পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে নতুন রূপ দিচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট
গাজীপুর কণ্ঠ, আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পাকিস্তানকে ৪৫ কোটি ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত পাকিস্তান বিমান বাহিনীর এফ-১৬ বহরের রক্ষণাবেক্ষণকাজে ব্যবহারের জন্য এসব সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে ভয়াবহ বন্যায় দুর্গত পাকিস্তানে ত্রাণকাজে সহায়তার জন্য ১০টি মিশনও পাঠিয়েছে। ত্রাণকাজে ব্যবহারের জন্য মিশনগুলোকে মার্কিন বিমান বাহিনীর পরিবহন উড়োজাহাজও দেয়া হয়েছে। ইউএসএইডসহ বিভিন্ন সহযোগিতা সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে ১০ লাখ পাউন্ড ত্রাণসামগ্রী। এর বাইরেও ৩ কোটি ডলারের অর্থসহায়তার ঘোষণা দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। ওয়াশিংটন একই সঙ্গে পাকিস্তানে বন্যার্তদের সহযোগিতায় জাতিসংঘের ১৬ কোটি ডলারের সহায়তা তহবিল গঠনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আপত্তি নেই বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ সহকারী ডেরেক কোলেট। একই সঙ্গে ওয়াশিংটন এখন ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরালো করার পাশাপাশি সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়াতে আগ্রহী বলেও জানিয়েছেন তিনি।
চলতি বছরের শুরুতেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রাক্কালে দুই দেশের সম্পর্ক চরম শীতল পর্যায়ে পৌঁছেছিল। পাকিস্তানের ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাকে উত্খাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এককালের ঘনিষ্ঠ দুই দেশের তিক্ততা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে অনেকটাই ইউটার্ন নিয়ে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখন তার হারানো উষ্ণতা ফিরে পাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের পর্যবেক্ষণ হলো পাকিস্তানের চলমান অর্থনৈতিক সংকটই দেশটিকে আবারো যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল আফগান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। চলতি শতকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের শুরু করা ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ অন্যতম বড় অংশীদার হয়ে উঠেছিল পাকিস্তান। পরে তালেবানদের সক্রিয়ভাবে সহায়তার অভিযোগ ওঠে দেশটির বিরুদ্ধে। বিষয়টি পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এক ধরনের অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। এ ফাটলকে আরো বড় করে তোলে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) মাধ্যমে নীতিগতভাবেই চীনের দিকে আরো বেশি করে ঝুঁকতে থাকে পাকিস্তান। দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতেও আসে বড় ধরনের পরিবর্তন। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগী হয় দেশটি। এর সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্কে দূরত্বও বাড়তে থাকে।
বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রচ্ছন্নভাবে উষ্মাও প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিস ওয়েলসও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলেছিলেন, চীনের ঋণফাঁদের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিকে চাপে ফেলতে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) কাজে লাগানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে। পাকিস্তানের ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান রাশিয়া সফরে গেলে দুই দেশের সম্পর্কের তিক্ততা চরমে পৌঁছে। ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবারো সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নেয়। দেশটির সেনাবাহিনীপ্রধান কমর জাভেদ বাজওয়াও এ নিয়ে নানা পদক্ষেপ নিতে থাকেন। দেউলিয়াত্বের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাতে থাকেন তারা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটনও তাদের এ আহ্বানে সাড়া দেয়, বিশেষ করে আইএমএফের ঋণ পেতে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। আইএমএফের এ ঋণই পাকিস্তানের জন্য নতুন করে বৈদেশিক ঋণ অর্জনের সুযোগ করে দেয়।
এর মধ্যেই পাকিস্তানে দেখা দেয় মারাত্মক বন্যা। দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহতম এ বন্যার কালেও পাকিস্তানের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহও বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, পাকিস্তানের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ায় এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র হয়ে উঠেছিল ভারত। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ইস্যুতে ভারতকে সেভাবে পাশে পায়নি যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি রাশিয়ার ওপর বাণিজ্যিক বিধিনিষেধের উদ্যোগ নিলে এর প্রভাবে রুশ জ্বালানি তেলের দাম কমে যায়। এ সুযোগে রাশিয়া থেকে আমদানির মাধ্যমে জ্বালানি তেলের মজুদ বাড়িয়ে তুলছে ভারত। বিধিনিষেধে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোয় রুশ জ্বালানির বাজার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলেও ভারতের কল্যাণে নতুন বিকল্প বাজারের সন্ধান পেয়েছে দেশটি।
এসব কিছুই এখন এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকে পুরনো মিত্র পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী করে তুলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
চলতি বছরই পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৭৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে দীর্ঘদিন দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র হিসেবে দেখা হতো পাকিস্তানকে। ভূরাজনীতির স্নায়ুযুদ্ধকালীন সমীকরণগুলো দেশ দুটিকে একে অন্যের কাছাকাছি এনে দিয়েছিল। এ সম্পর্কের মধ্যে ফাটল তৈরি করেছিল আফগানিস্তানে তালেবানদের পুনরুত্থান এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি। পাকিস্তানের সর্বশেষ প্রশাসনগুলোর চীন ও রাশিয়া ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির কারণে তা রূপ নিয়েছিল মনকষাকষিতে। সে পরিস্থিতি কাটিয়ে এখন দুই দেশই একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা ফিরিয়ে আনতে মনোযোগী হয়েছে।
পাকিস্তানের চলমান অর্থনৈতিক সংকট ও বন্যাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কোন্নয়নের বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বলে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনভিত্তিক টাফটস ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ফাহাদ হোসেন। ভূরাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক পর্যবেক্ষণে তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানের বর্তমান সরকার ও সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রকে দেশটির ভূরাজনৈতিক কৌশলের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে ওয়াশিংটনও এখন পাকিস্তানকে আইএমএফের ঋণ পেতে সহায়তার পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। পাকিস্তানে বন্যা দেখা দেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কয়েকটি প্রতিনিধি দল এরই মধ্যে দেশটি সফর করেছে। এসব সফরের সময় তারা পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৭৫ বছর পূর্তি এবং সম্পর্কের গভীরতা বাড়ানোর কথা বলেছেন। একই সঙ্গে মার্কিন বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকেও পাকিস্তানে ত্রাণ পাঠানোর পাশাপাশি সহায়তা প্যাকেজ গ্রহণ করা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে ওয়াশিংটনে এখন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে বেশি।