রহী হন না।

হাওর এরিয়া আপলিস্টমেন্ট সোসাইটির (হাউস) নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, মেঘালয়ের পাদদেশে সুনামগঞ্জ জেলা। এ জেলার পাঁচটি উপজেলা সীমান্তবর্তী। বর্ষার মৌসুমে প্রায় সময় সীমান্ত এলাকায় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে বালি, পাথর ও পলি মাটিতে কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। অথচ এসব এলাকার অনাবাদি জমিগুলো চাষাবাদের আওতায় নেয়া গেলে তা দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে। সীমান্তবর্তী এলাকায় নতুন উদ্যোক্তারা আনারস, লেবু, ফুল, ফলের চাষাবাদ করলে সফল হতে পারবেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ অফিসার মোস্তফা ইকবাল আজাদ বলেন, জেলা সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলায় এক-দেড় হাজার হেক্টর অনাবাদি জমি চাষাবাদ করার মতো। অনেক জায়গায় চাষাবাদ হচ্ছে আবার অনেক জায়গায় হচ্ছে না। সীমান্তবর্তী হাসাউড়ায় আনারস, লেবু ও ধান চাষ হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি পর্যায়ক্রমে সব অনাবাদি জমিতে চাষাবাদ করার।

আবাদযোগ্য জমি অপচয়ে বান্দরবান ও সুনামগঞ্জের পরই ফরিদপুর জেলার অবস্থান। জেলাটির ৫ লাখ ৭ হাজার একর জমির মধ্যে ৪৩ হাজার একর আবাদযোগ্য জমি অপচয় হচ্ছে। কয়েকটি উপজেলার মধ্য দিয়ে পদ্মা নদী বয়ে যাওয়ায় নদীর চরাঞ্চলের জমিগুলো চাষের আওতায় আসছে না। আবার নদীভাঙনের শঙ্কা মাথায় নিয়ে কৃষকরাও চাষ করতে চান না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

