দিনাজপুরের পুঁথি
শহিদুল হাসান : বাংলাদেশে মধ্যযুগের পুঁথি সংগ্রহের প্রবাদপুরুষ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ একটি চিঠিতে আবদুল হক চৌধুরীকে লিখেছিলেন, ‘তেঁতুল দেখিলে যেমন জিহ্বায় জল আসে, পুঁথির নাম শুনিলেও আমার তাহা না দেখা পর্যন্ত সোয়াস্তি থাকে না।’ ১৯৪৪ সালে লেখা এ চিঠিতে প্রকাশিত আকুতি হয়তো ২০২২ সালের ই-মেইল, গুগল, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ফেসবুকে অভ্যস্ত বাঙালি গবেষক ও পাঠকের কাছে কিছুটা অপাঙেক্তয় মনে হতে পারে। তা সত্ত্বেও মহীরূহ আবদুল করিম, তদীয় শিষ্য আহমদ শরীফ, পরবর্তী প্রজন্মের আবদুল কাইয়ুম, রাজিয়া সুলতানা, শাহজাহান মিয়া প্রমুখ পুঁথি বিশেষজ্ঞদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশের পুঁথি সাহিত্য ও পুঁথি সংগ্রহশালার সংবাদ বিশ্বের গবেষক মহলে সুবিদিত। উনিশ শতকের শেষদিকে প্রাচ্যবিদ্যার বিভিন্ন শাখা আপন পরিচয়ে স্পষ্ট হতে থাকে। মুদ্রাতত্ত্ব, পুরালেখবিদ্যা কিংবা প্রত্নতত্ত্বের সঙ্গে সমপাল্লায় চলতে থাকে প্রাচ্যদেশীয় ভাষার নানা রকমের পুঁথি সংগ্রহ ও পাঠ।
বটতলার ছাপানো পুঁথির আগে তুলট কাগজ বা তালপাতায় হাতে লেখা মহামূল্যবান পুঁথি তৈরির রসম অতি প্রাচীন কাল থেকে বাংলা বা ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগে তা হয়েছে বহুল প্রচলিত এবং বৈচিত্র্যময় বিষয়ে। রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী, বৈদিক শাস্ত্রের ব্যাখ্যা, নীতিশাস্ত্র, ব্যাকরণ, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য অথবা পদাবলি রচিত হয়েছে নানা রকমফেরে নানা শিরোনামে অনুলিপি হয়েছে অসংখ্য। পাশাপাশি রয়েছে মুসলমানি পুঁথি। বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ভাষায় লিখিত পুঁথি বাংলাদেশের জনমানস, বুদ্ধিজীবিতা, সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য কিংবা আত্মপরিচয়ের শেকড়বাহী আকর সূত্র। বাংলাদেশের পুঁথির সবচেয়ে বৃহৎ সংগ্রহশালা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাণ্ডুলিপি শাখা। কিন্তু এটিই একমাত্র নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে রয়েছে পাবলিক লাইব্রেরি কিংবা প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহশালা। বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত দিনাজপুর জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রের মুন্সিপাড়ায় অবস্থিত হেমায়েত আলী পাবলিক লাইব্রেরিতে রয়েছে মধ্যপর্বে রচিত ও অনুলিপিকৃত বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার দুর্লভ কিছু পাণ্ডুলিপি। এই সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত পুঁথির বিষয় বৈচিত্র্য, সাহিত্য মূল্যায়ন কিংবা ইতিহাসের আকর সূত্র হিসেবে বিশ্লেষণ এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং সাদামাটা লেখনীতে সহজ কথায় কিছু রস সৃষ্টি করাই বর্তমান লেখকের একান্ত ইরাদা। সংরক্ষিত পুঁথিগুলোর কোনো ডিজিটাল ডাটাবেজ কিংবা ইনডেক্স না থাকায় মান্যবর পুঁথি গবেষক মণীন্দ্রনাথ সমাজদার ভট্টাচার্য্যের প্রস্তুতকৃত ‘গ্রন্থ বিবরণী’ এবং লেখকের স্বল্প গবেষণা অভিজ্ঞতাই প্রধান ভরসা। পুঁথিবিষয়ক পাণ্ডিত্য ছাড়া এ ধরনের লেখা কিছুটা আত্মহননের প্রক্রিয়া। আশা করি বিজ্ঞ পাঠক সমাজ তাদের সমজদার মেজাজে লেখকের সীমাবদ্ধতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
