গাজীপুর

কালীগঞ্জে ঝুঁকিতে বেড়িবাঁধ, অবশেষে অবৈধ যান চলাচল বন্ধে কঠোর হচ্ছে প্রশাসন

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কালীগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ (সড়ক) দিয়ে অবৈধভাবে প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত ওজন বহনকারী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান (ভারী যানবাহন) চালচলের ফলে ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেড়িবাঁধ।

এমন পরিস্থিতিতে বেড়িবাঁধ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে অবৈধভাবে চলা ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধের জন্য কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কাছে আবেদন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

গত ১১ জুলাই বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নরসিংদী কার্যালয়ের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন স্বাক্ষরিত আবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

অপরদিকে আবেদনের প্রেক্ষিতে বেড়িবাঁধ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে অবৈধভাবে চলাচল করা ভারী যানবাহন বন্ধে মৌখিক নোটিশ দেয়া হলেও মানছেনা গাড়ি চালকরা। তাই এখন কঠোর হচ্ছে প্রশাসন। সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেড়িবাঁধ ব্যবহার করে অবৈধভাবে চলাচল করা ভারী যানবাহন বন্ধে সড়কের পাঁচ স্থানে নির্মাণ করা হবে প্রতিরোধক (গেইট) ব্যবস্থা। এরপরও ভারী যানবাহন চলাচল করলে নেয়া হবে আইনি ব্যবস্থা।

স্থানীয়রা জানায়, পার্শ্ববর্তী রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নে থাকা পেট্রোম্যাক্স এলপিজি লিমিটেড, জি গ্যাস এলপিজি এবং কালীগঞ্জের বর্তুল এলাকায় থাকা বিএমসি সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ এর শতশত পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান আনুমানিক প্রায় ৩০-৪০ টন ওজনের মালামাল নিয়ে প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে বেড়িবাঁধ দিয়ে চলাচল করছে। অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই এসব ট্রাক আর কাভার্ডভ্যান চলাচলের কারণে বেড়িবাঁধটি ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় বেড়িবাঁধটি ঝুঁকিমুক্ত রাখতে জরুরী এসব অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করা দরকার। অন্যথায় কোটি-কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কটি দ্রুতই নষ্ট হয়ে যাবে। এছাড়াও নিয়মিত এসব অবৈধ যানবাহন চলাচলের কারণে স্থানীয়দের এ সড়ক দিয়ে যাতায়েত করতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। অবৈধভাবে অতিরিক্ত ওজন বহনকারী করা ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাঁধটি। এতে এলাকার লোকজনও আতঙ্কে থাকে সব সময়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড আবেদনে উল্লেখ করেছে, “বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নরসিংদী পওর বিভাগের আওতাধীন “উত্তর রূপগঞ্জ পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের” বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পের অধীন ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কালীগঞ্জ উপজেলার তুমুলিয়া ইউনিয়নের তুমুলিয়া-সোম-বঙ্গবন্ধু-কলিঙ্গা অংশ দিয়ে প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে ভারী যানবাহন (ট্রাক, কাভার্ডভ্যান) চলাচল করছে। এর ফলে বেড়িবাঁধটি ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় বেড়িবাঁধটি ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সকল প্রকার ভারী যানবাহনের (ট্রাক, কাভার্ডভ্যান) অবৈধ চলাচল বন্ধ করার বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।”

জানা গেছে, বন্যা ও দুর্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তুমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বর্তুল পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার সড়ক পুনর্বাসন করছে। সড়কের প্রস্থ বৃদ্ধি করে ১৮ ফিট করা হয়েছে। এই কাজের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান প্রবাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিঃ। ২০২০ সালের ২০ জুলাই স্থানীয় সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি (এমপি) সড়ক সংস্কার ও বর্ধিত করণ (সড়ক পুনর্বাসন) কাজের উদ্বোধন করেন। যদিও চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের ১ জুলাই কাজ শুরু করে ২০২১ সালের ৫ মার্চের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে এখনো কাজ শেষ হতে কিছুটা বাকী রয়েছে।

তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক শরীফ হোসেন খান কনক। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে সড়কের প্রায় ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ করা হয়েছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সড়কের উন্নয়ন কাজ শেষে করে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।

তুমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৭ ওয়ার্ডের সদস্য মুহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে গড়ে উঠা সড়কটি কালীগঞ্জ ও রূপগঞ্জ উপজেলার মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। প্রতিদিন শতশত যানবাহন ও হাজার হাজার লোকজন চলেফেরা করে এই সড়ক দিয়ে। রূপগঞ্জ উপজেলা সদরের দুরত্ব বেশি থাকায় ওই উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের লোকজনের কাছে কালীগঞ্জে আসার জন্য এই সড়কটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এই সড়ক দিয়ে কালীগঞ্জের প্রায় ৮/১০ টি স্কুল-কলেজে এবং হাসপাতালে যাতায়াত করে স্থানীয়রা। রূপগঞ্জ উপজেলায় থাকা কয়েকটি কোম্পানির গাড়ি বেড়িবাঁধ দিয়ে চলাচলের কারণে এলাকার মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখনই ওই যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রন ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা করা না হলে বেড়িবাঁধটি হুমকিতে পড়বে বলে মনে করছেন তিনি।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নরসিংদী কার্যালয়ের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বেড়িবাঁধ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে অবৈধভাবে চলা ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধের জন্য কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কাছে আবেদন করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল বারেক বলেন, তুমুলিয়া-বর্তুল সড়কটির ধারণক্ষমতা ১০টন পর্যন্ত। যদি এই সড়ক দিয়ে ১০ টনের অধিক ওজনের যানবাহন চলাচল করে তবে সড়কটির স্থায়িত্বকাল দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। সাধারণত চার বছর পরপর এলজিইডি’র সড়ক সংস্কার করা হয়। আশা করা হচ্ছে এই সড়কটিও চার বছর স্থায়িত্বকাল পাবে।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইউএনও শিবলী সাদিক বলেন, “পানি উন্নয়ন বোর্ডের চিঠি পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে বেড়িবাঁধ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ওই সড়ক দিয়ে চলাচল করা অতিরিক্ত ওজন বহনকারী যানবাহন চলাচল বন্ধে মৌখিকভাবে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। তবু কিছু যানবাহন চলাচল করছে। এই পরিস্থিতিতে ওই সড়ক দিয়ে অধিক ওজন বহনকরা যানবাহন চলাচল বন্ধের জন্য সড়কের পাঁচ স্থানে প্রতিরোধক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সড়কের সংস্কার কাজ শেষ হওয়ার আগেই প্রতিরোধক নির্মাণ করে অধিক ওজন বহনকরা যানবাহন চলাচল বন্ধ করা হবে। এরপরও যদি অতিরিক্ত ওজন বহন করে কোন যানবাহন চলাচল করে তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

উল্লেখ্য: তৎকালীন সরকার ১৯৮৫ সালের এপ্রিল মাসে বর্তমান কালীগঞ্জ উপজেলার তুমুলিয়া ও নাগরী ইউনিয়ন এবং রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের প্রায় ৩ হাজার ৭’শ হেক্টর এলাকা নিয়ে “উত্তর রুপগঞ্জ পানি সংরক্ষণ প্রকল্প” বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেন। যা ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে আলোর মুখ দেখে। আর এই একটি মাত্র প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলেই বদলে যায় গোটা এলাকার দৃশ্যপট। শুরু হয় নতুন দিগন্ত। এরপর থেকেই ওই অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয় এবং জীবনযাত্রায় আমুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

“উত্তর রুপগঞ্জ পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের” নথিপত্র পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন এবং সেচ প্রদানের উদ্দেশ্যে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বাংলাদেশ সরকার এবং চীনের যৌথ অর্থায়নে ৩৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে চায়না প্রযুক্তিগতদল দীর্ঘ পাঁচ বছর ৬ মাস কর্মযজ্ঞ শেষে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। প্রকল্পের মোট জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৭’শ হেক্টর। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৮ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে যা বর্তমানে সড়ক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। প্রকল্পের মধ্যে সেচ অঞ্চল রয়েছে ২ হাজার ২’শ ৭০ হেক্টর জমি।

প্রকল্পটি রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের বেলদী এলাকা থেকে শুরু হয়ে কালীগঞ্জ উপজেলার তুমুলিয়া ইউনিয়নের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা হয়ে নাগরী ইউনিয়ন ঘুরে বৃত্তাকার হয়ে দাউদপুর ইউনিয়নে গিয়ে যুক্ত হয়েছে।

সেচ খাল নির্মাণ করা হয়েছে মোট ৩৮.৫ কিলোমিটার। এরমধ্যে ১৮.৩৫ কিলোমিটার প্রধান সেচ খাল, ১৬.৩৭ কিলোমিটার পার্শ্ববর্তী সেচ খাল এবং ৩.৭৮ কিলোমিটার উপ-পার্শ্ববর্তী সেচ খাল রয়েছে।

এছাড়াও ১৫.৫০ কিলোমিটার নিষ্কাশন খাল নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৭.৬৫ কিলোমিটার প্রধান নিষ্কাশন খাল এবং ৭.৮৫ পার্শ্ববর্তী নিষ্কাশন সেচ খাল রয়েছে।

একটি পাম্প স্টেশন থেকে পুরো প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

 

আরো জানতে………

কালীগঞ্জে এক প্রকল্পেই বদলে দিলো ইতিহাস, জীবনযাত্রায় এসেছে আমুল পরিবর্তন

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button