এমপি-পুত্র হত্যায় জালিয়াতির অভিযোগ কালীগঞ্জের ওসি এবং তদন্ত কর্মকর্তা’র বিরুদ্ধে!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বেআইনিভাবে স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে সাবেক এমপি-পুত্র হাবিবুর রহমান ফয়সাল হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত দুই আসামির নাম বাদদিয়ে গোপনে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে কালীগঞ্জ থানার ওসি এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা’র বিরুদ্ধে।
জালিয়াতির বিষয়ে বৃহস্পতিবার (০৪ এপ্রিল) মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) এবং ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী।
এছাড়াও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ওসি এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা’র বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানান বাদী।
অভিযোগে কালীগঞ্জ থানার ওসি মো. আবু বকর মিয়া (বিপি-৬৭৯৯০৩৭২৮৬) এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সৈয়দ আবুল হাশেমের (বিপি-৭৫৯৩০৩৪৫৮২) বিরুদ্ধে স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছেন মামলার বাদি মাসুমা সুলতানা (মুক্তা) নামে ওই ভুক্তভোগী।
{অভিযোগের রেফারেন্স: আইজিপি কমপ্লেইন্টস মনিটরিং সেল, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা (এস-৪২৩)}
২০১৭ সালের ৩০ জুলাই রাতে কালীগঞ্জ পৌর এলাকার ভাদগাতী গ্রামে বাড়ির পাশে একটি মুদি দোকানে সাবেক এমপি প্রয়াত মোখলেছুর রহমান জিতু মিয়ার ছেলে হাবিবুর রহমান ফয়সালকে (৩২) বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের বড়বোন মাসুমা সুলতানা মুক্তা বাদী হয়ে ১ আগস্ট রাতে কালীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় কালীগঞ্জ পৌর এলাকার ভাদগাতী গ্রামের সাইদুল ইসলাম উরফে মোসলে উদ্দিন মাস্টারের ছেলে মো. তৌহিদুল ইসলাম রিমন(২৭), ২। একই গ্রামের হানিফার ছেলে নওশাদ (৩২),৩। আহসান উদ্দিনের ছেলে মো. হুমায়ুন (৩৫) ও ৪। মুঞ্জুর (৪২), ৫। খঞ্জনা গ্রামের আঃ রহমানের ছেলে আব্দুস সাত্তার (৩২) এবং প্রধান আসামি রিমনের বাবা সাইদুল ইসলাম উরফে মোসলে উদ্দিন মাস্টার (৫৮)।
অভিযোগে মাসুমা সুলতানা (মুক্তা) উল্লেখ করেন , আমি মাসুমা সুলতানা মুক্তা (৫২), পিতা মৃত- মোখলেছুর রহমান (জিতু মিয়া) এই মর্মে লিখিত ভাবে জানাইতেছি যে, ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই রাত আনুমানিক রাত সাড়ে আটটার দিকে আমার ভাই হাবিবুর রহমান ফয়সালকে (৩২) পিস্তল দিয়া গুলি করে হত্যার ঘটনায় আমি বাদী হয়ে ছয়জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত আরো ৩/৪ জনকে আসামি করে কালীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করি। {মামলা নং- ০১(০৮)১৭}
পরবর্তীতে উক্ত মামলার ১নং আসামি তৌহিদুল ইসলাম রিমন র্যাব-১, উত্তরা কর্তৃক পিস্তল সহ গ্রেফতার হয়। পরে কালীগঞ্জ থানায় র্যাব সদস্য বিজেও-৪৪৭২৭ ওয়াঃ আফিঃ মো আবু বকর মিয়া র্যাব-১, সিপিসি-২, উত্তরা বাদী হয়ে ১৮৭৮ সনের অস্ত্র আইন (সংশোধনী/০৩) এর ১৯(ক)(চ) ধারায় অপর একটি মামলা দায়ের করেন {মামলা নং- ০৮(০৮)১৭ । এর একদিন পর ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট মামলার ১নং আসামি তৌহিদুল ইসলাম রিমন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
জবানবন্দিতে হত্যায় ব্যবহৃত অবৈধ পিস্তলের মালিকানা নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয় রিমন। জবানবন্দি সে বলে কালীগঞ্জ পৌর যুবলীগের সভাপতি বাদল হোসেন তার ভাই এনামুল হক মনুকে পিস্তলটি কিনে দিয়েছিলেন। মনু তার সহযোগী মো. হুমায়ুনকে অবৈধ পিস্তলটি দেন। হুমায়ুন শুটার তৌহিদুল ইসলাম রিমনকে দিয়ে হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করে। ঘটনাস্থলে হুমায়ুনও উপস্থিত ছিলেন। রিমন জবানবন্দি দেওয়ার তিন মাস পর মনু সৌদি আরবে পালিয়ে যায়।
কিন্তু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া কোন আসামির নাম উল্লেখ না করেই দীর্ঘ প্রায় ১১ মাস তদন্তের পর গত ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন (অভিযোগ পত্র নং ১৭৭)।
অস্ত্র মামলার বাদী র্যাব সদস্য হওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে আসামিদের নাম বাদ দেওয়ায় আমি কোন আইনি সহযোগিতা পাইনি।
এদিকে আমাকে না জানিয়েই অত্যন্ত গোপনে গত চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। পরবর্তীতে মামলা তদারকির জন্য নিযুক্ত আমার আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে দাখিলকৃত অভিযোগপত্র সংগ্রহ করে জানতে পারি এজাহারভুক্ত দুই আসামির নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং অভিযোগপত্রের সাথে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৭৩ (১)(খ) অনুসারে তদন্তের ফলাফল বাদী/ সংবাদ দাতাকে অবহিত করণঃ নামক একটি ফর্মে আমার স্বাক্ষর অবিকল জাল করে অভিযোগপত্রের সঙ্গে দাখিল করেছে।
অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে অভিযোগপত্রে মামলার চার নাম্বার আসামী মুঞ্জুর হোসেন (৩৫) এবং প্রধান আসামি রিমনের বাবা ছয় নাম্বার আসামী সাইদুল ইসলাম উরফে মোসলে উদ্দিন মাস্টারকে (৬২) মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করে পুলিশ।
স্বাক্ষর জাল করে আদালতে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রটি কালীগঞ্জ থানার ওসি মো. আবু বকর মিয়া এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সৈয়দ আবুল হাশেমের স্বাক্ষরিত।
এমতাবস্থায় আমি মামলাটি পূর্ণতদন্ত সহ আমার স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে বেআইনিভাবে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রটি প্রত্যাহার পূর্বক সুষ্ঠু তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন এবং স্বাক্ষর জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কালীগঞ্জ থানার ওসি আবু বকর মিয়া এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সৈয়দ আবুল হাশেমের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।
অভিযোগের বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) সৈয়দ আবুল হাশেম বলেন, আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রের সঙ্গে অবহিত করণ ফরমে যে স্বাক্ষর তা বাদীর নিজেরই। কিন্তু বাদীর স্বাক্ষরিত ফরমটি পূর্ববর্তী তদন্ত কর্মকর্তার রেখে যাওয়া মামলার ডকেটে ছিল।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাদীকে একাধিকবার থানায় আসতে বললেও তিনি না আসায় তাকে অবহিত না করেই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করতে হয়েছে।
বর্তমানে উত্তরা পশ্চিম থানায় কর্তব্যরত মামলার পূর্ববর্তী তদন্ত কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) মুজিবুর রহমান বলেন, আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করতে হলে অবশ্যই বাদীকে অবহিত করতে হবে। আর অবহিত করার দায়িত্ব তদন্ত কর্মকর্তার। এ ব্যাপারে ডকেটে রেখে যাওয়া অবহিত করণ ফরম দাখিল করার কোন সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু বকর মিয়ার ব্যবহৃত সরকারি মুঠোফোনে একাধীকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার কোন বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
মামলার বাদী এবং অভিযোগকারী মাসুমা সুলতানা (মুক্তা) বলেন, আমি মামলাটি পূর্ণতদন্ত সহ স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে বেআইনিভাবে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রটি প্রত্যাহার পূর্বক সুষ্ঠু তদন্তের জন্য এবং স্বাক্ষর জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কালীগঞ্জ থানার ওসি আবু বকর মিয়া এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সৈয়দ আবুল হাশেমের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে বৃহস্পতিবার (০৪ এপ্রিল) মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) এবং ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি।
এছাড়াও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
সংযুক্তি হিসেবে দায়ের করা লিখিত অভিযোগের সঙ্গে জমা দিয়েছেন, থানায় দায়ের করা হত্যা মামলার এজাহারের কপি, আদালতে আসামির দেওয়া ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির ফটোকপি, হত্যা এবং অস্ত্র মামলায় আদালতে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রের ফটোকপি, স্বাক্ষর জাল করে আদালতে দাখিলকৃত অবহিত করণ ফরমের ফটোকপি, ঘটনা সম্পর্কিত বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত নিউজের কপি এবং আসামিকে আটকের পর র্যাবের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ফটোকপি।
অভিযোগের সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে জমা দেওয়া সকল ডকুমেন্টের কপি আমাদের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৮ সালের ০১ সেপ্টেম্বর শনিবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মর্তূজা মাহফুজ নামে পলাতক এক আসামিকে গ্রেফতার না করে বরং তার সঙ্গে ওসি’র অফিস কক্ষে দীর্ঘ সময় মিটিং করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আবু বকর মিয়ার বিরুদ্ধে।
নিহতের বাবা প্রয়াত মোখলেছুর রহমান জিতু মিয়া ১৯৭৩ সালে কালীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। পরে তার বিপুল জনপ্রিয়তায় ১৯৭৯ সালে গাজীপুর সাবেক ৩ ও বর্তমান ৫ সংসদীয় কালীগঞ্জ আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি থেকে মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরের বার ১৯৮৮ সালে বিএনপি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে সতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন এবং সেবারও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আরো জানতে…..
পলাতক আসামীর সঙ্গে থানায় ওসি’র মিটিং!