দিনাজপুরের এ পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয় সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে। ১৯৩১ সালে বিদ্যানুরাগী মোহাম্মদ হেমায়েত আলী নিজ গৃহে ‘মুসলিম মঙ্গল পাঠাগার’ নামে একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। পাকিস্তান আমলে এটির নাম বদলে ‘খাজা নাজিমুদ্দিন মুসলিম হল এবং লাইব্রেরি’ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে গ্রন্থাগারটির নাম রাখা হয় হেমায়েত আলী পাবলিক লাইব্রেরি।
লাইব্রেরির সংগ্রহে থাকা পাণ্ডুলিপিগুলোর অধিকাংশই সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায়। হাতে তৈরি কাগজ কিংবা তালপাতার ওপর কালো কালি দিয়ে লেখা। সংগ্রহের বেশিরভাগ পাণ্ডুলিপি খণ্ডিত; পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপির সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপিগুলো সংরক্ষেণের উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্ত্বাবধায়নে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ১৯৭৮ সালে পুঁথি বিশারদ মণীন্দ্রনাথ সমাজদার ভট্টাচার্য্য হেমায়েত আলী পাঠাগারে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপিগুলোর ক্যাটালগ তৈরি করেন এবং ‘গ্রন্থ বিবরণী’ শিরোনামে এর প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। প্রথম খণ্ডে তিনি ১৭টি বাংলা ও ৫০টি সংস্কৃত পুঁথির পরিচায়ন করেন। সম্পূর্ণ হাতে লেখা এ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে। মণীন্দ্রবাবুর পুঁথি সাধনা ও কর্ম-ধর্ম ধন্যবাদার্ঘ্য। কেননা পুঁথির ক্যাটালগটির প্রস্তুতি পর্বে তিনি স্বয়ং মধ্যযুগের অনুলিপিকারদের মতোই দুঃসাধ্য সাধন করেছেন। দ্বিতীয় খণ্ডে ১২৩টি পাণ্ডুলিপির—যার অধিকাংশই সংস্কৃত ভাষায় রচিত—পুঁথি পাঠকের জন্য তুলে এনেছেন। দুষ্প্রাপ্য পুঁথির মতোই এ গ্রন্থ বিবরণীর কপি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার এবং দিনাজপুরের হেমায়েত আলী পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে। হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির সঙ্গে এ ক্যাটালগের পার্থক্য হলো পুঁথিগুলো লেখা হয়েছিল হাতে তৈরি তুলট কাগজে। আর মনীন্দ্রবাবুর ক্যাটালগে ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক মেশিনে উৎপাদিত কাগজে; কম্পিউটার বা টাইপ রাইটারের ব্যবহার তাতে নেই।
মণীন্দ্রনাথ সমাজদারের সংকলনে উপস্থাপিত সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিটি হলো বিবাদ রত্নাকর, যা ১২৩৬ শকাব্দ বা ১৩১৪ খ্রিস্টাব্দে রচিত। এছাড়া মহাভারতের দ্রোণ পর্বের একটি অনুলিপি পুঁথির সময় ১৪১০ শকাব্দ বা ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দের। দুটি পুঁথিই সংস্কৃত ভাষায় রচিত। এছাড়া কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের একটি পুঁথির পুষ্পিকায় সময় দেয়া আছে বঙ্গাব্দ ও শকাব্দ উভয় রীতিতেই। তুলট কাগজের ওপর কালো কালিতে লেখা ২০২ টি ফোলিওর এ পাণ্ডুলিপিতে চণ্ডীমঙ্গল বিধৃত হয়েছে। হাতে তৈরি কাগজের পুঁথির বাইরে এ সংগ্রহশালায় তালপাতায় লেখা পুঁথি রয়েছে। আমাদের অনুমান, এ সংগ্রহশালায় বটতলার ছাপানো পুঁথির কোনো কপি নেই। এই সংগ্রহের অন্তিম পর্ব নির্দেশক উপাত্ত সম্ভবত উনিশ শতকের কিছু হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি।