এছাড়া আবাদযোগ্য জমি অপচয়ের ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০ জেলার মধ্যে এর পরেই রয়েছে সিলেট, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ। এর মধ্যে সিলেটে ৩৯ হাজার একর, নেত্রকোনায় ৩২ হাজার একর, মৌলভীবাজারে ৩১ হাজার একর, চট্টগ্রামে ২৯ হাজার একর, টাঙ্গাইলে ২৩ হাজার একর, হবিগঞ্জে ২১ হাজার একর ও কিশোরগঞ্জে ২১ হাজার একর আবাদযোগ্য জমি চাষের আওতায় আসেনি বা অপচয় হচ্ছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অনাবাদি জমি অপচয়ের মধ্যে শীর্ষ জেলাগুলোর চারটিই সিলেট বিভাগের। বিভাগটিতে ৩১ লাখ ২২ হাজার একর ভূমির মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার একর আবাদযোগ্য জমি চাষের আওতায় আসেনি। এখানে প্রবাসীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের মালিকানাধীন জমিগুলো চাষে তাদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা রয়েছে। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন কাউকে চাষ করতে দেয়া হলে মালিকানা নিয়ে সমস্যা তৈরি হওয়ার শঙ্কায় মূলত প্রবাসীরা অন্য কাউকে চাষ করতে দেন না। ফলে এসব আবাদি জমিও অনাবাদি অবস্থায় পড়ে থাকে। এক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এসব জমিতে লাভজনক ও রফতানিযোগ্য ফসল চাষে প্রবাসী মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের আগ্রহী করে তোলার প্রক্রিয়া চলমান।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশে আবাদযোগ্য অনাবাদি জমির পরিমাণ কম নয়। সবচেয়ে বেশি সিলেটে। এর পরই চট্টগ্রামে। এসব জমি চাষের আওতায় আনা সম্ভব কিন্তু নানা কারণে আনা যাচ্ছে না। সিলেটে প্রবাসী বেশি থাকায় তারা নিজেরাও জমি চাষ করেন না, কাউকে করতেও দেন না। এর বাইরে এখন খুলনাসহ উপকূলবর্তী অঞ্চলের প্রচুর মানুষ নিজের জমি ফেলে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে স্থানান্তরিত হয়েছেন। এসব জমিও মালিকানা নিয়ে সমস্যা সৃষ্টির শঙ্কায় অন্য কাউকে চাষ করতে দেয়া হয় না। আবার আবাদি জমির মালিকদের একটি অংশের পুরুষরা চাকরির জন্য অন্য শহরে থাকেন। বাড়ির নারীরাই মূলত পরিবার দেখাশোনা করেন। কিন্তু জমিতে ফসল ফলানোর মতো কাজ তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয় না। ফলে এসব পরিবারের জমিও অনাবাদি থাকছে। এতে সার্বিকভাবে দেশ উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ দিকটিতে অবশ্যই গুরুত্ব দেয়া উচিত। সরকারও এখন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদেও এটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আসন্ন সংকট মোকাবেলায় এ জমিগুলো যদি চাষের আওতায় আনা যায় তাহলে উৎপাদন অনেক বাড়ানো সম্ভব।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, আবাদযোগ্য কিন্তু চাষ হচ্ছে না এমন জমি মূলত সিলেট অঞ্চলে বেশি। সিলেট অঞ্চল আমাদের জন্য একটু চ্যালেঞ্জিং। এখানকার যারা জমির মালিক তারা অনেকেই বিদেশে থাকেন। তারা জমি নিজেরা চাষ করতে চান না। অন্য কাউকে দিয়েও চাষ করাতে চান না। তারা মনে করেন, মালিকানা নিয়ে পরে ঝামেলা হতে পারে। সে কারণে আমরা তাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করে কীভাবে জমি চাষাবাদের আওতায় আনা যায় সে প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছি। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গেও কথা বলেছি। বিশেষ করে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে রফতানিযোগ্য পণ্যগুলো যদি আমরা এসব জমিতে উৎপাদন করতে পারি, তাহলে প্রবাসীরাও হয়তো নিজেদের জমি চাষের বিষয়ে আগ্রহী হবেন।

প্রতিকূলতাসহিষ্ণু জাতের উন্নয়ন নিয়ে কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যান্য অঞ্চলে যেসব জমি আছে তার মধ্যে কিছু জমি পানির নিচে। ফলে জলাবদ্ধতাসহিষ্ণু জাতের ফসল নিয়ে কাজ হচ্ছে। লবণাক্ত জমিতে লবণসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। আমাদের নতুন চরাঞ্চলে মূলত সমস্যা হচ্ছে সেচের। সেখানে বালি মাটিতে পানির ধারণক্ষমতা খুবই কম। ফলে সেচ দিলেও পানি জমিতে থাকে না। এ কারণে বিএডিসি ও বারির উদ্যোগে প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব জমি চাষের আওতায় নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল এরই মধ্যে চাষের আওতায় এসেছে।

অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে সচিব বলেন, পাহাড়ি অঞ্চলের উঁচু-নিচু জমি চাষের আওতায় আনা যেতে পারে। এরই মধ্যে আমরা ক্রপ জোনিংয়ের মাধ্যমে দেখেছি পাহাড়ি অঞ্চলে ভুট্টা ভালো চাষ হতে পারে। আবার উঁচু জায়গাগুলোতে ফলবাগান করা যেতে পারে। কফি ও কাজুবাদাম এরই মধ্যে সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া চলছে। সেমি পাহাড়ি অঞ্চলেও চাষের আওতায় আনার জন্য আনারস ও অন্যান্য ফসলের নতুন জাতের সম্প্রসারণ হচ্ছে। চরাঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা ও উপকূলীয় অঞ্চলের এসব জমি নিয়ে আলাদা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button