গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : আইএস-এর পতনের পর এখন নতুন আতঙ্ক ‘ফরেন টেরোরিস্ট ফাইটার’ বা এফটিএফ৷ শ্রীলঙ্কায় হামলা সেই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশেও বিদেশি দূতাবাস ও পাঁচতারা হোটেলে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব যথেষ্ট কিনা?
এফটিএফ ফাইটাররা আইএস-এর বিদেশি যোদ্ধা নামেও পরিচিত৷ সময় যত যাচ্ছে, ততই নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কার হামলার সাথে বাংলাদেশের হোলি আর্টিজান হামলার কিছু মিল রয়েছে। বাংলাদেশে হোলি আর্টিজান হামলারও দায় স্বীকার করেছিল আইএস। হামলার পর আইএস তাদের নিজস্ব চ্যানেলে হামলায় জড়িতদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করে। বাংলাদেশের মতো শ্রীলঙ্কার হামলায় জড়িতরাও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং ‘আধুনিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত। হোলি আর্টিজান হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র, কিন্তু শ্রীলঙ্কায় ব্যবহৃত হয়েছে বোমা। বালাদেশে হামলার সময় সিরিয়ায় আইএস-এর খেলাফত ছিল। এখন আর নেই।
কিন্তু এখন যেটা বড় আতঙ্কের হলো, আইএস-এর ফরেন টেরোরিস্ট ফাইটাররা ছড়িয়ে পড়েছে। তারা যার যার দেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। চেষ্টা করছে নতুন হামলার মধ্য দিয়ে তাদের অস্তিত্বের জানান দিতে। তাদের সঙ্গে আছে ‘হোমগ্রোন’ জঙ্গি, যাদের বড় একটি অংশ আইএস-এর অনুসারী। তাই সারাবিশ্বেই এনিয়ে আছে উদ্বেগ আর সতর্কতা। বাংলাদেশও আছে সতর্ক অবস্থানে।
শ্রীলঙ্কার হামলার ঘটনার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার সংসদে এই ধরনের হামলার ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশে এ ধরনের বোমা হামলা, জঙ্গি হামলা আমরা কঠোর হাতে দমন করেছি। আমি দেশবাসীকে বলব সতর্ক থাকতে। কোথাও যদি অস্বাভাবিক কিছু পায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে যেন তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানায়।”
বৃহস্পতিবার আরেক অনুষ্ঠানে তিনি একইভাবে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘বাংলাদেশেও এধরনের ঘটনা ঘটানোর অনেক চেষ্টা চলছে। তবে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে যাচ্ছে। আমি দেশবাসীকে আহ্বান জানাব, এ ধরনের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত থাকবে, কে কোথায় জঙ্গিবাদী-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত, সেটা শুধু গোয়েন্দা সংস্থাই না, আমাদের দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে এবং খুঁজে বের করতে হবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হবে।”
সতর্ক ব্যবস্থা
গোয়েন্দাসূত্র জানায়, সিরিয়ায় আইএস-এর পতনের আগে থেকেই বাংলাদেশ সতর্ক ছিল। সেই সতর্কতা এখন আরো বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যারা সিরিয়া বা অন্য কোনো দেশে গিয়ে আইএস-এ যোগ দিয়েছে তারা যাতে দেশের ভেতরে ঢুকতে না পারে সেজন্য বিমানবন্দরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তাদের একটি তালিকাও পাঠানো হয়েছে বন্দরগুলোতে।
সূত্র জানায়, ৪০ জনের একটি তালিকা বিমানবন্দরসহ সীমান্ত এলাকার বন্দরগুলোতে পাঠানো হয়েছে। তথ্য সংগ্রহ এবং নজরদারির জন্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকেও ওই তালিকা দেয়া হয়েছে।
তবে তারা সবাই যে সরাসরি বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে তা নয়। একটি অংশ অন্যদেশ থেকেও গিয়েছে। তারা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। সরাসরি বাংলাদেশ থেকে গেছে এমন সংখ্যা ৩০-৩৫ জন হবে।
