আলোচিতজাতীয়

টিকিটের আশায় রেলস্টেশনে রাতের পর রাত

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কমলাপুর রেলস্টেশনে এখন রাত আর দিন নেই৷ টিকিট না পেয়ে ঠায় দাড়ানো যাত্রীদের অনেকে৷ পরদিন যদি অন্য তারিখের টিকিট পাওয়া যায় সেই আশা তাদের৷

ঈদে রেলের আগাম টিকিট নিয়ে এবারও যাত্রীদের অভিযোগের অন্ত নেই৷ অনলাইনে টিকিট পাচ্ছেন না। রাত জেগে স্টেশনে লাইন দিয়েও টিকিট মিলছে না। নির্ধারিত দিনের টিকিট না পেয়ে তারা আবারো রাত জেগে অপেক্ষা করছেন। পরের তারিখের টিকিট পেতে চান তারা।

যাত্রীদের দাবি, অল্প কিছু টিকিট বিক্রির পর কাউন্টার থেকে বলা হচ্ছে যে, টিকিট শেষ৷ এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, ট্রেনের টিকিট যাচ্ছে কোথায়?

তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, যাত্রীদের দাবি সঠিক নয়৷ তাছাড়া চাহিদার চেয়ে টিকিটও অনেক কম৷

এদিকে এবারও গত ঈদে টিকিট জালিয়াতির জন্য অভিযুক্ত সহজ ডটকমকে অনলাই ও কাউন্টারে টিকেট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়ায় প্রশ্ন উঠেছে৷

কোহিনুর বেগম ও তার এক বান্ধবী ঈদে দিনাজপুরে গ্রামের বাড়িতে যাবেন৷ চাকরির পড়াশুনার জন্য তারা ঢাকায় থাকেন৷ শনিবার রাত ১১টায় ট্রেনের অগ্রিম টিকিটের জন্য কমলাপুর রেলস্টেশনে লাইনে দাঁড়ান তারা৷ কিন্তু রোববার সকালে তারা টিকিট পাননি৷ তারা কাউন্টারে পৌঁছানোর আগেই টিকিটি শেষ হয়ে যায়৷

কোহিনুরের সঙ্গে কথা হয় রোববার বিকেল চারটার দিকে। তিনি জানান, ‘‘রাতে আমরা স্টেশনেই লাইন ধরে থাকি এখানেই ঘুমাই, খাওয়াদাওয়া করি। সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত এভাবে থাকব ৷ তখন এই লাইনে পরবর্তী তারিখের টিকিট দেয়া হবে, যদি পাই এই আশায়৷”

কোহিনুরের মত আরো অনেকেই ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা ধরে টিকিটের আশায় স্টেশনে আছেন। একটি কাউন্টারে তিনশজন টিকিটের জন্য লাইনে আছেন।

জানা গেছে, ওই কাউন্টার থেকে ৫০ জনকে টিকিটি দেয়ার পর বলা হচ্ছে টিকিট শেষ। বাকিরা অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী তারিখের টিকিটের জন্য।

আরেক যাত্রী রাসেল আহমেদের অপেক্ষা আরো দীর্ঘ। তিনি শনিবার সকাল ৮টা থেকে টিকিটের জন্য লাইনে আছেন। ঈদের ছুটিতে পরিবার নিয়ে ঠাকুরগাঁও যাবেন৷ তাঁর পাঁচটি টিকিট দরকার। কিন্তু নির্ধারিত চারটিও পাবেন কি না তিনি নিশ্চিত নন। ৭ তারিখের টিকিট না পেয়ে ৮ তারিখের টিকিটের আশায় লাইনে দাঁড়ানো আছেন তিনি।

তার অভিযোগ, ‘‘অনলাইনে অনেক চেষ্টা করেও টিকিট কাটতে পারিনি৷ নির্ধারিত সময়ে সার্ভার বা অ্যাপে ঢুকা যায়না।’’

তার কথা, ‘‘তারপরও অর্ধেক টিকিট যদি কাউন্টারে দেয়া হয় তাহলে আমাদের রুটে কাউন্টারে ৬০০ টিকিট দেয়ার কথা প্রতিদিন৷ কিন্তু ৫০-৬০টি টিকিট দেয়ার পর শেষ হয়ে যায় কীভাবে?”

এই অভিযোগ প্রায় সবার। তাদের কথা, ‘‘অনলাইনে টিকিট পাচ্ছি না৷ কাউন্টারেও নাই। তাহলে টিকিট যাচ্ছে কোথায়?’’

কমলাপুর রেলস্টেশনের কাউন্টারে দিনে একবার টিকিট বিক্রি করা হয়। এসময় টিকিট সা পেলে আবার ২৪ ঘন্টার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অর্থাৎ পরেরদিনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

তাই যারা লাইনে দাঁড়ান তারা নিজেরাই সিরিয়াল নাম্বারের ব্যবস্থা করেন। সেই নাম্বার ধরে অপেক্ষার লাইন সামনে যেতে থাকে।

আর এই লাইনে জায়গা ধরে রাখার জন্য ভাড়ায় লোক পাওয়া যায়। ২৪ ঘন্টা লাইনে দাঁড়ানোর জন্য একজনকে দিতে হয় এক হাজার টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা৷ সঙ্গে খাওয়া দাওয়ার খরচ।

জান্নাতুল আরশী অবশ্য এটা বুঝতে পারেননি৷ আর তাই বিপাকে পড়েছেন তিনি।

তিনি শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় এসে লাইন দাঁড়ান৷ কিন্তু রবিবার সকালে টিকিট পাননি। তার সর্বশেষ সিরিয়াল ছিলো ৫০। এরপর সোমবার সকালে টিকিট পাবেন এই আশায় তিনি অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু রোববার দুপুরে ফ্রেস হওয়ার জন্য লাইন ছেড়ে বাইরে গেলে ফিরে এসে দেখেন তার সিরিয়ালটি অন্যরা দখল করে ফেলেছে৷ তিনি যাবেন গাইবন্ধা।

