গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার আবদুল সাত্তারের ছেলে মো. আবু (২২) কনডেম সেলে আছেন ২০১১ সাল থেকে। হাইকোর্টে মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) নিষ্পত্তি না হওয়ায় মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তিনি। উপজেলার ক্ষইটাদী নাগড়াপাড়া এলাকার শিশু ছাদিয়াকে (৮) গলাটিপে হত্যা করে আবু এবং তার সহযোগী নাসির।
ঘটনার পর আবু গ্রেফতার হলেও নাসির পলাতক। বিচারিক আদালত আবুকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে এ সংক্রান্ত ডেথ রেফারেন্সটি হাইকোর্টে আসে। আবুও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। হাইকোর্টে মামলা ভিড়ে এটি চাপা পড়ে আছে।
নেত্রকোনা সদরের আবু তালিব (৬৬) ও স্বপন (৪৬) ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কারাগারের কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন ২০১৩ সাল থেকে। হাইকোর্টে মামলার ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। জানা যায়, পূর্বশত্রুতার জের ধরে ২০০১ সালে নেত্রকোনার বিচিপাড়া গ্রামের তাহের উদ্দিনকে হত্যার দায়ে ২০১৩ সালে বিচারিক আদালত তালিব ও স্বপনসহ ৪ জনকে ফাঁসি দেন।
তাদের আইনজীবী সাইফুর রহমান রাহী বলেন, মৃত্যুযন্ত্রণা নিয়ে তারা কাশিমপুর কারাগারের কনডেম সেলে আছেন। মামলার ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে, রাষ্ট্রপক্ষ পেপারবুক পড়া শেষ করেছে। চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল বিভাগে যেতে পারেন। এর আগ পর্যন্ত আসামিদের কনডেম সেলেই থাকতে হচ্ছে।
প্রতি বছর যত সংখ্যক ডেথ রেফারেন্স মামলা হাইকোর্টে আসছে তার অর্ধেকও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ফলে প্রতি বছরই বাড়ছে মামলার সংখ্যা। হাইকোর্টে বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা সবশেষে ৭১১টিতে গিয়ে ঠেকেছে। এ সংখ্যা ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব মামলায় সারাদেশে কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন প্রায় ১৫০০ কয়েদি। এর বিপরীতে ফাঁসির আসামিদের নিয়মিত জেল আপিলও রয়েছে। আইনজ্ঞরা বলছেন, এত বিপুলসংখ্যক ডেথ রেফারেন্স মামলা আটকে থাকাটা উদ্বেগজনক।
এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত পেপারবুক তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তি করতে হলে কোনো রকম মুলতবি না দিয়ে শুনানি অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি বিচারক নিয়োগেরও প্রয়োজন রয়েছে।’
কথা হয় ডেথ রেফারেন্স মামলা সংক্রান্ত বেঞ্চের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মনিরুজ্জামান রুবেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কনডেম সেলে ফাঁসির আসামিরা মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করছেন। ফলে এগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি দরকার। হাইকোর্টের তিনটি ডিভিশন বেঞ্চ ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল নিষ্পত্তি করছেন।
প্রধান বিচারপতি এসব মামলা শুনানির জন্য বেঞ্চের সংখ্যা বাড়িয়েছিলেন। এসব বেঞ্চে সাধারণত এখন ২০১৩ সালের নিু আদালতে ফাঁসির আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের মামলাও রয়েছে। তিনি বলেন, ক্রম অনুসারে মামলার শুনানির কোনো বিধান নেই। এটা দীর্ঘদিনের প্রথা। প্রধান বিচারপতি ইচ্ছে করলে যেকোনো সময়ের ডেথ রেফারেন্স শুনানির অনুমতি দিতে পারেন।
বিচারিক আদালত কোনো আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিলে সেটিকে কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে। এটিকেই ডেথ রেফারেন্স বলা হয়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিনিয়ত ডেথ রেফারেন্স মামলা এসে জমা হওয়ায় চাপে আছে হাইকোর্টে। গত বছর কয়েকটি চাঞ্চল্যকর মামলার ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হলেও সাধারণ মামলার ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির হার ছিল খুবই কম।
সূত্র বলছে, গত তিন বছর ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা ছিল কম। এর আগের তিন বছরে নিষ্পত্তির হার ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। এখন ২০১৩ সালের ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। ২০১৫ সালের মামলায় পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) প্রস্তুতের কাজ চলছে। তবে বেশ কিছু মামলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরির পর ডেথ রেফারেন্সের শুনানি ও নিষ্পত্তি হয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পিলখানা হত্যা মামলা, সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খালাফ আলী হত্যা, না’গঞ্জে আলোচিত ৭ খুন, শিশু রাজীব ও রাজন হত্যা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স। আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বিচারিক আদালত ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন ৫ বছর আগে। সেটিসহ রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্সও হাইকোর্টে অনুমোদনের অপেক্ষায়।
জানা যায়, ২০১০ সালে ডেথ রেফারেন্স মামলা ছিল ৫৮৫টি, তার মধ্যে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৪৩টি, বিচারাধীন থাকে ৫৪২টি। ২০১১ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০৯টি, নিষ্পত্তি হয় ৭৪টি। ২০১২ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয় ৫৯৫টি, নিষ্পত্তি হয় ১৪৫টি। ২০১৩ সালে ছিল ৫১৩টি, নিষ্পত্তি হয় ১১১টি। ২০১৪ সালে ছিল ৪৯৮টি, নিষ্পত্তি হয় ১৩৫টি। ২০১৫ সালে ছিল ৪৭৭টি, নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৫৮টি। ২০১৬ সালে ছিল ৫৮০টি, নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৪৫টি। ২০১৭ সালে ছিল ৭০৬টি, নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৬৬টি। গত বছর ২০১৮ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১১টিতে, নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৮৩টি।
জানতে চাইলে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ডেথ রেফারেন্স মামলাজটের অন্যতম কারণ হল বিচারিক আদালতে ঢালাও ফাঁসির আদেশ। হাইকোর্টে ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ বিচারকের সংকট রয়েছে। অনেক বিচারক আছেন ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনতে চান না। সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, তার আমলে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হয়।
এ ধারা অব্যাহত রাখতে আরও বেঞ্চ গঠন প্রয়োজন। দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেক নির্দোষ ব্যক্তিকেও বছরের পর বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। অনেক সময় নির্দোষ ব্যক্তিরও বিচারিক আদালতে সাজা হয়। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছর যত সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, দায়ের হয়েছে তার দ্বিগুণেরও বেশি। এ কারণে নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লাগছে। এতে একদিকে যেমন দোষী ব্যক্তির শাস্তি বিলম্বিত হচ্ছে, তেমনি দোষ প্রমাণ না হলে নির্দোষ ব্যক্তিকেও দীর্ঘদিন বিনা বিচারে কারাবরণ করতে হচ্ছে।
সূত্র: যুগান্তর