
গাজীপুর কণ্ঠ, রাজনৈতিক ডেস্ক : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এখন থেকেই রাজনীতির মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখতে দলকে প্রস্তুত করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যার কারণে বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়া হবে না বলে সরকারি দলের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হলেও মাঠপর্যায়ে সেটার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। পাঁচ দিন ধরে বিভিন্ন জেলায় বিএনপির সভা-সমাবেশে বাধা ও হামলার ঘটনা ঘটছে। কোথাও কোথাও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করেও বিরোধীদের কর্মসূচি ঠেকানো হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সব দলকে ভোটে আনতে এবং দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরাজমান—এটা দেখাতে বিরোধীদের কর্মসূচি বিষয়ে কিছুটা নমনীয় অবস্থানে ছিল সরকার। এর মধ্যে বিএনপি ১১ আগস্ট নয়াপল্টনের সমাবেশে বড় জমায়েত করে। এটা সরকারি দল আমলে নিয়েছে। এর পাল্টা হিসেবে ১৭ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকাসহ সারা দেশে বড় সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ। এরপর ২২ আগস্ট দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদসহ নানা বিষয়ে জেলা পর্যায়ে লাগাতার বিক্ষোভ-সমাবেশ শুরু করে বিএনপি। ওই দিন থেকেই প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় বিএনপির কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হামলা হয়েছে।
কিছু কিছু স্থানে পুলিশও চড়াও হয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার (২৬ আগস্ট) সাত জেলায় বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা ও মারধর করা হয়েছে। বাধা দেওয়া হয়েছে আরও তিন জেলায়।
বিএনপির কর্মসূচিতে হামলার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, স্থানীয় অনেক সমস্যা থাকে। এগুলো স্থানীয় ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দল বা সরকারের কোনো নীতির অংশ নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চাই। এ জন্য বিরোধীরা শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে।’
তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনীতির মাঠে বিরোধীদের শক্ত অবস্থান করতে দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও সরকারের কৌশল হচ্ছে, বিরোধীদের বিষয়ে কখনো নমনীয়, কখনো কঠোরভাবে এগোবে। যেখানে বিরোধীরা বেশি সংগঠিত হাওয়ার বা প্রভাব দেখানোর চেষ্টা করবে, সেখানে চাপ দেওয়া হবে। আবার কোথাও কোথাও নির্বিঘ্ন কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে। আর এই পরিস্থিতিতে বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশের চেয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের বেশি তৎপর রাখবে আওয়ামী লীগ।
গত এক যুগে বিরোধীদের মোকাবিলার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সামনে থেকেছে। দলের ভূমিকা খুব একটা দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, সামনের দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকবে পেছনে। আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করবেন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপিসহ বিরোধীরা এবার হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে শিগগিরই যাবে না। তারা মিছিল-সমাবেশের মতো কর্মসূচিতে থাকবে। এ ধরনের কর্মসূচি আটকাতে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশি ব্যবহার করা হলে দেশে-বিদেশে ভুল বার্তা যাবে। এ জন্য দলকে সংগঠিত করে তাদের দিয়েই মাঠ দখলে রাখার কৌশল নেওয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনে চ্যাম্পিয়ন, তা গত তিনটি নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে। রাজনীতির মাঠেও চ্যাম্পিয়ন, এটা বিরোধীরা দেখবে আগামীতে।’
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ভারত সফর থেকে এসেই দলীয় কর্মকাণ্ডে মনোযোগ বাড়াবেন।
এ ক্ষেত্রে শুরুতে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ডাকা হবে। ওই বৈঠকে তৃণমূলের বিভেদ কমিয়ে শক্তি বাড়াতে বহিষ্কৃত নেতা-কর্মীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তৎপরতা শুরু হবে। গত কয়েক বছরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেসব নেতা দলের বিরোধিতা করে প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাইকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। গুরুতর অপরাধে যুক্ত অল্প কিছু নেতা-কর্মী ছাড়া প্রায় সবাইকে ফিরিয়ে আনা হতে পারে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
১৪ আগস্ট দলের আট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের নিয়ে গণভবনে বৈঠক করেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, বৈঠকে দলকে সংগঠিত করে মাঠ দখলে রাখার বার্তা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দলের বহিষ্কৃত নেতা-কর্মীদের কার কতটা অপরাধ, সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেন দলীয় প্রধান। এ ছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে এখন পর্যন্ত যেসব স্থানে সম্মেলন হয়েছে, সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশ দেন তিনি। পাশাপাশি যেখানে সম্মেলন হয়, সেখানে নভেম্বরের মধ্যে তা সম্পন্ন করার কথাও বলেন।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ দলের নেতা-কর্মীদের নির্বাচন সামনে রেখে এখনই প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তবে এটা মূল লক্ষ্য নয়, বরং বিরোধী দলকে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করাই দলের মূল লক্ষ্য। আর নির্বাচনে জেতার জন্য কৌশল মাঠের নেতা-কর্মীরা ঠিক করবেন না। এটা করার জন্য সরকার ও দলের কেন্দ্রীয়ভাবে দায়িত্ব পালনের মতো লোক আছে। প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য ইতিমধ্যে জরিপ শুরু হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, দলের জাতীয় সম্মেলন ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন—দুটির প্রস্তুতি একসঙ্গে নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। করোনা মহামারির কারণে দলীয় কর্মকাণ্ড কিছুটা ব্যাহত হলেও সেপ্টেম্বর থেকে পুরোদমে শুরু হবে। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস মাঠে রুখবে আওয়ামী লীগ। আবার নিজের সংগঠনও গোছাবে।
কমিটি গঠন দ্রুত শেষ করতে চায়
আগামী ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। এর মধ্যে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা আছে।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে আওয়ামী লীগের ৭৮টি জেলা কমিটি আছে (মহানগর কমিটিও জেলা মর্যাদার)। এর মধ্যে ৪৪টি জেলা কমিটির সম্মেলন হয়েছে। তবে অধিকাংশেরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। এ ছাড়া উপজেলা ও থানা কমিটি আছে ছয় শতাধিক। অর্ধেকের মতো সম্মেলন হয়েছে।
এগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়ে গেলে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ঢাকায় ডেকে নতুন নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। আগামী অক্টোবর থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
সূত্র: প্রথম আলো