আরশী বলেন, ‘‘সারারাত লাইনে থেকে এখন আমি হতাশ। সোমবারও টিকিট পাব কি না জানি না। তবুও আবার লাইনের পিছনে দাঁড়িয়েছি। রোববার রাতেও স্টেশনেই থাকব।’’

১ জুলাই থেকে ট্রেনের আগাম টিকিট দেয়া শুরু হয়েছে, দেয়া হবে ৫ জুলাই পর্যন্ত। ১ তারিখে দেয়া হয়েছে ৫ তারিখের, ২ তারিখে ৬ তারিখের, ৩ তারিখে ৭ তারিখের, ৪ তারিখে ৮ তারিখের এবং ৫ তারিখে দেওয়া হচ্ছে ৯ তারিখের টিকিট।

বাংলাদেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে ১০ জুলাই।

টিকিটের শতকরা ৫০ ভাগ অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। অনলাইনে আবার অর্ধেক অ্যাপে এবং অর্ধেক ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে। একজন যাত্রী সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কিনতে পারছেন। টিকিটি কিনতে জন্ম নিবন্ধন সনদ অথবা জাতীয় পরিচয়পত্র লাগছে।

ঢাকায় মোট ৬টি জায়গা থেকে টিকিট দেয়া হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে ছয় জোড়া বাড়তি ট্রেন দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ট্রেন হলো ৪৪ জোড়া। তবে ছয় জোড়া বিশেষ ট্রেনের টিকিট অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না। কাউন্টার থেকেই দেয়া হচ্ছে।

প্রতিদিন অনলাইন ও কাউন্টার মিলিয়ে ২৮ হাজার টিকিট দেয়া হচ্ছে।

এর আগের ঈদে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকমকে দিয়ে এবারও কাউন্টার ও অনলাইন সব ধরনের টিকেট ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। গত ঈদ-উল-ফিতরের সময় সহজ ডটকমের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার মো. রেজাউল করিমকে টিকিট জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

তিনি অনলাইনের তিন হাজার টিকিট জালিয়াতির মাধ্যমে উচ্চ মূল্যে বিক্রির কথা স্বীকার করেন তখন। প্রতি ঈদেই সহজ ডটকমের সার্ভার ব্যবহার করে তিনি এই জালিয়াতি করে আসছিলেন বলে স্বীকার করেন।

তবে র‌্যাব তখন আরো অনেক বেশি টিকিট জালিয়াতির আলামত উদ্ধারের কথা বলেছিল।

তবে সহজ ডটকমের মুখপাত্র ফরহাদ আহমেদ দাবি করেন, ‘‘রেলের টিকিট নিয়ে কোনো দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনা হচ্ছে না। মানুষ বুঝতে ভুল করছে।’’

তার দাবি, ‘‘অনলাইনে প্রতিদিন সকাল ৮টায় টিকিটি দেয়া শুরুর দুই-এক মিনিটের মধ্যেই ওই দিনের টিকিট শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই অন্যরা পাচ্ছেন না। আর যাদের ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক দুর্বল তারা ঢুকতে পারছেন না। ভিড়ের মধ্যে বসে অনলাইনে যারা টিকিট কাটার চেষ্টা করেন তারাই পান না। কারণ তাদের নেটওয়ার্ক দুর্বল থাকে। কাউন্টারেও আমাদের ব্যবস্থাপনায় টিকিট দেয়া হয়। আমরা তো নির্ধারিত টিকিটের বেশি দিতে পারব না। যত টিকিট তার চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি। ফলে যারা টিকিট পান না তারা অভিযোগ করেন।’’

গত ঈদে সহজ ডটকমের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারকে টিকিট জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আসলে তিনি আমাদের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার নন। তিনি একজন স্টেশন সাপোর্ট স্টাফ। আমাদের সার্ভারে তার কোনো অ্যাকসেস ছিলো না। কোনো টিকিট জালিয়াতি হয়নি। র‌্যাব বিষয়টি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছিল। আমরা অভিযুক্তকে চাকরিচ্যুত করেছি।’’

তিনি জালিয়াতি না করে থাকলে তাকে চাকরিচ্যুত করেছেন কেন প্রশ্ন করলে সহজ ডটকমের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘১০ জন লোককে লাইনে বসিয়ে রাখলে একজন চারটি করে ৪০টি টিকিট পাওয়া যায়। তিনি হয়তো এভাবে কিছু করেছেন।’’

এদিকে কমলাপুর রেল স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার দাবি করেন, ‘‘যাত্রীরা যেসব অভিযোগ করছেন এখন পর্যন্ত তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আসল বিষয় হলো চাহিদার চেয়ে টিকিট অনেক কম।’’

গত ঈদে জালিয়াতির অভিযোগে সহজ ডটকমের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারকে আটকের পর এবারো তাদের কেন টিকিট ব্যবস্থাপনায় রাখা হলো জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘এটা রেল মন্ত্রণালয়ের বিষয়। তারাই ঠিক করেন।’’

আর সহজ ডটকম বলেছে, ‘‘প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা জড়িত নন। ওই কর্মচারীর বিরুদ্ধে যদি আদালতে অভিযোগ প্রমাণ হয় তাহলে সে শাস্তি পাবে।’’

এ বিষয়ে চেষ্টা করেও রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button