গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : করোনায় ১০২ সদস্যকে হারিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার পর থেকে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে কাজ করছেন এই বাহিনীর সদস্যরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিলে প্রথম পুলিশ বাহিনীতে সংক্রমণ ধরা পড়ে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ বাহিনীর ২৩ হাজার ২০৯ জন করোনায় আক্রান্ত হন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রয়েছেন ৩ হাজার ৬০৭ জন। এরপরই আছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। করোনায় এখন পর্যন্ত র্যাবের ২ হাজার ৯৫৭ জন সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন।
একই সময়ে সারা দেশে আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ২১ হাজার ৮৩১ জন সুস্থ হয়েছেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ১ হাজার ৩৭৮ জন পুলিশ সদস্য। এঁদের মধ্যে দুজন বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার দুপুরের মধ্যে মারা গেছেন।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীর ১০২ সদস্য মারা গেলেন। তাঁদের মধ্যে ১ জন পুলিশ সুপার মর্যাদার কর্মকর্তা, ২ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ১৩ জন পরিদর্শক, ১৬ জন উপপরিদর্শক (এসআই), ৮ জন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), ১ জন নায়েক, ৫২ জন কনস্টেবল, ৩ জন সাধারণ কর্মচারী (সিভিল স্টাফ) এবং ৬ জন র্যাব সদস্য।
দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত বছরের ১৮ মার্চ। দেশে এ পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ ভাইরাসে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, ডিএমপিতে শুক্রবার পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট ৩২ জন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৭১ জন।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অপরাধবিরোধী অভিযান, প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) নিশ্চিত করার মতো কর্তব্যের পাশাপাশি দুস্থ ব্যক্তিদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো, করোনায় মৃত ব্যক্তিদের দাফনে সহযোগিতা করা, হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে সাহায্য করার মতো মানবিক কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ। মারা যাওয়া তাঁদের এই সহকর্মীরা ঘোর অসময়েও জনগণের মধ্যে থেকে কাজ করে গেছেন। পাশাপাশি পুলিশ ব্যারাকগুলোতে গাদাগাদি করে থাকার ফলে একজন থেকে অনেকের মধ্যে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়েছে।
ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রথম দিকে আক্রান্তের বড় কারণ ছিল অনভিজ্ঞতা, করোনা প্রতিরোধের নির্দেশনা যথাযথ অনুসরণ করতে না পারা। যেমন আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের একই ব্যারাকে থাকতে হয়েছে। তাতে অন্যরা আক্রান্ত হন। পরে চিকিৎসাসহ ডিএমপির শীর্ষ নেতৃত্বের তদারকি, সচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া এবং আক্রান্তদের আলাদা করে রাখায় সদস্যদের মধ্যে সংক্রমণ কমে আসে। তিনি জানান, এখন ডিএমপির ৯০ শতাংশ পুলিশ সদস্য করোনার টিকা নিয়েছেন। সংক্রমণ ও মৃত্যু এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে।
গত বছরের ২৮ এপ্রিল প্রথম পুলিশ সদস্য হিসেবে কনস্টেবল জসিম উদ্দিনের (৪০) মৃত্যু হয়। তিনি ডিএমপির ওয়ারী ফাঁড়িতে কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ মারা গেছেন দুজন। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মারা যান রাঙামাটির আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-১) অতিরিক্ত সুপার মো. আহসান হাবীব (৩২)। তিনি ঢাকায় কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে।
সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার দুপুরে মারা যান সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার কনস্টেবল জনি মিয়া (২৩)। তাঁর বাড়ি জামালপুর সদরের বেলবালিয়া লাহেরকান্দিতে। এই দুজনকে নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে মৃত্যু ১০২ হয়।
করোনায় স্বজন হারানো পুলিশ সদস্যদের পরিবারগুলো এখনো প্রিয় মানুষের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে। আবার কোনো কোনো পরিবার উপার্জনক্ষম সদস্যের মৃত্যুতে আর্থিক সংকটে পড়েছে।
পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামানের স্ত্রী লুলু আর মারজান বলেন, বেঁচে থাকলে তিন বছর পর আসাদুজ্জামান অবসরে যেতেন। তিনি চাকরিকে অনেক গুরুত্ব দিতেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরও কর্মস্থল ছাড়তে চাননি। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেই মানুষটা এখন স্মৃতি হয়ে গেলেন। তিনি বলেন, দুই ছেলেমেয়ে ময়মনসিংহে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। বাবার স্বপ্ন ছিল, ছেলেমেয়ে দুজনই পুলিশ কর্মকর্তা হবেন।
নরসিংদী পুলিশ লাইনসের রেঞ্জ পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান রাজধানীর রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গত ৩ এপ্রিল। তাঁর স্ত্রী লুলু আল মারজান বলেন, মাসিক বেতন দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ও সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতো তাঁকে। তবে অভাবে থাকলেও তাঁদের সংসারে সুখ ছিল। স্বামীর পেনশন ও অবসরকালীন ছুটির টাকা এখনো হাতে পাননি বলে জানান তিনি। মৃত্যুর পর পুলিশের কল্যাণ তহবিল থেকে ৭৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। তা-ও শেষ হয়ে গেছে। এখন কষ্টে দিন চলছে। তবে স্বামী আগে উত্তরায় এপিবিএনে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে তিনি সন্তানদের নিয়ে এখন কোয়ার্টারে আছেন।
করোনায় প্রথম মারা যাওয়া ডিএমপির ওয়ারী পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল জসিম উদ্দিন স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন। স্ত্রী ফারজানা আক্তার থাকেন কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কাঁঠালিয়ায়। তিনি বলেন, জসিম ১৯ বছর চাকরি করেছিলেন। বড় মেয়ে স্থানীয় স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেটি একদম ছোট, স্কুলে দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘ঈদ এলে ছেলেমেয়েরা বাবার জন্য কান্নাকাটি করে। বাবার আদর তো তারা আর পাবে না।’ ফারজানা পুলিশ বিভাগ থেকে টাকা পেয়েছেন। তা দিয়েই তাঁর সংসার চলছে।
পুলিশ সদস্যদের ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ নেই। তাই করোনা পরিস্থিতিতে কাজ চালিয়ে নিতে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এসওপি অনুযায়ী কাজের সময় প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। হাসপাতালে রোগী নেওয়া বা লাশ দাফনের সময় পিপিই পরতেই হবে। জনসমাগমস্থলে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। জীবাণুনাশক দিয়ে হাত পরিষ্কার রাখতে হবে। সুষম খাবার খেতে হবে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মো. সোহেল রানা বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসওপি প্রস্তুত করে তা অনুসরণ করছে পুলিশ। সে কারণে প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে পুলিশে আক্রান্ত ও মৃত্যু কমে এসেছে। একই সঙ্গে আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসায় বৈপ্লবিক উন্নতি করা হয়েছে। দ্রুত সুস্থ হয়ে পূর্ণ মনোবল ফিরে পাচ্ছেন সদস্যরা।
করোনায় মারা যাওয়া পুলিশ বাহিনীদের নামের তালিকা
সূত্র: প্রথম আলো