গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সংসদ নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকা না থাকা নিয়ে বিতর্ক এবং বিভ্রান্তির সূচনা হয়েছে। এই আলোচনায় একদিকে যেমন ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্যগত ভুল প্রচার করা হয়েছে, তেমনি এই প্রশ্নও তোলা হচ্ছে, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের প্রয়োজন আছে কিনা।
কেন একটি দেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকার তাগিদ আছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করা দরকার। এই প্রসঙ্গে নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের গুরুত্ব, বিশেষ করে বিদেশি পর্যবেক্ষকের গুরুত্ব এবং তাঁদের অনুপস্থিতির কারণে দেশের পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর ওপরে কী ধরনের দায়িত্ব বর্তাচ্ছে, তা উপলব্ধি করা দরকার।
বিতর্ক শুরু হলো কী করে?
আসন্ন নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা থাকবেন না বলে যে খবরটি প্রকাশিত হয়, তার উৎস হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ঢাকা প্রতিনিধির বক্তব্য যে, আর্থিক বিবেচনায় ইউনিয়ন এবার বাংলাদেশের নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক না পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খবরটি এই কারণে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে, অতীতে বাংলাদেশের সব অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনেই পর্যবেক্ষক ছিলেন এবং ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বড় আকারের পর্যবেক্ষক দল পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর; সেই নির্বাচনে প্রায় ছয়শ’ বিদেশি পর্যবেক্ষক ছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইন্সটিটিউট (এনডিআই) পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছিল এবং কমনওয়েলথের পক্ষ থেকেও পর্যবেক্ষক দল উপস্থিত ছিল। এর সঙ্গে ছিল স্থানীয় পর্যবেক্ষক৷ সব মিলে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার পর্যবেক্ষক ঐ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই বক্তব্যের পাশাপাশি গণমাধ্যমে জানা যায় যে, এ বছর মোট পর্যবেক্ষক দাঁড়াবে মাত্র ৪০ হাজার।
ইচ্ছাকৃত বিভ্রান্তি সৃষ্টি?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কারণ কেবল আর্থিক বিবেচনাপ্রসূত কিনা এই নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হবার এবং এই বিষয়ে পরস্পরবিরোধী খবর পাওয়ার প্রেক্ষাপটে ঢাকায় ২৬ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত একটি সাংবাদিক সন্মেলনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের রক্ষণশীল সদস্য রুপার্ট ম্যাথুসের একটি বক্তব্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বক্তব্য বলে সরকারি বার্তা সংস্থা দাবি করে। বাসসের পরিবেশিত ঐ খবরের ভাষ্য ছিল যে, ‘‘সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল বলেছে, বাংলাদেশ সরকার আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে আয়োজনে সক্ষম৷” ম্যাথুসকে উদ্ধৃত করে বলা হয় যে, ‘‘আসন্ন এই নির্বাচনে ইইউ পার্লামেন্ট কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না, কারণ, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বিশ্বাস করে, বাংলাদেশ নিজের মতো করেই নির্বাচনি পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভালোভাবেই প্রস্তুত।” ঐ সংবাদ সন্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ব্রাসেলসভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া ডেমোক্র্যাটিক ফোরাম (এসডিএএফ)-এর প্রতিনিধিরা। এসডিএএফ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ও এখানকার বিভিন্ন গণতান্ত্রিক গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে তাঁদের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বাংলাদেশের কোনো একটি দল বা প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রনে ঢাকা গিয়েছিলেন।
সরকারি বার্তা সংস্থা তাঁদের ইউনিয়নের প্রতিনিধি বলে দাবি করলেও এবং সরকারসমর্থকরা এই সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করলেও সাংবাদিক সন্মেলনে উপস্থিতরা যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করেন না, সেটা পরে ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে স্পষ্ট করা হয়৷ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টির দায়িত্ব হচ্ছে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ডেমোক্রেসি সাপোর্ট অ্যান্ড ইলেকশন কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের। সেই গ্রুপের দু’জন সহযোগী চেয়ারপার্সন ডেভিড ম্যাকঅ্যালিসটার ও লিন্ডা ম্যাকঅ্যাভান এক বিবৃতিতে জানান, ‘‘ইইউ পার্লামেন্টের কোনো সদস্যকে এই নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য করার দায়িত্ব দেয়া হয়নি। এ নিয়ে কোনো সদস্যের বক্তব্য ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করবে না৷ইপি’র কোনো সদস্য যদি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেন, সেটা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতামত হিসেবে বিবেচিত হবে না।”
ইইউ পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ভিন্ন ব্যাখ্যা
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কেন বাংলাদেশের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না তার একটি ভিন্ন ব্যাখ্যাও রয়েছে। সেই ব্যাখ্যার মূল বক্তব্য হচ্ছে, যেহেতু ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কেবলমাত্র সেখানেই তাদের পর্যবেক্ষকদের পাঠায়, যেখানে তারা একটি কার্যকর নির্বাচন, যার মাধ্যমে ঐ দেশের নাগরিকদের রায়ের প্রতিফলনের সম্ভাবনা দেখতে পান, যেখানে এই নির্বাচন গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় অবদান রাখবেন বলে মনে করেন, সেহেতু তারা কি বাংলাদেশে সেই সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না?