দুই খণ্ডে বিভক্ত ক্যাটালগের প্রথমটিতে বাংলা ভাষায় রচিত পুঁথিগুলোকে নয়টি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা হয়েছে: (১) ওঝা ফকিরানি, (২) কৃষ্ণকীর্তন, (৩) গীতা, (৪) পদাবলি, (৫) পাঁচালি, (৬) পুরাণ, (৭) পৌরাণিক (৮) ফর্দ্দ ও (৯) বৈষ্ণব সাহিত্য। এ খণ্ডে নথিভুক্ত সংস্কৃত পুঁথিগুলো বর্গীকরণ করা হয়েছে ২৩টি প্রকরণে: (১) অভিধান, (২) কাব্য, (৩) ক্রিয়াকাণ্ড (৪), খণ্ড কাব্য, (৫) গীতি প্রশস্তি, (৬) জ্যোতিষ, (৭) তন্ত্র, (৮) দর্শনশাস্ত্র, (৯) নাট্যসাহিত্য, (১০) পুরাণ, (১১) পুরাণীয়, (১২) পৌরাণিক, (১৩) প্রাচীন মহাকাব্য, (১৪) মহাভারতীয়, (১৫) ভক্তিশাস্ত্র, (১৬) মহাকাব্য, (১৭) বৈষ্ণবতন্ত্র, (১৮) বৈষ্ণব সাহিত্য, (১৯) ব্যাকরণ, (২০) সংগীতশাস্ত্র, (২১) সাহিত্যতত্ত্ব, (২২) স্তব-স্তুতি ও (২৩) স্মৃতি ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় খণ্ডটিতে বাংলা পুঁথিকে ১৩টি এবং সংস্কৃত পুঁথিকে ৩০টি প্রকরণে বিন্যাস করা হয়েছে।
প্রথম খণ্ডের পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ বাংলা পুঁথি হলো তেলপড়ার মন্ত্র, শ্রীমদভগবদগীতা পদবন্ধ, গোবর্দ্ধন খেলা পাঁচালি, জগন্নাথ দাসের পদ ও প্রেমবিলাস।
এ সংগ্রহশালার অনেকগুলি পুঁথির বিষয় বৈচিত্র্য হয়তো বাংলার গবেষক মহলে পরিচিত। কিন্তু কয়েকটি পাণ্ডুলিপির গুরুত্ব স্থানীয় ইতিহাসের জন্য ভিন্ন মাত্রার। যেমন বাংলা ফর্দ্দমালা পাণ্ডুলিপিটি চারটি ফোলিওবিশিষ্ট এবং ফোলিওগুলো ভিন্ন ভিন্ন মাপের। এটি মূলত আনুক্রমিকভাবে নানাবিধ তৈজসপত্রের নাম ও কয়টি আছে তার তালিকা। পুঁথিটি ব্যক্তিগত সম্পত্তির তালিকা হতে পারে; আবার কোনো বিশেষ যজ্ঞ বা পূজার জন্য প্রয়োজনীয় তৈজসের তালিকাও হতে পারে। আমাদের অনুমানের কারণ হলো পুঁথির সঙ্গে যুক্ত অন্য পুঁথিটির নাম ওঝা ফকিরানি। তুলট কাগজে লেখা পুঁথিটির প্রায়োগিক গুরুত্ব সম্ভবত কোনো রোগবালাই বা বিপদ থেকে মুক্তির শ্লোক-মন্ত্র-জপ। লেখা মন্ত্রটি নিম্নরূপ—
শ্রী রাম: ওঁ সিদ্ধি: রাম লক্ষণ সীতা
ইহারদের আজ্ঞা রক্ত দোষ জল দোষ
ঘা ফোট পাচাড়ী চৌষট্টি মাত্র
তেলপড়া ক্ষে যা হউক সিদ্ধি
শিবের আজ্ঞা।
(পুঁথি নং ৩৩)
ওপরের পুঁথি দুটির যোগসূত্র কিংবা একত্রে ব্যবহার উপযোগিতা বিশ্লেষণ করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে এটি স্বীকার্য যে পুঁথি দুটি রাজধানী থেকে দূরে একেবারে প্রান্তসীমায় অবস্থিত দিনাজপুরের স্থানীয় ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকর সূত্র। প্রসঙ্গত উপস্থাপন করতে চাই বাংলা ভাষায় লিখিত হরিকান্ত সিংহের একটি পত্র। মণীন্দ্রনাথ সমাজদারের উপস্থাপিত দ্বিতীয় খণ্ডের ১৮৮ নং বাংলা চিঠিটির প্রাপক শ্রীনাথ পঞ্চানন ভট্টাচার্য্য। র্৬র্ –৩ ১/র্২র্ আয়তনের তুলট কাগজে প্যাঁচানো অক্ষরে কালো কালিতে হাতে লেখা আট লাইনের পত্রটি নিম্নরূপ—
‘শ্রী রাম!
