পরিবেশ আইন না মেনে রূপায়নের ‘পুকুর চুরি
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা আমলে না নিয়েই রাজধানীর রায়েরবাজারের পটারি পুকুরটি মাটি দিয়ে ভরাট করে বহুতল ভবন ‘রূপায়ন প্যারাডাইস’ নির্মাণে হাত দিয়েছে রূপায়ন গ্রুপের একটি আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান।
২০১৭ সালের মার্চে পুকুর ভরাটের অভিযোগে রূপায়ন গ্রুপকে আর্থিক জরিমানা করে পটারি পুকুরটিতে ভরাট করা মাটি-বালি সরিয়ে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর।
দুই বছর পেরিয়ে গেলেও ওই নির্দেশনার বাস্তবায়ন করেনি রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেড।
সম্প্রতি বনানীর যে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল, ওই ভবনটিও নির্মাণ করেছিল রূপায়ন হাউজিং। ওই ভবন নির্মাণে নানা অনিয়মের বিষয়গুলো বেরিয়ে আসে অগ্নিকাণ্ডের পর।
বৃহস্পতিবার পটারি পুকুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ওই জায়গার সামনে টিনের সীমানা প্রাচীর তুলে দেওয়া হয়েছে। সামনের ফটকের কাছে পাহারা দিচ্ছেন নিরাপত্তাকর্মীরা। রূপায়ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না তারা।
পুকুর ভরাটের বিষয়টি সবার চোখের সামনেই হয়েছে বলে জানান স্থানীয় কয়েকজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, পুকুরটি আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়নি।
এ নিয়ে কথা বলতে রূপায়ন এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পাটোয়ারি জহির উল্লাহর মোবাইলে পর পর দুই দিন কয়েক দফা ফোন করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এসএমএস পাঠিয়েও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
পুকুরটি পুনরুদ্ধার হয়েছে কি না, তা দেখতে গত দুই বছরেও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও কেউ আসেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বিষয়টি নজরে আনলে ‘খুব ভালো একটি বিষয় মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে’ উল্লেখ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সুলতান আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে এনফোর্সমেন্ট বিভাগকে নির্দেশ দেবেন তিনি।
এতদিন পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য নিজের সংস্থার জনবলের অভাবের কারণ দেখান তিনি।
“আসলে ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় কাজ করা যায় না। নানারকম মামলা মোকদ্দমা আছে…। আমাদের এখানে যে জনবল, ফ্যাসিলিটি এগুলো স্বাভাবিকভাবেই খুবই অপ্রতুল। কিন্তু এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, “এই পুকুরের মাটি আমরা সরাব না। যারা ভরাট করেছে তাদেরই সেটা করতে হবে।”
২০১৬ সালে রায়েরবাজারের শেরে বাংলা রোডের পটারি পুকুরটি ভরাট শুরু করে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট। তা পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরে এলে তা ভরাটে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
রূপায়নের পক্ষ থেকে ‘কথিত পটারি পুকুর’ বা ‘জরাজীর্ণ ডোবা’ উল্লেখ করে তা ভরাটের অনুমোদন চেয়ে ২০১৬ সালের ১০ মে পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করা হলে তাদের সে আবেদন আমলে নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর।
ওই বছরের ২৮ জুন রূপায়ন হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি জে উল্লাহকে একটি চিঠি পাঠায় পরিবেশ অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক সুকুমার বিশ্বাসের পাঠানো সেই চিঠিতে রূপায়ন হাউজিংকে সতর্ক করে বলা হয়, “পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শনে এটি একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যমান পুকুর হিসেবে দেখা গেছে। এ কারণে জাতীয় স্বার্থ ছাড়া এ পুকুর ভরাটের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার সুযোগ নেই।”
এ অবস্থায় ওই বছরই ৩০ জুনের মধ্যে পুকুরের ভরাট করা অংশ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে রূপায়ন হাউজিংকে নির্দেশ দেয় অধিদপ্তর।
নির্দেশনা না মানায় পরের বছরের ২৮ মার্চ রূপায়নকে ১৪ লাখ ৪৩ হাজর ৭০০ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
একই তারিখে ভরাটকৃত পটারি পুকুরের মাটি-বালি সরিয়ে আগের অবস্থায় আনার নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠি পাঠায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সেমেন্ট শাখা।
তাতে বলা হয়, অধিদপ্তরের ঢাকা মহানগর কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালের ১৭ মে এবং ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দুই দফা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
২১৫ শেরে বাংলা রোড রায়েরবাজারে অবস্থিত পটারি পুকুর ভরাট করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ কার্যক্রমে আপত্তি জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, “এর মাধ্যমে পুকুরের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জলজ জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করা হচ্ছে।”
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬(ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, “আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনো শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।”
এই ধারা উল্লেখ করে রূপায়নকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, “উল্লিখিত কার্যক্রমের মাধ্যমে আপনি বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত -২০১০) লঙ্ঘন করেছেন, যা দণ্ডনীয় অপরাধ এবং এর ক্ষতিপূরণ আপনার নিকট হতে আদায়যোগ্য।”
বাংলাদেশের জলাধার সংরক্ষণ আইনেও বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না বা উক্ত রূপ জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না বা ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না।