এই ব্যাখ্যার কারণ হচ্ছে, ইউরোপীয় মিশনের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মঘেরিনি গত ১১ অক্টোবর এক সন্মেলনে সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘‘কোনো পাতানো বা জালিয়াতির (রিগড) নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য আমরা উপযুক্ত নই।” আর ইইউ সেপ্টেম্বরে যখন এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা যে ছিল না, তা আমরা জানি।
এখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রেক্ষিতে ইউনিয়ন তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক মনে করছে কিনা, আমরা তা জানিনা। তবে বড় আকারের কোনো পর্যবেক্ষক দল যে তাঁরা পাঠাতে পারবেন না, সেটা নিশ্চিত৷ তার বদলে নির্বাচনের পূর্বের ও পরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে তারা দুই সদস্যের একটি নির্বাচন বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে পাঠিয়েছে, যে দলটি আগামী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে থাকবে। জানা গেছে যে, দরকার মনে হলে তারা এর পরেও বাংলাদেশে অবস্থান করবে।
অন্যরা কী করছে?
অতীতে অন্য দেশের পক্ষ থেকেও পর্যবেক্ষক পাঠানো হয়েছে। তাঁরা কী করছেন? যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে তাদের ১২টি পর্যবেক্ষক দল থাকবে এবং নিজস্ব অর্থায়নে কয়েক হাজার দেশীয় পর্যবেক্ষককে তারা এই কাজে নিয়োগ করবে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা উইলিয়াম ম্যোলার রয়টার্সকে বলেছেন যে, ১২টি দলের প্রত্যেকটিতে দুজন করে পর্যবেক্ষক থাকবেন। তাঁরা দেশের সব অংশেই চোখ রাখবেন, যদিও তাঁদের পক্ষে প্রত্যেক পোলিং স্টেশনে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তবে তিনি জানান, ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট, ব্রিটেনের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং সুইজারল্যান্ড সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগ করবে। তিনি আরো জানান যে, ব্যাংককভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস’ ৩০ সদস্যের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি একটি দল পাঠাবে। ইতিমধ্যেই এনডিআই-এর বাংলাদেশের কার্যালয় পর্যবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তৎপর হয়েছে। সম্প্রতি তারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা কামাল হোসেনের সঙ্গেও দেখা করেছে।
স্থানীয় পর্যবেক্ষক
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে বড় কাজটি করে স্থানীয় পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং তাদের কর্মীরা৷ নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে যে, কমিশনে নিবন্ধিত ১১৮টি সংস্থা কমিশনে তাদের পর্যবেক্ষক তালিকা পাঠিয়েছে। ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের দেয়া হিসেব অনুযায়ী, সব মিলিয়ে ৫০ হাজারেরও বেশি পর্যবেক্ষক এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। কিন্তু এই পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান নিয়েও বিতর্কে জড়িয়েছে ইসি, কেননা নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে সবচেয়ে পুরোনো সংস্থা ফেমা ও ব্রতী’র নাম। ফেমা ১৯৮৫-৮৬ সাল থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত; ব্রতী ১৯৯৬ সাল থেকে। ১১৯টি পর্যবেক্ষক সংস্থাকে এ বছরের জুন থেকে পরবর্তী ৫ বছরের জন্য নিবন্ধন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মোট আবেদন পড়েছিল ১৯৯টি। কিন্ত এত পুরোনো এবং অভিজ্ঞ দুই সংস্থাকে বাদ দেয়ার কারণ ইসি’র ভাষ্য অনুযায়ী সময় মতো আবেদন না করা; ফেমা এবং ব্রতী’র কর্মকর্তারা বলছেন যে, সময়ের পরে তাঁরা আবেদন করলেও ইসি তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিল। আর যে প্রতিষ্ঠানটি বাদ পড়েছে, তা হলো অধিকার৷ এনজিও ব্যুরোতে তাদের নিবন্ধন না থাকাকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অভিযোগ আছে যে, তালিকায় অনেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষক কেন দরকার হয়?