সেবক শ্রী হরকান্ত সিংহ
সময়োচিত নিবেদন বিশেষ
তারিখ ১৫ ফাল্গুন রবিবার আমার…
ঁ ঠাকুরের ঁশ্রবণপূর্বক ঁপ্রাপ্তা হৈয়াছে
১৬ই চৈত্র মঙ্গলবার আদ্য শ্রাদ্ধ গৌরী পাশাবাটী
মোকামে হবে তদা বিধানার্থ নিবেদন কৃপা পূর্বক
আগমন করিয়া ক্রিয়া সম্পন্ন করিবেন। পত্রদ্বারা
নিমন্ত্রণ করিলাম—ইতি—৬ চৈত্র’
হেমায়েত আলী পাঠাগারে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপির বিষয় বিভাজন যেন অনেকটাই কান্তজির মন্দিরে উপস্থাপিত টেরাকোটা ফলকের ঘরানার। ১৬৭৪ শকাব্দে নির্মিত নবরত্ন মন্দিরটির বহিরঙ্গ সম্পূর্ণরূপে টেরাকোটা ফলকে সজ্জিত। টেরাকোটা ফলকের চিত্রিত দৃশ্যাবলির মধ্যে স্থান পেয়েছে রামায়ণ, মহাভারত অথবা সনাতনী দেব-দেবীদের কর্মকাণ্ডের চিত্র। রাম, রাবণ, যুধিষ্ঠীর, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, দুর্যোধন, কর্ণ, দ্রোণাচার্যসহ নানা পৌরাণিক চরিত্রের যুদ্ধ করার দৃশ্য যেমন এখানে রয়েছে তেমনি রয়েছে রাসলীলা বা রাধাকৃষ্ণের নৃত্যের পাশাপাশি গোপীর নাচ, গান, বাঁশি, বীণাসহ নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র বাজানোর দৃশ্য। পুঁথির অনেকগুলোই একইভাবে মহাভারতের বিভিন্ন পর্বের কাহিনীসংবলিত। পাশাপাশি এই সংগ্রহে রয়েছে রামায়ণ, মহাভারতস্য উক্তি সংক্ষেপ, পদ্মপুরাণ, চণ্ডীমঙ্গল, শ্রী চৈতন্য ভাগবত, পুরাণম, পদ্মপুরাণ, ব্রজবুলি পদাবলি, প্রেমবিলাস ইত্যাদি পাণ্ডুলিপি। নামে পৌরাণিক দেবতা ও বৈষ্ণব প্রেমের কাব্যিক উপস্থাপনা—দু ধরণের বিষয়বস্তুই দেখা যায়।
আজ পাঠক সমীপে আরেকটি পুঁথি নজরানা দিয়ে আলোচনার সমাপ্তি টানতে চাই। দ্বিতীয় খণ্ডে উপস্থাপিত ২৪০ নম্বর সংস্কৃত পুঁথিটির নাম বঙ্গে বর্গী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুঁথিটি তুলট কাগজের এবং মাত্র দুটি ফোলিওবিশিষ্ট। মোট ১৫টি শ্লোক লেখা। ইতিহাসের শিক্ষার্থীরা এটি জানেন যে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় এক দশক (এপ্রিল ১৭৪২-মে ১৭৫১) সময়ে মহারাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনী বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল আক্রমণ করেছিল। এ সৈন্যরা শহর-গ্রাম জ্বালিয়ে, ফসলি জমিন মাড়িয়ে, অত্যাচার-নির্যাতন, লুণ্ঠনের তাণ্ডবলীলায় সোনার বাংলার আক্রান্ত এলাকাগুলোকে পরিণত করেছিল জনশূন্য বিরান বসতিতে। মহারাষ্ট্রের এ সৈন্যরাই ‘বর্গী’ নামে পরিচিত। সমসাময়িক সাহিত্য, কাব্য ও কাহিনীতে বর্গীদের সৃষ্ট অত্যাচার ও ত্রাসের প্রতিফলন দেখা যায়। ভারতচন্দ্র রায়ের অন্নদামঙ্গল, বানেশ্বর বিদ্যালংকারের সংস্কৃতি কাব্য চিত্রচম্নুতে মহারাষ্ট্রীয় সৈনিকদের ভয়াবহতার খণ্ডচিত্র পাওয়া যায়। কিন্তু গঙ্গারাম দত্তের মহারাষ্ট্র পুরাণ সব বর্গীর জুলুম ও অত্যাচারের পূর্ণচিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
