ইউপি নির্বাচন নাগরী: চাঁদা দাবি ও মাছ চুরির অভিযোগে তিন প্রার্থীরসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কালীগঞ্জে আসন্ন নাগরী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সাধারণ সদস্য পদে অংশ নেয়া ৩ প্রার্থী ও চেয়ারম্যান পদের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে ২০ লাখ টাকা চাঁদ দাবি ও পাঁচ লাখ টাকার মাছ চুরির অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে।
বুধবার (১৫ ডিসেম্বর) মামলাটি দায়ের করেন কালিকুটি এলাকার আল আমিন মিয়া (৩২) নামে এক যুবক।
আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে বর্তমানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা চলছে। এমন সময় দায়ের হওয়া এ মামলায় এলাকায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
মামলার বাদী আল আমিন মিয়া কালিকুটি এলাকার সুরুজ মিয়ার ছেলে। তিনি এলাকায় জমির ব্যবসা করে বলে জানা গেছে। মামলায় ৩ প্রার্থী ও চেয়ারম্যান পদের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকসহ মোট ২৮ নাম রয়েছে। এছাড়াও অজ্ঞাত আরো ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। দণ্ডবিধি ১৪৩, ৪৪৭, ৩২৩, ৩৮৫, ৩৭৯, ৫০৬ ও ১১৪ ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে {মামলা নাম্বার ১২ (১২)২১}।
এলাকাবাসীর দেয়া তথ্য ও মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা মাছের প্রজেক্টের সঙ্গে বাদীর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়াও গত ২০ বছরেও ওই মাছের প্রজেক্ট থেকে মাছ চুরির কোন ঘটনাই ঘটেনি বলেও জানায় স্থানীয়রা।
কিন্তু মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে সম্প্রতি ওই মাছের প্রজেক্ট থেকে আসামিরা পাঁচ লাখ টাকার মাছ চুরি করে নিয়ে গেছে বলে। এছাড়াও মামলার প্রধান আসামিসহ একাধিক আসামির ঠিকানা ও নাম ভুল উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারে।
মামলায় আসামি করা তিন প্রার্থীর দাবি হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই নির্বাচনের এই সময়ে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগে এ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এজাহারে উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী আসামিদের বিবরণ, মধ্য পানজোড়া এলাকার মৃত ফজলু মিয়ার ছেলে সেলিম মিয়া (৩৭), মৃত আঃ কাদের মিয়ার ছেলে অর্ণব (২৩), মাহাম্মদ মিয়ার ছেলে দিপু (৩০) ও অপু (২৮), বড়কাউ এলাকার শাহাজ উদ্দিনের ছেলে মজিবুর রহমান (৫৫), মধ্যে পানজোড়া এলাকার মোতালিব মোল্লার ছেলে মাহবুব মোল্লা (৩৮), রায়হান মোল্লা (৩০) ও হাবিবুর মোল্লা (৩২), ইছব কাজীর ছেলে রাজিব কাজী (২৮), কাজম আলীর ছেলে রেজাউল হক রানু (৪৫), পাড়াবর্থা এলাকার আহাদ আলীর ছেলে শিমুল (৩২), দক্ষিণ পানজোড়া এলাকার ফজর মিয়ার ছেলে কবির মিয়া (৩৯), কবির মিয়ার ছেলে নাইম মিয়া (২২), বড়কাউ এলাকার সিরাজুল ইসলামের ছেলে হায়দার (৩৯), মৃত সাহাজ উদ্দিনের ছেলে নজরুল ইসলাম (৪৫) ও দবির মিয়া (৩৫), আসমের ছেলে ইসকান্দর (৩২) ও রহমত উল্লাহ (২৬), মজিবুর রহমানের ছেলে জাহিদুল ইসলাম (৩৩) ও সাগর (২৮), সাবুদ আলীর ছেলে মাসুদ মিয়া (৪৮), আঃ মান্নানের ছেলে সুলতান মিয়া (৩০) ও শহিকুল (৩৫), আঃ হাকিমের ছেলে মান্নান (২৮) ও মানজুর মিয়া (৩৫), বাসাবাসি এলাকার আঃ হাইয়ের ছেলে শাহীন (২৮), আলী হোসেনের ছেলে সুরুজ জ্জামান (২৭) এবং বড়কাউ এলাকার মৃত সাহাজ উদ্দিনের ছেলে দবির (৪০)।
জানা গেছে, প্রধান আসামি করা সেলিম মিয়া বর্তমানে ৭ নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত সদস্য ও আসন্ন নির্বাচনের সদস্য পদপ্রার্থী। তার বাড়ি বড়কাউ এলাকায়। কিন্তু এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে মধ্যে পানজোড়া। একইভাবে ২,৩ ও ৪ নাম্বার আসামির বাড়িও বড়কাউ এলাকায় কিন্তু এজাহারে মধ্যে পানজোড়া উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও ৮ ও ১২ নাম্বার আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হাবিবুর রহমান (মোল্লা) ও কবির মিয়া ৫নং ওয়ার্ড থেকে সদস্য পদে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। মামলায় এসব তথ্য গোপন করা হয়েছে।