জাতিসংঘের হিসেবে আইএস-এর হয়ে যুদ্ধ করতে ১১০ দেশ থেকে ৪০ হাজারেরও বেশি যোদ্ধা সিরিয়া এবং ইরাক গিয়েছে। এরমধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে ৮০০, মালয়েশিয়া থেকে ১৫৪, ফিলিপাইন থেকে ১০০ এবং বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে ৪০ জন।
সিরিয়া গিয়ে যুদ্ধে তাজউদ্দিন নামে একজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। তার বাংলাদেশ ও ফিনল্যান্ড দুই দেশেরই পাসপোর্ট ছিল। সে ফিনল্যান্ড থেকে সিরিয়ায় গিয়েছিলেন।
কাজী সোহান নামে একজন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৫ সালে তিনি ফিরে আসেন। এছাড়া আরো যারা সেখানে গিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জাপানি নাগরিক ওজাকি, জুন্নুন শিকদার, দুই ভাই ইব্রাহিম শিকদার ও জোনায়েদ শিকদার, ডা. আরাফাত, তাজউদ্দিন।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শামীমা বেগম লন্ডন থেকে ২০১৫ সালে সিরিয়া গিয়ে আইএস যোদ্ধাকে বিয়ে করেন এবং এখন ব্রিটেনে ফিরতে চেয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছেন। তার প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘সে কখনোই বাংলাদেশে ছিলনা। সে বাংলাদেশের নাগরিক না।”
‘আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান হামলার পর বাংলাদেশে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কার্যকর অভিযান পরিচালনা করা হয়। তারপরও আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই যে তারা শেষ হয়ে গেছে৷ তাদের কিছু এখনো বাইরে আছে। তারা যাতে নতুন করে সংগঠিত হতে না পারে সেজন্য আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে৷ আর বাইরে যেসব জঙ্গি এখনো আছে তাদেরও আটকের জন্য ধারাবাহিক তৎপরতা চলছে।”
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে যারা সিরিয়া গিয়েছেন তারা ২০১৪ সালের আগে গিয়েছেন। তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছেন তাদের পাসপোর্টের মেয়াদ এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তাই তাদের দেশে ফিরতে হলে ট্রাভেল ডকুমেন্ট লাগবে। সেটা যাতে তারা না করতে পারে সেজন্য দূতাবাসগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। তারপরও তারা কোনোভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।”
‘আগাম আরো সতর্ক হতে হবে’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘‘বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির উপর সতর্ক নজর রাখতে হবে৷ ওখানে যদি কোনোভাবে ধর্মীয় সংঘাত, বিশেষ করে মুসলামানদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা হয় তাহলে তার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে পড়তে পারে। সেই প্রতিক্রিয়া যাতে না হয় তার জন্য বাংলাদেশকে আগাম আরো সতর্ক হতে হবে।”
তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী এরইমধ্যে দেশের মানুষকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। আমার মনে হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও যথেষ্ট সতর্ক আছে। তবে বাইরে থেকে জঙ্গিরা যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ না করতে পারে সেটা কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। এখন থেকে যারা সিরিয়া গেছে তাদের সবাই হয়ত নেই। কিন্তু যারা আছে তারা ঢোকার চেষ্টা করতে পারে৷ তারা ছাড়াও বাইরের জঙ্গিরাও আসতে পারে৷ এজন্য এয়ারপোর্ট, বর্ডারে বিজিবিকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখতে হবে৷ বাংলাদেশ থেকে যারা গেছে তাদের পক্ষে হয়তো এখন পাসপোর্ট করা কঠিন হবে৷ তাই তারা বিকল্প কোনো উপায়ে ঢুকতে চাইতে পারে। তাই স্থল সীমান্তে কড়া নজরদারি রাখতে হবে।”
সূত্র: ডয়চে ভেলে