দিনাজপুরে সংরক্ষিত বঙ্গে বর্গী নামের সংস্কৃত পুঁথিটি সম্ভবত এ ধারার সাহিত্যের একটি দৃষ্টান্ত। মণীন্দ্রনাথের ভাষায় পুঁথিটি ‘বঙ্গে বর্গীর হামলায় বিপর্য্যয়ের অতি করুণ কাহিনীর সংক্ষেপ বর্ণনা’। পাণ্ডুলিপির দুটি ফোলিওর অত্যন্ত জীর্ণ অবস্থা এবং বেশ কিছু জায়গায় খণ্ডিত হওয়ার কারণে কোনো শ্লোকই সম্পূর্ণ পাওয়া যায়নি। মণীন্দ্রনাথ ১৫টি শ্লোকের সম্ভাব্য পাঠ প্রস্তাবনা করে মন্তব্য করেন—শক্তিশালী কবির মাত্র গুটি ১৫ শ্লোকে বর্গির অত্যাচারে এবং কোনো স্থানের সামন্ত শাসকের নির্যাতনে বাংলার যে নিদারুণ দুরবস্থা হয়েছিল তা অতিসুন্দরভাবেই পরস্ফুিট হয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় ছোট ছোট রাজা-মহারাজার উপাধিধারী শাসক গোষ্ঠীর কাপুরুষতাও অতি সুন্দরভাবে ধরা পড়ে। ‘…ইহাতে যেখানে যতটুকু বোঝা যায় তা’দ্বারাই বর্গীর সামগ্রিক অত্যাচার, স্থানীয় রাজরাজড়াদের কাপুরুষোচিত পলায়ন, প্রজাসাধারণের স্বকীয় প্রচেষ্টায় নিঃশেষে বর্গীদের ধ্বংস, পলায়নপরায়ণ বর্গীর বিচ্ছিন্ন সেনাগণের জনসাধারণ কর্তৃক অশেষ লাঞ্ছনা, বঙ্গের প্রতিটি মানুষ তথা বনের গাছপালা পর্যন্ত বর্গীদের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের যথেষ্ট উপাদান আছে।’
ইহার ঐতিহাসিক পটভূমিকা মূল্যবান। উদ্ধৃতাংশের শেষ বক্তব্যের সূত্র ধরে আমরাও বলতে চাই দিনাজপুরের সংরক্ষিত পুঁথিগুলোর পটভূমিকা অত্যন্ত মূল্যবান। সমাজ গবেষক, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাবিদ কিংবা ইতিহাসবিদ—সবার কাছেই আকরসূত্র। আত্মপরিচয় নির্মাণ, জাতি রাষ্ট্রের গভীরে থাকা শেকড় অনুসন্ধান, ভাষার বিবর্তন, বাংলার মানুষের ভাবনার সফরনামা কিংবা লিঙ্গ ইতিহাসের অলিগলিবিষয়ক গবেষণার মূল্যবান উৎস এ পুঁথি ভাণ্ডার। সাধারণ পাঠকের পাঠাভ্যাস কিংবা আলসে দুপুরের খোরাক হিসেবে এগুলোর জুড়ি মেলা ভার। প্রয়োজন কেবল গবেষণা, সম্পাদনা ও পাঠকের দরবারে পৌঁছানো।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. শ্রী মনীন্দ্রনাথ সমাজদার ভট্টাচার্য্য, গ্রন্থবিবরণী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে মাইক্রো ফিল্মভুক্ত দিনাজপুরের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, খণ্ড ১ ও ২, ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ১৯৭৮ ও ১৯৮০।
২. গৌতম ভদ্র, মুনশী আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও আত্মসত্তার রাজনীতি, ঢাকা: সংহতি, ২০০৭।
৩. গৌতম ভদ্র, ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার, কলকাতা, ছাতিম বুকস ২০১১।
৪. মোহাম্মদ আব্দুল কাইউম, পাণ্ডুলিপি পাঠ ও পাঠ সমালোচনা, ঢাকা: গতিধারা ২০১৪।
৫. সৈয়দা পারভীন সুলতানা, শাহীন সুলতান এবং সৈয়দ আলী আকবর সম্পাদিত, পাণ্ডুলিপি পরিচয়, ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, ২০০৬।
৬. শাহজাহান মিয়া, বাংলা পাণ্ডুলিপি পাঠ সমীক্ষা, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪।
৭. এসএম লুত্ফার রাহমান, বাঙলা লিপির উৎস ও বিকাশের অজানা ইতিহাস, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০০৫।
লেখক : শহিদুল হাসান, সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।