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, আসামিরা দুর্দান্ত দাঙ্গাবাজ, ”সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ উশৃংখল বকাটে প্রকৃতির লোক। তারা এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে নানা ধরনের অপরাধজনক কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়। এলাকায় সাধারণ মানুষ তাদের অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলে প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। বাদীর নিজ গ্রাম কালিকুটি মাদ্রাসার পূর্ব পাশে আনুমানিক ২০ বিঘা সম্পত্তিতে মাছের প্রজেক্ট করে তাতে রুই-কাতলাসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ করেন তিনি। প্রায় ১০ লাখ টাকার মাছের পোনা ছেড়ে প্রায় তিন বছর যাবৎ প্রতিমাসে ৭০ হাজার টাকা খরচসহ ২ জন লোকের মাধ্যমে পরিচর্যা করে প্রায় ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। পরিচর্যার ফলে মাছের প্রজেক্টে প্রায় ৮০ লাখ টাকা বিক্রয় উপযোগী মাছ রয়েছে।”
”আসামিরা বেশ কিছুদিন যাবৎ ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছে। তাদের দাবিকৃত চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিরা প্রজেক্টের সকল মাছ ধরে নিয়ে যাবে এবং প্রজেক্টে বিষ প্রয়োগ করে মাছ মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। গত ১১ ডিসেম্বর (শনিবার) সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বাদী নিজে মাছের প্রজেক্টে পরিচর্যা করার সময় সময় আসামিরাসহ অজ্ঞাত আরো ১০/১৫ জন দা, ছেন, লাঠি, চাপাতি, ধারালো ছোড়াসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রসহ মাছের প্রজেক্টে প্রবেশ করে চাঁদা দাবি করে। বাদী চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় ২ নাম্বার আসামী হুকুমে অন্য আসামিরা ক্ষিপ্ত হয়ে বাদীকে এলোপাথাড়ি মারপিট করে। সে সময় বাদী মাটিতে পড়ে গেলে ১ ও ৩ নাম্বার আসামী তাদের হাতে থাকা ছেন দা ও চাপাতি দিয়া বাদীকে জিম্মি করে আসামিদের সঙ্গে আনা বেড় জাল দিয়ে মাছের প্রজেক্ট থেকে আনুমানিক ৮০ মণ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরে নিয়ে যায়। যার আনুমানিক মূল্য পাঁচ লাখ টাকা। মাছ নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার স্থানীয় লোকজন দেখেছে। আসামিরা মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন বাধা ও নিষেধ করার সময় হুমকি দেয় এ বিষয়ে আইনের আশ্রয় নিলে বাদীর পরিবারকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হবে বলে।”
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি ও কালিকুটি নাজিমিয়া মদিনাতুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার সুপার আঃ ছবুর মিয়া বলেন, ১৯৯৫ সালে মাদ্রাসার পাশে থাকা জলাধারে কালিকুটি ও বড়কাউ এলাকার ৪৪ ব্যক্তি মিলে মাছের প্রজেক্ট করা হয়। সকলের অর্থে এই প্রজেক্টে মাছ চাষ করে পারিবারিকভাবে খাওয়া হয় এবং অতিরিক্ত মদ বিক্রি করা হয়ে থাকে। পূর্বাচল উপশহর হওয়ার পর ওই জলাধার ( প্রজেক্ট) লেক হিসেবে তৈরী করা হয়েছে। বর্তমানে লেকের মধ্যেই মাছ চাষ করা হচ্ছে। বিগত বিশ বছরের মধ্যেও কখনো এই পদে থেকে মাছ চুরির কোনো ঘটনা ঘটেনি।
তারা আরো বলেন, আল আমিন নামের কেউ এই মাছের প্রজেক্টের কোন অংশীদার নয়।
কালিকুটি নাজিমিয়া মদিনাতুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার সুপার আঃ ছবুর মিয়া আরো বলেন, ”মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার (১৯৮৩ সাল) পর থেকে আমি এই মাদ্রাসায় দায়িত্ব পালন করে আসছি। কখনো মাছ চুরির ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।’
মামলায় আসামি করা তিন প্রার্থীর সবাই বলেন, হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই নির্বাচনের এই সময়ে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগে এ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
