আলোচিত

ওবায়দুল কাদেরের ফিরে আসা যেন রূপকথার গল্প

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সুস্থ হয়ে শুক্রবার (৫ এপ্রিল) হাসপাতাল ছেড়েছেন। ঢাকা থেকে চার হাজার কিলোমিটার দূরে সিঙ্গাপুরের স্থানীয় সময় দুপুর ৩টায় মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল ত্যাগ করেন তিনি। হাসপাতাল ছাড়ার সময় সেতুমন্ত্রীর পরনে ছিল সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীর উপরে কালো মুজিবকোট, কোটের পকেটে লাল কাপড়ের কিয়দংশ উঁচু হয়ে আছে, চুলগুলো পরিপাটি করে আচড়ানো, চোখে কালোফ্রেমের চশমা, ক্লিন শেভ, শুকনো মুখে সেই চিরচেনা স্মিত হাসি।

নেতাকর্মীঘেরা ওবায়দুল কাদের নিজেই হেঁটে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠে বসেন। এ সময় তাঁর স্ত্রী ইশরাতুন্নেসা কাদের তাকে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে হাত নাড়তে বলেন। কাদের গাড়িতে বসার আগে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে হাত নেড়ে তাদের সম্ভাষণের জবাব দেন।

নেতাকে এভাবে দেখতে পেয়ে সেখানে উপস্থিত কর্মীদের মধ্যেও তখন বেজায় আনন্দ। সবার মোবাইল তখন হাতে। কেউ সেই মুহূর্তের ছবি তুলছেন, কেউ বা ব্যস্ত ফেসবুক লাইভে। আর এভাবেই বাংলাদেশ সময় ১টার দিকে আমরা ঢাকায় থেকে ওবায়দুল কাদেরের হাসপাতাল ছাড়ার দৃশ্য দেখতে পাই।

হঠাৎ হৃদরোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, আইসিইউ, সিসিইউ-তে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ওপেন হার্ট সার্জারি, দেশব্যাপী মানুষের দোয়া-ভালোবাসায় শেষ পর্যন্ত ওবায়দুল কাদেরের সুস্থ হওয়া সবকিছুই অনেকটা রূপকথার গল্পের মতোই।

সেদিন খুব সকালে শুনি সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে ভর্তি। কথাটা প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি। কেননা আগের দিনই সুস্থ যে মানুষটি বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছেন,আমাদের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি নাকি এখন আইসিসিউতে।

তবুও খবর শুনে দ্রুত হাসপাতালে চলে যাই। তখনো হাসপাতালে মানুষজন বেশি আসেনি। কারো কাছে তেমন তথ্যও নেই। কেউ বলেন আইসিইউ-তে, কেউ বলেন সিসিইউ-তে, কেউ বলেন হার্ট অ্যাটাক, কেউ বলেন ফজরের নামাযের সময় পড়ে গেছেন, কেউ বলেছেন এনজিওগ্রাম করে হার্টে রিং পড়ানো হচ্ছে, কেউ বলছেন ইউনাইটেড হাসপাতাল কিংবা সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওবায়দুল কাদেরকে।

এভাবেই অগোছালো তথ্য পেতে শুরু করি। একটু একটু করে পাওয়া তথ্য নিউজ করে অফিসে পাঠাই। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লোকজনও বাড়তে থাকে, অনেক সাংবাদিকরাও উপস্থিত হন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও প্রাথমিক ধাক্কা গুছিয়ে নিয়ে ব্রিফ করতে থাকেন।

এক পর্যায়ে ডাক্তাররা জানান, তাঁর হার্টে ব্লক ধরা পড়ার কথা, সংকটজনক অবস্থার কথা। কাদেরের অসুস্থতায় গোটা দেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠে। সেই সময় ওবায়দুল কাদেরকে দেখার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে চিকিৎসাধীন ওবায়দুল কাদেরের একটা ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ছবিতে দেখা যায়, তার হাতে, মুখে, নাকে কৃত্রিম লাইফসাপোর্টের যন্ত্রপাতি লাগানো। ঘুমন্ত তিনি।

আমরা যে কাদেরকে চিনি তাঁর সঙ্গে একদম বেমানান। ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে সেদিন জেনেছিলাম, লাইফ সাপোর্টে থাকা ওবায়দুল কাদেরের রক্তচাপ একবার ৩৫ এ নেমে এসেছিল। মাত্র ৩৫! সেখান থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ৬০/৮৮ হয় একবার। মানুষের দোয়া ও সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে না থাকলে এভাবে ফিরে আসা সম্ভব হতো না।

এরপরের ঘটনা দ্রুত ঘটতে থাকে। ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসার কার্যক্রম সরাসরি তদারকি করেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঐদিন বিকালে তিনি চিকিৎসাধীন ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে যান। তারপর রাষ্ট্রপতি তাঁকে দেখতে যান। মন্ত্রী এমপিরা তো ছিলেনই। রাতটুকু পার হয়। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের একটি টিম এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকায় উড়ে আসে।

পরদিন ৪ মার্চ সোমবার ভারতের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠিকে ঢাকায় উড়িয়ে আনা হয়। কাদেরের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড কাদেরকে সিঙ্গপুরের নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে দেবী শেঠি বলেন, ‘গো অ্যাহেড।’ বিকাল বেলা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে চলে যান।

সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চলে প্রায় এক মাসের নিবিড় চিকিৎসা। কাদেরের চিকিৎসায় গঠিত হয় পাঁচ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। যার নেতৃত্বে ছিলেন কার্ডিওলজিস্ট ডা. ফিলিপ কোহে। তার নেতৃত্বে সেখানকার আইসিইউতে ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসা চলে। প্রতিদিনই তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে থাকে।

তিনদিন পর ৭ মার্চ শারীরিক অবস্থা আরও উন্নত হলে কাদেরের হৃদযন্ত্রে স্থাপিত আওবিপি মেশিন সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘুমের ওষুধের মাত্রা কমিয়ে আনা হয়। চিকিৎসকদের ডাকে সাড়াও দিতে থাকেন তিনি। ৮ মার্চ রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিডনি স্বাভাবিক কাজ শুরু করে। ইনফেকশনও নিয়ন্ত্রণে আসে। কৃত্রিম সাপোর্ট ছাড়াই হৃদযন্ত্র কাজ করতে থাকে।

৯ মার্চ শ্বাসনালীর নল খুলে দেওয়া হয়। চিকিৎসক ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। ১১ মার্চ সীমিত হাঁটাচলা করেন। দুয়েক জনের সঙ্গে কুশল বিনিময়ও করেন। ১৩ মার্চ সেতুমন্ত্রীকে আইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। নরম খাবার খাওয়া শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি চলতে থাকে বাইপাস সার্জারির প্রস্তুতি।

এরপর ২০ মার্চ হাসপাতালের সার্জন ডা. সিবাস্টিন কুমার সামির নেতৃত্বে ওবায়দুল কাদেরের বাইপাস সার্জারি হয়। এরপর ৪৮ ঘণ্টা ওবায়দুল কাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে পর্যবেক্ষণ করা হয়। সফল অপারেশনের পর সংকটাপন্ন অবস্থা দূর হওয়ায় ২২ মার্চ তার শীররে লাগানো আইওবিপি মেশিন খুলে ফেলা হয়। বাকি প্যারামিটারগুলোও স্বাভাবিক ছিল।

২৩ মার্চ এন্ড্রোট্রকিয়াল টিউব খুলে ফেলা হয়। ঘুমের ওষুধের মাত্রাও কমিয়ে দেওয়া হয়। ২৬ মার্চ মঙ্গলবার ওবায়দুল কাদেরকে আইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। ৫ এপ্রিল বিকেলে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।

সিঙ্গাপুরে এই দীর্ঘ চিকিৎসাকালীন ১ এপ্রিল ওবায়দুল কাদেরের একটি ছবি সবার সামনে আসে। হাসপাতালের নীলরঙ্গা পোশাক পরিহিত সেই কাদের ছিলেন অনেকের কল্পনার বাইরে। দুই হাতে ব্যান্ডেজ, বুকের বামপাশে গভীর কাটা দাগ, অগোছালো চুল, শুকনো মুখে স্মিত হাসি নিয়ে দুই ডাক্তারকে পাশে নিয়ে বসে ছিলেন কাদের।

তবে অকল্পনীয় সেই ছবিটাই স্বস্তির আবেশ ছড়িয়ে দেয়। কেননা সুস্থ হয়ে উঠছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এখন তিনি সিঙ্গাপুরে একটি বাসায় থেকে আরও দুই থেকে তিন সপ্তাহ চিকিৎসা নেবেন। তারপর সবকছু ঠিক থাকলে দেশে ফিরে আসবেন।

ওবায়দুল কাদেরের রয়েছে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে যেমন শরীরে স্প্লিন্টারের আঘাত নিয়ে বেঁচে আছেন তেমনি রাজনৈতিক মামলায় বহুবার জেল খেটেছেন। কিন্তু কখনোই দমিয়ে রাখা যায়নি কাদেরকে। ছাত্রনেতা থেকে জননেতা, ছাত্রলীগ সভাপতি থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

রাজনীতিতে লেগে থাকলে যেকোনো কিছুই সম্ভব সেটা দেখিয়েছেন তিনি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী হিসেবে যেমন পদ্মা সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, ঢাকা চট্টগ্রাম ফোর লেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল ফোর লেনসহ সমস্ত মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশনায় করে গেছেন নিরলস পরিশ্রম তেমনি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলকে গোছাতে ছুটে গেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

কথার ফুলঝুরি নিয়ে একদিনে তিন-চারবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে অভ্যস্ত ওবায়দুল কাদের। কিন্তু গত একমাস ধরেই ওবায়দুল কাদের অসুস্থ, দেশেও নেই, ধানমণ্ডি ৩/এ তে সাংবাদিকদের আনাগোনা কম। তাই দেশবাসীর মতো সাংবাদিকরা অপেক্ষায় আছে সেতুমন্ত্রীর ধানমণ্ডি ৩/এ-তে কিংবা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পার্টি অফিসে, সড়কে কিংবা সেতুভবনে ওবায়দুল কাদেরের প্রেস ব্রিফিংয়ে তাঁকে প্রশ্ন করবেন বলে।

 

রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button