ঔপনিবেশিক নগরায়ণের গল্প
দেবযানী মোদক : হিমালয়কন্যা দার্জিলিং। একে ঘিরে সমতলের বাঙালির আবেগ-আগ্রহ দুই-ই অসামান্য! বাংলা ভাষায় লেখা ভ্রমণ সাহিত্য থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরীর রোমাঞ্চ উপন্যাস, গল্প ও সিনেমায় ঘুরেফিরে বারবার এসেছে দার্জিলিং। গান-কবিতায়ও উপস্থিতির জানান দিয়ে এসেছে এই হিল স্টেশন। তবে ইতিহাস বলে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত এ জেলা নিয়ে আগ্রহ কেবল বাঙালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়! এ আগ্রহ কেবল প্রাকৃতিক নৈসর্গ আর একে ঘিরে রোমান্টিসিজমের মধ্যেই আবদ্ধ নয়।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট উচ্চতা থেকে দেখা আকাশে তুলার মতো ভেসে যাওয়া মেঘ, কখনোবা ভারি কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারপাশ, পথের দুই পাশে সুবিশাল পাইন গাছের সাড়ি, এঁকেবেঁকে বয়ে চলা তিস্তা, পাহাড়ি মানুষের জনবসতি—এসব মিলিয়ে আজকের দার্জিলিং। এছাড়া আছে ভুবন বিখ্যাত চা বাগানগুলো। এ অঞ্চলে চায়ের যে স্বাদ, তা পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলেই পাওয়া সম্ভব নয়। দার্জিলিংয়ের অনন্যতা আজ আকৃষ্ট করে পৃথিবীর নানা প্রান্তের পর্যটকদের।
তবে প্রকৃতির এ নিসর্গের পাশাপাশি দার্জিলিংয়ের অন্য যে ব্যাপারটি চোখ এড়িয়ে যায় না, সেটি হলো এর পথের বাঁকে বাঁকে ঔপনিবেশিক নগরায়ণের ছাপ। পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের পদচারণায় আজকের জনবহুল দার্জিলিং চিরকালই এমনটা ছিল না। বিশ্বায়নের স্রোতে একবার তরী ভাসালে আর হয়তো পেছনে ফেরার পথ নেই, তবে পেছনের গল্পটা তো শুনে নেয়াই যায়!
আজ আমরা যাকে দার্জিলিং হিসেবে চিনি, তা একসময় ছিল কেবলই রহস্যে ঘেরা পাহাড়ের সারি, নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা জনবিরল একটি অঞ্চল। এত মানুষের আনাগোনা এ অঞ্চলে ছিল না। ছিল না কোনো চা বাগান, ব্যবসা-বাণিজ্য বা পর্যটন। বলতেই হয়, দার্জিলিং শহরটির আজকের চেহারা গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশদের হাতে। সেটা তারা করেছিল নিজেদের স্বার্থে।
ঔপনিবেশিক ইউরোপীয়দের কাছে উপমহাদেশের গ্রীষ্মকালটা ছিল অনেকটা দুর্বিষহ। এ অবস্থা থেকে নিস্তার লাভের জন্যই সিকিমের রাজার কাছ থেকে কিছু পতিত পাহাড়ি অঞ্চল অধিগ্রহণ করে ব্রিটিশেরা। উদ্দেশ্য স্যানাটোরিয়াম বা স্বাস্থ্য উদ্ধারকেন্দ্র, স্বাস্থ্যনিবাস প্রতিষ্ঠা করা। প্রথমে অঞ্চলটির নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও আবহাওয়া ইংরেজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক কারণেও অঞ্চলটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ইংরেজরা দার্জিলিং অধিগ্রহণের আগে অঞ্চলটির অধিকার দাবি করতেন সিকিমের রাজা। তবে নেপালের গোর্খাদেরও দাবি ছিল এর ওপর। শুরুতে ইংরেজরা সিকিমের রাজার হয়ে গোর্খাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অঞ্চলটির অধিগ্রহণের মাধ্যমে তারা নিজেরাই এখানে আধিপত্য বিস্তার করে।
১৮৩৫ সালে দার্জিলিং অধিগ্রহণ করেছিল ইংরেজরা। স্বাস্থ্যনিবাস তৈরির জন্য জায়গাটির দখল নেয়া হলেও ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই চাষাবাদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়ে যায় পুরোদমে। যদিও ইউরোপের স্বাস্থ্য উদ্ধারকেন্দ্রগুলোয় তারা এমন বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করত না।