৭ নং ওয়ার্ডের বর্তমান সদস্য ও আসন্ন নির্বাচনের সদস্য প্রার্থী সেলিম মিয়া বলেন, গত ১৩ ডিসেম্বর রাতে আমার কর্মী-সমর্থকদের উপর প্রতিপক্ষের লোকজন হামলা চালিয়ে দুইটি প্রাইভেটকার, ২২টি মোটরসাইকেল ও ৮টি আটো রিকসা ভাঙচুর করেছে। ওই বিষয়ে থানায় এজাহার দায়ের করা হলেও এখনো পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা নিয়েছে পুলিশ।
৫ ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী কবির মিয়া বলেন, আমাদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে অনেকেই চেয়ারম্যান পদের স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজ মিয়ার কর্মী-সমর্থক।
চেয়ারম্যান পদের স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজ মিয়ার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মামলার বাদী আল আমিন মিয়ার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কালীগঞ্জ থানার উলুখোলা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (এসআই) জাকির হোসেন বলেন, মামলা দায়েরর পর তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এখনো পর্যন্ত কোন আসামি গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আনিসুর রহমানের ব্যবহৃত সরকারি মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, নাগরী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অলিউল ইসলাম অলি (নৌকা), জাতীয় পার্টি মনোনীত মোমেন মিয়া (লাঙ্গল) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এ্যাড. সিরাজ মিয়া (চশমা)। এছাড়াও সংরক্ষিত ৩টি ওয়ার্ডে নারী সদস্য পদে ১৪ প্রার্থী এবং ৯টি সাধারণ ওয়ার্ডে সদস্য পদে মোট ৩৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। সর্বশেষ ভোটার তালিকা অনুযায়ী নাগরী ইউনিয়ন পরিষদের ৯টি ওয়ার্ডে মোট ভোটা সংখ্যা ৩০ হাজার ৬৯৭ জন। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৫২৬ জন মহিলা ভোটার এবং ১৫ হাজার ১৭১ জন পুরুষ ভোটার রয়েছে।
উল্লেখ্য : গত ১০ নভেম্বর (বুধবার) বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খন্দকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষিত তফসিল মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল ২৫ নভেম্বর। বাছাই ২৯ নভেম্বর। আপিল ৩০ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর। আপিল নিষ্পত্তি ৩ ডিসেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৬ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ ৭ ডিসেম্বর। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২৬ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
এ সংক্রান্ত আরো জানতে………..
ইউপি নির্বাচন নাগরী: আচরণবিধি লঙ্ঘন করে মাহফিলে ভোট প্রার্থনা, স্বতন্ত্র প্রার্থীকে শোকজ
ইউপি নির্বাচন নাগরী: আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় নৌকার প্রার্থীকে সতর্ক করেছে রিটার্নিং কর্মকর্তা
নাগরী ইউপি নির্বাচন: মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা
ইউপি নির্বাচন: ২৩ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৬ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ
কালীগঞ্জের নাগরীসহ চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচন ২৩ ডিসেম্বর
নাগরী উপনির্বাচন: আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অলি ১২ হাজার ৭৫৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী
নাগরী উপনির্বাচন: ‘রাতে সিল মারা ঠেকাতে’ কেন্দ্রে ব্যালট যাবে ভোরে, পাঁচ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ
নাগরী উপনির্বাচন: তিন দিন মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা
নাগরী উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে আজীবন বহিষ্কার তিন নেতা
নাগরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন আটজন
নাগরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচন ২০ অক্টোবর
নাগরী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির মিয়ার ইন্তেকাল