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যাঁরা গণতন্ত্র এবং নির্বাচন বিষয়ে গবেষণা করেন, তাঁরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা করেছেন। যদিও সবাই এটা স্বীকার করেন যে, একমাত্র নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, কিন্ত তাঁরা এটা জোর দিয়ে বলেন যে, সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি অন্যতম দিক। ফলে ১৯৭০-এর দশক থেকে দেখা গেছে যে, এমনকি স্বৈরশাসকরা সাজানো নির্বাচনের আয়োজন করে নিজেদের গণতন্ত্রী বলে দেখানোর চেষ্টা করেন। সেই সময়েই গবেষকরা বলেন যে, কেবল নির্বাচন করাই যথেষ্ট নয়, সেগুলো সুষ্ঠু কিনা, অংশগ্রহণমূলক কিনা, সেটাও নিশ্চিত করা দরকার। দেখা দরকার নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য কিনা। এই পটভূমিকায়ই নির্বাচনের সততার বা ইন্টিগ্রিট্রির প্রশ্নটি গুরুত্ব লাভ করে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হলে তাতে বেশি ভোটার অংশ নেন। আলবার্টো সিম্পসারের ‘হোয়াই গভর্নর্মেন্টস অ্যান্ড পার্টিজ ম্যানিপুলেট ইলেকশন্স: থিউরি, প্র্যাকটিস অ্যান্ড ইমপ্লিকেশন্স’ (ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৪)-এ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। বিপরীতে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে তাতে ভোটারদের অংশগ্রহণ থাকে না এবং ভোটাররা নির্বাচনের পরে আন্দোলন ও বিক্ষোভে অংশ নেয়, যে বিষয়ে গবেষণার মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে, পীপা নরিস, রিচার্ড ফ্রাঙ্ক, ফেরান মার্টিনেজ ই কোমা’র গবেষণা, ‘কন্টেনশাস ইলেকশন্স: ফ্রম ভোটস টু ভায়োলেন্স’, যা তাদের সম্পাদিত গ্রন্থ ‘কনটেনশাস ইলেকশন্স: ফ্রম ব্যালটস টু বেরিকেডস’এ প্রকাশিত হয়েছে (রাটলেজ, ২০১৫, পৃষ্ঠা ১-২১)। এই বিবেচনা থেকেই তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ধারণা এবং সেই পদক্ষেপের সূচনা হয়।
প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণ করা দরকার যে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ধারণার উদ্ভব হয় ১৯৮৬ সালে, ফিলিপাইন্সে৷ ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ফার্ডিন্যান্ড মার্কোস যাতে নির্বাচনের ফলাফল বদলে দিতে না পারেন সেই জন্যে ন্যাশনাল সিটিজেন্স মুভমেন্ট ফর ফ্রি ইলেকশন্স (এনএএমএফআরএএল-নামফ্রেল)-এর প্রায় পাঁচ লাখ স্বেচ্ছাসেবী নাগরিকের ভোটাধিকার রক্ষায় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা নেন এবং যে সাফল্য অর্জন করেন তা-ই সারা দুনিয়ায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ধারা তৈরি করে। ক্রমান্বয়ে তা আন্তর্জাতিক রূপ নেয়। ২০১২ সালে জাতিসংঘে এই ধরনের সংগঠনগুলোর বৈশ্বিক কাঠামো থেকে পর্যবেক্ষণের নীতিমালা ও আচরণবিধি গৃহীত হয়। ১৯৮৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ৮৪টিরও বেশি দেশে ২ শতাধিক সংগঠন তৈরি হয়; আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোও এর সঙ্গে যুক্ত হয়।