দার্জিলিংয়ের বন-জঙ্গল হয়ে উঠল ইংরেজের অ্যাডভেঞ্চারের জায়গা। নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন শুরু হলো। ঔপনিবেশিক বিনোদনের যা যা বৈশিষ্ট্য তার সবই ধীরে ধীরে দেখা দিতে শুরু করল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে চা জোগানের জন্য চীনের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে বিকল্প স্থান খুঁজছিল ব্রিটিশরা। তাদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার অংশ হিসেবেই উন্মোচিত হলো চায়ের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। দার্জিলিংয়ে কিছু চা গাছ রোপণ করে ব্রিটিশরা লক্ষ করে, এ অঞ্চলের চায়ের স্বাদ পৃথিবীর অন্য যেকোনো অঞ্চলের থেকেই আলাদা। এ যেন অনন্য সাধারণ! তারপর স্থানীয় বাসিন্দাদের শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা গড়ে তুলতে থাকে চা বাগান। ১৮৫৬ সালের দিকে চা উৎপাদন শুরু হয়ে যায় এ অঞ্চলে। চা চাষের সাফল্য দার্জিলিংকে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র করে তুলল। স্বাস্থ্য উদ্ধারকেন্দ্রের ধারণাটি আড়াল হতে শুরু করে। চা বাগান, প্লান্টারদের আবাস তৈরি করতে গিয়ে বদলাতে থাকে দার্জিলিংয়ের ল্যান্ডস্কেপ।
সে সময় বাড়তে থাকে অঞ্চলটির জনসংখ্যা। তবে দার্জিলিং তখনো খুব একটা সুগম হয়ে ওঠেনি। শিলিগুড়ির সমতল থেকে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে যাত্রা করার মানে হাতে অনেক দিন আর পিঠে রাজ্যের লটবহর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। তবে ১৮৩৯-৪২ সালের মধ্যে সেখানে তৈরি হলো সমতলের সঙ্গে সংযোগকারী প্রথম সড়কপথ।
এসবের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রসার ঘটল দার্জিলিংয়ে। বসতি স্থাপন করতে শুরু করে ব্রিটিশ চা প্রস্তুতকারীরা। ১৮৬৪ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সের গ্রীষ্মকালীন রাজধানীরূপে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় এ শহরকে। ততদিনে অঞ্চলটিতে শুরু হয়ে গিয়েছে অভিজাত ইউরোপীয়দের নতুন অধ্যায়। তাদের সন্তানদের জন্য গড়ে উঠতে শুরু করেছে বিদ্যালয়। হিল স্টেশনে আসতে শুরু করেছে পুঁজি, বড় মুনাফার হাতছানি। একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অন্যদিকে বস্তুগত মুনাফা—চিরকালীন দ্বন্দ্বটি দার্জিলিংয়ের নগরায়ণে স্পষ্টভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল।
১৮৮১ সালে চালু হয় প্রায় ৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ দুই ফুট গেজের বিখ্যাত টয় ট্রেন। এসবের ফলে যাতায়াত ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলে এ অঞ্চলের চাও পৌঁছে যেতে শুরু করে দার্জিলিংয়ের সীমানার বাইরে।
সব মিলিয়ে দার্জিলিং আর কেবল একটি স্বাস্থ্য উদ্ধারকেন্দ্র রইল না। একসময় এখানে অস্ত্রাগারও তৈরি করে ব্রিটিশরা।
উপনিবেশ তৈরি করে ব্রিটিশদের নগরায়ণের হাত ধরে স্বভাবতই যে বিষয়টি চলে এল, সেটি হলো শ্রেণীবৈষম্য। শুরুতে ইউরোপীয়, পরবর্তী সময়ে অভিজাত ভারতীয়দের বসবাস বাড়তে থাকল দার্জিলিংয়ে। স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের জীবনযাত্রায় ছিল বিস্তর ফারাক। গল্প-সাহিত্যে আমরা দার্জিলিং ও সেখানকার স্থানীয়দের যেভাবে চিনে এসেছি, সে পরিচয় ঔপনিবেশিক সাহেবদের চশমার কতটা ঊর্ধ্বে ছিল, তা যাচাইয়ের দাবি রাখে।
পরবর্তী সময়ে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দার্জিলিং অঞ্চলের চা বাগানগুলোয় অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এ জেলার চা শ্রমিকদের সংগঠিত করে কমিউনিস্টরা ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর দার্জিলিং জেলাকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দার্জিলিং পার করেছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের নানা মোড়। হিমালয়ের কোলঘেঁষা সবুজ অরণ্যে ঘেরা নিসর্গের পরতে পরতে যুক্ত হয়েছে কতই না অনুচ্চারিত গল্প। সেসব জানতে হলে পর্যটকের চোখ দিয়ে দার্জিলিংকে দেখলে চলবে না।