গাজীপুরে ‘নীতিমালা উপেক্ষা’ করে প্রভাবশালীদের পুকুর ইজারা দিচ্ছে জেলা প্রশাসন!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সু-দৃষ্টি মাল্টিপারপাস কো–অপারেটিভ সোসাইটির নিবন্ধন বাতিল হয়েছে আট বছর আগে। অথচ এই সমিতির নামে গাজীপুরের গাছার পলাশোনার ৯ বিঘা আয়তনের একটি পুকুর মাছ চাষের জন্য পরপর দুই দফায় লিজ বা ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
অস্তিত্বহীন এই সমিতির নামে পুকুরটি ইজারা নেন যুবলীগ নেতা পরিচয় দেওয়া রাশেদুজ্জামান মণ্ডল। প্রথম দফায় ইজারা নেওয়ার পর পুকুরে মাছ চাষ করেছেন গাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন। এ নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত শুরু হলে ২০২০ সালে পুকুরটি ছেড়ে দেন ওসি।
৪ জুলাই প্রথম আলো- পত্রিকায় প্রকাশিত ‘শর্ত ভঙ্গ করে ইজারায় প্রভাবশালীরা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ সকল তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজীপুরের শুধু একটি পুকুরের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে, বিষয়টি তা নয়। সংশ্লিষ্ট নীতিমালা উপেক্ষা করে একের পর এক পুকুর ইজারা দিচ্ছে জেলা প্রশাসন। গত তিন বছরে (বাংলা বর্ষ ১৪২৬, ২৭ ও ২৮) ইজারা দেওয়া ৮৬টি পুকুরের মধ্যে ৩২টির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ইজারার ক্ষেত্রে শর্ত মানা হয়নি। এর মধ্যে ৯টি পুকুর গাজীপুর মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতার স্বজনেরা নামসর্বস্ব সমিতির নামে ইজারা নিয়েছেন। একজন আওয়ামী লীগ নেতার সহযোগীরা ইজারা নিয়েছেন চারটি পুকুর। দুটি পুকুর দখলে রেখেছেন ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা। এ ছাড়া যুবলীগ নেতারা ইজারা নিয়েছেন আরও ছয়টি পুকুর। বাকি ১১টি পুকুর স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে।
প্রভাবশালীদের তুষ্ট করতেই পুকুরগুলো তাঁদের ইজারা দেওয়া হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ। এমনকি মাছ চাষের অনুপযোগী পুকুরও ইজারা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, এগুলো খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে কে কীভাবে দখল করেছে।
ইজারার শর্ত মানা হচ্ছে না
সরকারি পুকুর ইজারা দেওয়া হয় জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি, ২০০৯ অনুসারে। এর প্রধান শর্ত হচ্ছে, মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে পুকুর ইজারা দিতে হবে। সমিতির কোনো সদস্য যদি মৎস্যজীবী না হন, তবে সমিতি ইজারা পাওয়ার অযোগ্য হবে। তবে ২০১২ সালে সংশোধিত নীতি বলছে, মৎস্যজীবী সমিতি না পেলে পুকুর আশপাশে বসবাসরত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত নিবন্ধিত সমিতিকে ইজারা দেওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে বেকার যুবক, বীর মুক্তিযোদ্ধা/মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, যুব মহিলা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত, আনসার ভিডিপি ও গ্রাম পুলিশ সদস্য এবং দরিদ্র ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সমিতি গঠিত হতে হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গাজীপুর জেলা প্রশাসন পুকুর ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব শর্ত মানছে না। শর্ত ভঙ্গ করে প্রভাবশালীদের পুকুর ইজারা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সম্প্রতি বদলি হওয়া গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মামুন সরদার বলেন, পুকুর ইজারার দরপত্র আহ্বান করেও উপযুক্ত সমিতি পাওয়া যায় না। এ কারণে যাঁরা আবেদন করেন, তাঁদের ইজারা দেওয়া হয়। এতে শর্ত ভঙ্গ হয় না বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর ভাষ্য, মৎস্যজীবী সমিতি না পেলে অন্য সমিতিকে পুকুর ইজারা দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, প্রভাবশালীদের ভয়ে অনেক সমিতি দরপত্রে অংশ নেয় না।
ওসিকে খাসপুকুর ‘উপহার’
পুকুর ইজারা পাওয়া কথিত যুবলীগ নেতা রাশেদুজ্জামান অস্ত্রসহ একাধিক মামলার আসামি। ২০১৯ সালের ২৭ মে দুটি বিদেশি পিস্তলসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করেন র্যাবের সদস্যরা। তখন র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, রাশেদুজ্জামানের বিরুদ্ধে অস্ত্রসহ ৯টি মামলা রয়েছে। তিনি স্থানীয়ভাবে ‘ভূমিদস্যু’ হিসেবে পরিচিত।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুরের গাছার পলাশোনার ৯ বিঘা আয়তনের পুকুরটি ইজারা নিয়ে রাশেদুজ্জামান সেটিতে ওসি ইসমাইল হোসেনকে মাছ চাষ করতে দেন। পুকুরটি তত্ত্বাবধান করতেন ওসির আপন ভাই আশরাফ উদ্দিন ও খালাতো ভাই বাচ্চু মিয়া। পুকুরের এক পাড়ের জমি ভাড়া নিয়ে ওসি ইসমাইল সেখানে একটি খামার গড়ে তুলেছিলেন।