যেসব ক্ষেত্রে নির্বাচনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বা নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবার আশঙ্কা থাকে, সেখানেই তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বিদেশি পর্যবেক্ষকের উপস্থিতির তাগিদ তৈরি হয়। নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বা যেসব দেশ গণতন্ত্রে উত্তোরনের পথে, সেখানে এই পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতির প্রয়োজন দেখা দেয়। গবেষকরা বলছেন যে, সেসব দেশে নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না বা যেসব দেশে ‘হাইব্রিড রেজিম’ (দৃশ্যত গনতান্ত্রিক, কিন্ত কার্যত স্বৈরতান্ত্রিক) উপস্থিত, সেখানে ক্ষমতাসীনরা ফলাফল বদলাতে পারে, আবার বিপরতক্রমে পরাজিতরা নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। এতে করে গোটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়ই ভন্ডুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিদেশিদের দ্বারা পর্যবেক্ষণের হার বৃদ্ধি পায় ১৯৯০-এর পরে। এর আগে মাত্র ৫টি দেশে পর্যবেক্ষণ মিশনের ইতিহাস রয়েছে। কিন্ত ১৯৯০ থেকে ২০১০ এর মধ্যে তার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রতি পাঁচটি নির্বাচনের চারটিতে। এইসব প্রর্যবেক্ষণের ফল এবং গবেষকদের বিশ্লেষণ হচ্ছে এই যে, ভোট জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশিত হবে- এই ভয় জালিয়াতি থেকে বিরত রাথতে সক্ষম হয়, পরাজিতরা ফলাফল মানতে আগ্রহী হয় এবং নির্বাচনে বিজয়ীদের বৈধতা তৈরি হয় ( এই বিষয়ে আলোচনা দেখুন, সুসান হাইড ও নিকোলে মারিনভ, ‘ইনফরমেশন অ্যান্ড সেলফ-এনফোরসিং ডেমোক্রেসিঃ দ্য রোল অব ইন্টারন্যাশনাল অবজারভার’, ইন্টারন্যাশনাল অর্গ্যানাইজেশন, বর্ষ ৬৮, সংখ্যা ২, পৃষ্ঠা ৩২৯-৫৯)।
গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে এটাও দেখা গেছে যে, একটি গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ নির্বাচন, যার সততা বা ইন্টিগ্রিটি নিশ্চিত করার জন্যে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়, বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে নজর রাখা দরকার। কী ধরনের বিষয়ের দিকে নজর রাখা জরুরি এবং কী ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজন, সে বিষয়ে নিয়মিতভাবে গবেষণা ও নজরদারি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা গড়ে তুলেছেন ইলেক্টোরাল ইন্টিগ্রিটি প্রজেক্টে। তাঁদের গবেষণষণতেও দেখা যাচ্ছে যে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের একটা বড় ভূমিকা আছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ, বিশেষত বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতির একটা অন্যতম দিক হচ্ছে, তা যাঁরা নির্বাচন পরিচালনা করেন তাঁদের ওপরে এক ধরনের অতিরিক্ত নজরদারির ব্যবস্থা করে এবং তাঁদের এক ধরনের জবাদিহিতার মুখোমুখি করে, যদিও দৃশ্যত পর্যবেক্ষকদের কোনো আইনি শক্তি্ই নেই। এটি এক ধরনের নৈতিক চাপের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। বিশেষত মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপরে এই ধরনের উপস্থিতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। শুধু তাই নয়, এতে করে প্রার্থীদের সমর্থকদের আচরণ প্রভাবিত হয়। কিন্ত সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে ভোটারদের ওপরে, কেননা এতে করে তাঁরা আস্থা পান।
বাংলাদশের আসন্ন নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সংখ্যা হবে সীমিত, ফলে দেশের যেসব সংস্থা পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের দায়িত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি৷ এই নির্বাচন তাদের জন্যেও এক বড় ধরনের পরীক্ষা বলেই বিবেচনা করা দরকার।