গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ঢাকার বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের আলোচিত মামলার রায়ে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দিয়েছে আদালত।
ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে আসামিদের উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ভিকটিমদের ডাক্তারি রিপোর্টে কোনো সেক্সুয়াল ভায়োলেশনের বিবরণ নেই। ভিকটিমের পরীধেয়তে পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মিললো না। … ৩৮ দিন পর এসে তারা বললো ‘রেপড হয়েছি’, বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিত ছিল।”
তা না করে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের ‘পাবলিক টাইম নষ্ট’ করেছেন পর্যবেক্ষণ দিয়ে বিচারক বলেন, পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে কোনো ধর্ষণের মামলা না নেয়।
বিচারক রায় পড়ার সময় আরো বলেন, ‘আপনারা বলছেন-এটি একটি আলোচিত মামলা, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে সব মামলাই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলাটির মেডিক্যাল রিপোর্টে কিছুই পাওয়া যায়নি এবং ডাক্তাররা কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি।’
রায় শোনার পর আদালতের মধ্যে আসামিরা আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠেন। এরপর তাদের বের করার সময় খালাস পাওয়া আসামি নাইম আশরাফ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘সত্যের জয় হয়েছে। আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। এটা সাজানো ছিল। আমরা ভিক্টিমাইজ ছিলাম। আদালত সঠিক রায় দিয়েছেন।’
এর আগে, ১২ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু বিচারক অসুস্থ থাকায় পরবর্তী রায় ঘোষণার জন্য ২৭ অক্টোবর দিন ধার্য করেন। ওই দিন সিনিয়র আইনজীবী বাসেত মজুমদার মারা যাওয়ায় আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ফলে রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ধার্য করা হয়েছিল।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, হোটেলে আসার পর ওখানে কোনো পার্টির পরিবেশ না দেখে বাদী ও তাঁর বান্ধবী চলে যেতে চান। সাফাত আহমেদ তাঁদের কেক কাটার পর যাওয়ার অনুরোধ করেন। সে সময় বাদী ও তাঁর বান্ধবী ছাড়াও তাঁদের একজন চিকিৎসক বন্ধু ও তাঁর বান্ধবী ছিলেন। তাঁরা সবাই চলে যেতে চাইলে সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিম বাদীর চিকিৎসক বন্ধুকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ মারধর করে তাঁর গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নেন এবং তাঁদের (চিকিৎসক ও তাঁর বান্ধবী) একটি কক্ষে আটকে রেখে ভয়ভীতি দেখিয়ে বলেন, ‘পালাবি না।’ এরপর সাফাত ও নাঈম বাদী ও তাঁর বান্ধবীকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন। গাড়িচালক বিল্লাল বাদীর চিকিৎসক বন্ধুকে মারধরের ভিডিও ধারণ করেন।
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সাফাত বলেন, বাদীর সঙ্গে জন্মদিনের সপ্তাহ দুয়েক আগে তাঁর পরিচয় হয় সাদমান সাকিফের মাধ্যমে। দ্রুতই তাঁরা বন্ধু হয়ে ওঠেন। তিনি দাবি করেন, বাদীর পছন্দে তিনি রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিন উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দুটি কক্ষ বুকিং দিয়েছিলেন। ২৮ মার্চ রাতে তাঁরা মদ খেয়ে বেসামাল ছিলেন।
আসামি নাঈম আশরাফ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। নাঈম জবানবন্দিতে বলেন, তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু মডেলের পরিচয় ছিল। তাঁরা সুযোগ পেলে ইচ্ছেমতো এই নারীদের ব্যবহার করতেন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও বিকেল থেকে দুজন মডেল ছিলেন। পরে তাঁদের অনুরোধে আরও একজন বাড্ডা থেকে যোগ দেন। ধর্ষণের শিকার দুই নারী ও তাঁদের বন্ধুরা হোটেলে আসেন রাত নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার দিকে। অতিথিদের একজনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তিনি হোটেলে ফেরেন দিবাগত রাত দেড়টার দিকে।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জানানো হয়, এ মামলায় ৪৭ সাক্ষীর মধ্যে ২১ জনকে আদালতে হাজির করা হয়। গত ৩ অক্টোবর এই মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হয়। সেদিন এ মামলার পাঁচ আসামির জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ৭ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন।
অভিযোগপত্রে আসামি সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিমের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় ধর্ষণের অভিযোগ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৩ জুলাই একই আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ওই বছরে ১৯ জুন একই ট্রাইব্যুনাল আসামিদের বিরুদ্ধ অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। অপর আসামি সাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ, দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে ওই আইনের ৩০ ধারায় ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ করা হয়েছে।