ওসি ইসমাইল হোসেনের এ বিষয়টি নিয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) পক্ষ থেকে একটি তদন্ত করা হয়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেন তৎকালীন জিএমপির অপরাধ দক্ষিণ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মুহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন। তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘যুবলীগ নেতা’ রাশেদুজ্জামান মণ্ডলের কাছ থেকে পুকুরটি ভাড়া নেন ওসির স্বজনেরা।
রাশেদুজ্জামান মণ্ডল দাবি করেন, ওসি ইসমাইল বা তাঁর কোনো আত্মীয়কে পুকুর ভাড়া দেওয়া হয়নি। তবে সেখানে ওসির যাতায়াত ছিল। পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও সেখানে যেতেন।
ওসি ইসমাইল হোসেনও একই দাবি করেন। তিনি বলেন, তিনি বা তাঁর কোনো আত্মীয় ওই পুকুরে মাছ চাষ করেননি। তবে তিনি মাঝেমধ্যে সেখানে যেতেন।
অবশ্য স্থানীয়ভাবে পুকুরটিকে এখন ‘ওসির পুকুর’ হিসেবেই সবাই চেনে।
ইজারার নামে পুকুর দখলে প্রভাবশালীরা
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওসমান গণির বাবা রমজান আলী মোল্লা ‘জিরানীবাজার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’ নামের একটি সমিতির সভাপতি। এই সমিতির নামে কোনাপাড়ায় দুটি পুকুর ইজারা নিয়েছেন তিনি। তবে পুকুর দুটিতে মাছ চাষ করা হয় না। সেগুলো ভরাট করা হচ্ছে। এরই মধ্যে পুকুরের কিছু অংশ ভরাট করে দোকান তৈরি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রমজান আলী মোল্লা বলেন, এলাকার ছেলেরা কিছু করে খাবে, তাই পুকুর ইজারা নেওয়া হয়েছে। পুকুর দুটি মাছ চাষের উপযোগী নয়। আগে থেকেই সেখানে দোকান রয়েছে।
জিরানী বাজারের রিকশা ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি ফরহাদ হোসেন এবং চালক শ্রমজীবী কল্যাণ সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক রমিজ উদ্দিন মাধবপুর মৌজায় দুটি পুকুর ইজারা নিয়েছেন। এ দুটি পুকুরেও মাছ চাষ করা হচ্ছে না।ফরহাদ হোসেন ও রমিজ উদ্দিন ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওসমান গণির কর্মী হিসেবে পরিচিত।
ফরহাদ হোসেন বলেন, পুকুরগুলো তাঁদের দখলে রাখতেই ২০২১ সালের মার্চ মাসে দুটি সমিতি নিবন্ধন করা হয়। একটি পুকুরে আগে থেকে এক যুবক মাছ চাষ করছিলেন। তাঁকেই সেটিতে মাছ চাষ করতে দেওয়া হয়েছে। চারটি পুকুরই কাউন্সিলের ওসমান গণি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানান ফরহাদ।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের খাইলকৈর মৌজার ৭২ শতাংশ ও ৫৯ শতাংশ আয়তনের দুটি পুকুর কর্ণফুলী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির নামে ইজারা নেওয়া হয়েছে। পুকুর দুটি সমিতির নামে ইজারা নেওয়া হলেও সেগুলোতে মাছ চাষ করছেন সৈকত হোসেন। তিনি ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামানের চাচাতো ভাই।
সৈকত হোসেন বলেন, ‘কাউন্সিলরের মাধ্যমেই পুকুর ইজারা নিয়েছি। যে সমিতির নামে ইজারা আনা হয়েছে, ওই সমিতিকে বছরে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়।’
এ ছাড়া খাইলকৈরের সমতা সমবায় সমিতি, গাজীপুর গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন সিটি ক্লাব, একতা খাইলকৈর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, প্রত্যয় সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতিসহ আটটি সমিতির নামে ইজারা নেওয়া পুকুরগুলোর সুবিধাভোগী কাউন্সিলর মনিরুজ্জামানের আত্মীয়স্বজন ও তাঁর কর্মীরা।
মনিরুজ্জামান বলেন, সব নিয়ম মেনেই পুকুর ইজারা নেওয়া হয়েছে।
‘জবাবদিহির অভাব রয়েছে’
রাজনৈতিক চাপের কারণে জেলা প্রশাসন পুকুরগুলো দখলমুক্ত করতে পারছে না মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) গাজীপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির। তিনি বলেন, গাজীপুরের সরকারি পুকুরগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী। প্রশাসনের কর্মকর্তারা রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করতে পারেন না বলেই একের পর পুকুর বেদখল হচ্ছে। তিনি বলেন, এখানে জবাবদিহি ও সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। প্রশাসন ও প্রভাবশালী দখলদারদের জবাবদিহির আওতায় আনার পাশাপাশি আইন প্রয়োগ করা গেলে পুকুরগুলো দখলমুক্ত করা সম্ভব।
আরো জানতে………
গাজীপুরে ১৯২ সরকারি পুকুর বেদখল!
‘খাসপুকুরে’ গাছা থানার ওসি’র মৎস্য খামার!
সূত্র: প্রথম আলো