তাজউদ্দীন ও জোহরার জীবনে এপ্রিল
শারমিন আহমদ : বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন (লিলি) ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অন্যন্য জুটি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে রুখে দেশমুক্তির জন্য একজন ধরেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের হাল, অন্যজন বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর ধরেছিলেন আওয়ামী লীগ দলের হাল। দেশ ও দলের চরম সংকটকালে তাদের ওপর যখন নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়, তারা সেই সময় দেশ, জাতি ও দলকে উজ্জীবিত করেছিলেন আশার আলো ও প্রেরণার বাতিঘর হয়ে। এ কারণেই, তাদের না জানলে বাংলাদেশের জন্ম এবং রাজনৈতিক ইতিহাসকে সঠিকভাবে জানা ও বিশ্লেষণ করা সম্ভবপর নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পুনঃজাগরণে এবং বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ ও জোহরা তাজউদ্দীনের ব্যক্তিগত জীবনেও এই এপ্রিল এক গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসেই সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন; মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য আদায় করেছিলেন অস্ত্র, রসদ, ট্রেনিং, খাদ্য ও কূটনৈতিক সহযোগিতা; গঠন করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার; প্রথম মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে আবির্ভূত হয়েছিল এক নতুন বাংলাদেশ; সেক্টর কমান্ডারদের নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধরত সামরিক ও বেসামরিক দলগুলোকে একটি রাজনৈতিক স্বাধীন সরকারের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করেছিলেন বঙ্গতাজ। জাতির মুক্তির দিকনির্ধারক এই সবই ঘটেছিল এপ্রিল মাসেই।
যে দূরদর্শী মানুষটির নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধে সফলতা লাভ করেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের সেই কাণ্ডারি বঙ্গতাজের ভাগ্যে বিজয়-উত্তর বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ খুব বেশি আসেনি। যে সব প্রবল বাধা ও ষড়যন্ত্রকে তিনি প্রতিহত করে দেশকে মুক্ত করেছিলেন সেই ষড়যন্ত্রকারীরা এবার আঘাত হানে ভেতর থেকে। তার সব সতর্কবাণী ও উপদেশ বৃথা যায়। ঘটে যায় মহাবিপর্যয়। পরিবারসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন নিজ বাসগৃহে। মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি তাজউদ্দীন আহমদ ও তার তিন সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে কারাগারে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ নেতৃত্বের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জাতির জীবনে যে শূন্যতা নেমে এসেছিল তখন আবারও আসে এক এপ্রিল মাস। চরম সে শূন্যতায় ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে, এক ঘরোয়া বৈঠকে, সর্বসম্মতিক্রমে জোহরা তাজউদ্দীনের ওপর অর্পিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। একজন সচেতন সমাজকর্মী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জোহরা আওয়ামী লীগের আহ্বায়িকারূপে, বাকশাল-উত্তর এই দলটিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। সে সময় জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকাল। একাত্তরের গণহত্যাকারী পরাজিত দলগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। বাইরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাকর্মীদের অনেকেই জেলে অথবা পলাতক। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতা হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ। দলের এই চরম দুর্দিনে, সামরিক শাসক আরোপিত প্রবল বাধানিষেধ ও হুমকির মধ্যেও জোহরা, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সে সময়ের রাস্তাঘাট-বিদ্যুৎবিহীন দুর্গম এলাকাগুলো ভ্রমণ করে আওয়ামী লীগে প্রাণসঞ্চার করেন। নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন। প্রচণ্ড সাহসী এই নারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং নিজ দলে শান্তি ও ঐক্য বজায় রাখতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হওয়া আবশ্যক। মনীষীরা বলেন, ‘একজন মানুষকে তার ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্রের মধ্য দিয়েই সত্যিকারভাবে জানা যায়।’ ঘরে-বাইরে উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিয়েছেন সেই প্রতারক রাজনীতিবিদকে যিনি বাইরে স্বদেশি করেন, খাদি পরেন আর তার পকেটে লুকায়িত থাকে বিলেতি সিগারেট। এই ধরনের নেতারাই দুর্যোগকালে পিছুটান দেন ও ক্ষমতাপ্রাপ্তির জন্য অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেন। একজন রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব হলো তার ব্যক্তি চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। সে জন্যই তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সুযোগ্যা স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীনকে শুধুমাত্র তাদের রাজনৈতিক অবদান দিয়ে মূল্যায়ন করা যাবে না। তারা রাজনীতির অশুদ্ধ স্রোতের মাঝেও যে সততা, ত্যাগ ও নীতি-আদর্শের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল তাদের ব্যক্তিগত জীবনচর্যাতেই।
তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা খাতুন লিলির প্রথম দেখাও হয়েছিল এক এপ্রিল মাসেই। ১৯৫৯ সালের ১৪ এপ্রিল, বাংলা নববর্ষে। পুরান ঢাকার বংশালে, তাদের কমন বন্ধু ইসলাম সাহেব ও তার স্ত্রী অনুর মাধ্যমে। তারাই এই বিয়ের ঘটকালি করেন। সাদা সুতির শাড়ি পরিহিতা লিলি যখন গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকেন তখন হাওয়াই শার্ট পরিহিত ৩৩ বছর বয়স্ক তাজউদ্দীন বাইরের উঠানে বসে তার প্রিয় গুঁড়ামাছের চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খাচ্ছিলেন। তাজউদ্দীন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি এমন নারীকে বিয়ে করবেন যিনি ত্যাগ করতে পারেন এবং যিনি দুঃখকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। লিলির জীবনে ত্যাগের অন্ত ছিল না দুঃখকেও উপলব্ধি করেছেন নিবিড়ভাবে। সে আরেক দীর্ঘ কাহিনী। সেদিনের আলাপের পর লিলি বলেছিলেন যে, তিনি সোনার গহনা পছন্দ করেন না। তিনি বেলী ফুল ভালোবাসেন, সেই ফুল দিয়েই তার বিয়ে হোক, এই তার ইচ্ছা। ১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল, রোববার, তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা খাতুন লিলির বিয়ে হয় কনের বাবা প্রফেসর সৈয়দ সেরাজুল হকের মগবাজারের বাড়িতে। সময় রাত ৪টা। লিলির ইচ্ছা অনুসারে বিয়েতে তাজউদ্দীন তাকে একরাশ বেলীফুলের গহনা দিয়ে বরণ করেন। এই সহজ-সরল, নির্লোভ ও মহৎ আদর্শের ভিত্তির ওপর তাদের যে দাম্পত্য জীবন শুরু হয়েছিল তা কালের নানা চড়াই-উৎরাইয়ের পরশমণির ছোঁয়ায় পূর্ণতা লাভ করে। দেশমুক্তির পণ নিয়ে দুর্গমপথে যাত্রার সময়, একটি চিরকুটে তাজউদ্দীন তার স্ত্রীকে লিখেছিলেন, ‘লিলি আমি চলে গেলাম। যাওয়ার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানি না… মুক্তির পর। ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে যেও। দোলনচাঁপা।’ বঙ্গতাজের ছদ্মনাম। স্বামীর বার্তাটি পড়ে তার কী অনুভূতি হয়েছিল সে বিষয়ে জোহরা তাজউদ্দীন লেখেন, ‘কতক্ষণ যে কাগজখানা নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম জানি না। সেদিনের সেই মুহূর্তে এ কথা কয়টি কথার কথাই ছিল না। জীবনের পরবর্তী অধ্যায় শুরু করার জন্য সেই লেখাগুলো ছিল পবিত্র প্রেরণর উৎস। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে নিজেকে নতুনভাবে নতুনরূপে আবিষ্কার করেছিলাম সেদিন।’
পাকিস্তান মিলিটারির তাড়া খেয়ে, নাবালক চার ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর ঘুরে মে মাসের শেষে বিধ্বস্ত জোহরা তাজউদ্দীন যখন ভারতে গেলেন, তখন গভীর রাতে কয়েক মিনিটের জন্য দেখা হলো স্বামীর সঙ্গে। কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হোসেন আলীর গৃহে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ জোহরাকে তাজউদ্দীন জানালেন যে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন দেশ যতদিন স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে মুক্তি না লাভ করবে, তিনি ততদিন পারিবারিক জীবনযাপন করবেন না। যুদ্ধাবস্থায় মুক্তিসেনারা যদি পরিবার ছেড়ে রণাঙ্গনে যেতে পারে তিনি তাদের প্রধানমন্ত্রী হয়ে কেন পারবেন না। তাজউদ্দীনের কথা শুনে জোহরা তাজউদ্দীন তার মনের অনুভূতি (এই লেখকের কাছে সাক্ষাৎকার, ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯৩) ব্যক্ত করেছিলেন, ‘সেই মুহূর্তগুলোতে এমন গৌরবমণ্ডিত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে আমি প্রাণভরে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে নয়, দারুণ শিহরণ জাগানো ঐকমত্য পোষণ করেছিলাম উদ্ভাসিত গভীর দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে। তিনি বুঝেছিলেন। তারপর তিনি চলে গেলেন। সেই সময়কার ঐ মহান সিদ্ধান্ত হাজার বছরের যেন এক অমূল্য উপাদান। চলন্ত জীবনের কত ঐতিহাসিক ঘটনার উত্থান-পতনের সঙ্গে বারবার তাকে আবিষ্কার করেছি, ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর পরিসরে। এ যে কত বড় অমূল্য সাধনার প্রাপ্তি!’ ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও দশকে ভালোবাসার কী অমূল্য আদর্শ রেখে গেলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আর জোহরা তাজউদ্দীন কত নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে একাত্ম করে দিলেন তার জীবনসাথীর মহৎ সংগ্রামের অনুচ্চারিত প্রেরণা হয়ে। ২৬ এপ্রিল, ২০১৯ তাদের ষাটতম বিয়েবার্ষিকীতে প্রার্থনা করি তাদের মতো আলোকিত আরও নতুন মানুষের।
লেখক : তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের জ্যেষ্ঠকন্যা